আকাঙ্ক্ষায় থাকলেও বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান যে ঘটে যাবে, মাফিয়া-অগণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকার যে উৎখাত হবে তা মোটের উপর অভাবনীয়ই ছিল। আকস্মিকতার একটা রেশ থাকায় প্রাথমিক বিচারে এই গণঅভ্যুত্থানকে অপ্রস্তুত জনগোষ্ঠীর কার্যকলাপ হিসাবে দেগে দিতে পারেন নানান পক্ষ-বিপক্ষের লোকজন। অস্থিরতা, নানান জটিলতায় অনেকেই বেদিশা হতে পারেন। সময় খুব অল্প গেছে, তাই এখানে এই গণঅভ্যুত্থানের ভাগ্য গণনা করার চেষ্টা থাকবে না। প্রাথমিকভাবে এই গণঅভ্যুত্থানের চরিত্রগত কিছু চিহ্নায়ন, পূর্বশর্তের তালাশ, নতুন সিভিল ইমাজিনেশনের প্রেক্ষাপট এবং সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বাক্য খরচ করবো। তত্ত্বায়নের সাধ না থাকলেও কিছু ইঙ্গিত থাকতে পারে।
গণঅভ্যুত্থানের এজমালি ভাষা
জুলাই-আগস্টের অভাবনীয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিএনপি, জামাত এবং কিছু বাম দলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে প্রভাববিস্তারি ভূমিকা রেখেছে। তবে এই আন্দোলনের হাত ধরে গণঅভ্যুত্থানের কিছু চিহ্ন বিচার করলে দেখা যাবে এটা আদতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। অনেকে নাখোশ হলেও, ৪-৫ আগস্টের দিকে সেনাবাহিনীসহ অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর নিম্ন থেকে মধ্যপদস্থ সৈনিক-কর্মকর্তার আপাত অসহযোগও এই গণঅভ্যুত্থানকে প্রাথমিক সমাপ্তির দিকে নিয়ে গেছে। সামরিক বাহিনী নিয়ে কথা বলার নানান জটিলতা আছে তবে সাবধানতার সাথে ঘটনাগুলি বিচার করলে বরং গণঅভ্যুত্থানের পরিসর সম্পর্কে গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছানো যাবে। মুশকিল হয় এই ছাত্র-জনতার পরিচয় পরীক্ষা করে দেখতে গেলে। প্রাথমিক পরীক্ষাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে এই ছাত্র-জনতার ছাউনিতে নানা শ্রেণী-পেশা-লিঙ্গ-জাতির মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। এমনকি শ্রেণীর দিক থেকেও এই অভ্যুত্থানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চাকরির আবদার থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনকে শুধু কোটার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ আন্দোলন বিস্তৃত হওয়ার শুরু থেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগ্রামী ভূমিকা এবং অকাতরে মৃত্যুই বৃহত্তর মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে অভ্যুত্থানের সাথে যুক্ত করে ফেলে। নারী ছাত্র এবং তথাকথিত আটপৌরে নারীর সংগ্রামী থেকে মাতৃরূপে রাস্তায় রাস্তায় আবির্ভাব এই আন্দোলনের মোড়-ই ঘুড়িয়ে দিয়েছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ সকলেরই নজরে পড়েছে। আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত কোন একক রাজনৈতিক দলের একছত্র বয়ানের গরহাজিরায় এমন বিবিধ পরিচয়-বর্গের বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সপ্রান এবং সংগ্রামী অংশগ্রহণ বহু বছররের ভয়ের রাজত্বকে চুরমার করে দিয়েছে এবং নতুন সিভিল ইমাজিনেশনের পথ খুলে দিয়েছে। অনেকের মনে কষ্ট থাকলেও, এই প্রবল-প্রতাপ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থানের সাথে বলশেভিক বিপ্লব বা ইসলামিক বিপ্লবের কোন মিল নাই। প্রস্তুতিও সেরকম ছিল না। আমার মতে, এই গণঅভ্যুত্থানের বর্গীকরণ বা চিহ্নাহয়ন যদি করতেই হয় তবে আকাঙ্ক্ষা-কল্পনা-ভাষার দিক থেকে এর অবস্থান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কল্পনার কোল ঘেঁষে।
নজিরবিহীন লুটপাট, অর্থপাচার, দুর্নীতি, গুমখুন, প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দীর্ঘমেয়াদি আবহের মধ্যে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী বহুদিন ধরেই হাঁসফাঁস করছিল। গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল বহুদিন ধরেই। এটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না যে, শান্তিপূর্ণ কোন রকমের ক্ষমতার পালাবদলের পথ বন্ধ করেছিল বিগত আওয়ামীলীগ সরকারগুলি। এমনকি তাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই এই পথ খোলা ছিল না। রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় নিপীড়ক শক্তি ব্যবহার ছাড়া তাদের কাছে আর কোন রাজনৈতিক ভাষা অবশিষ্ট ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে স্পষ্ট শত্রু পক্ষ হিসাবে আওয়ামীলীগ সরকার এবং অনুগত অথচ নিপীড়ক রাষ্ট্রীয় শক্তি জনগণের সামনে হাজির হয়েছে নিশ্চয়ই। তাতেও করে গণমানুষের সপ্রান অংশগ্রহণ ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ এমন পরিস্থিতি বহু দিন ধরেই বিদ্যমান ছিল। নানান নিপীড়নের পরেও বিএনপি বা জামাতের জনভিত্তি ছিল। তারপরও অতিতের বহু গুরুতর সময়ে, ক্রান্তিকালীন মুহূর্তে গণমানুষের এত ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের চোখে পরে নাই। এটাও ভেবে দেখবার মতই বিষয়। অকাতরে ছাত্রদের শহিদ হওয়ার ঘটনা, নারী ছাত্রদের উপর প্রকাশ্য জুলুম হিন্দু-মুসলমান, আদিবাসী, নানা পোশাকের নারী, ছাত্র-অছাত্রসহ নানা বর্গকে তাদের পার্থক্য সমেত এক কাতারে নিয়ে আসে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা, এমন ঐক্য সাময়িক। এই সাময়িক ঐক্যটাও কোন পূর্বপ্রতিষ্ঠিত প্রবল-প্রতাপ মতাদর্শিক বয়ানের জোরে সম্ভব হয় নাই, একাট্টা কোন বিশেষ ধর্মীয় আবেগের বশে না, বরং একটা এজমালি ভাষায়, একটা অবদমিত অথচ আকাঙ্ক্ষিত সিভিল ইমাজিনেশন থেকে যেখানে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী কল্পনা করেছে আইনের শাসনের এবং জীবনে আয়উন্নতির ন্যায্য সুযোগ অধিকারের। আইনের শাসনের ব্যাপারটা খুব বেশী জটিল কিছু না। বহুদিন ধরে নানা পরিসরে এই ভাষা উপস্থিত ছিল। সারা দুনিয়ায় বহু জনগোষ্ঠী মোটের উপর এর সমাধা করতে পেরেছে। বাংলাদেশিদের আকাঙ্ক্ষাও এর ব্যতিক্রম নয়। লুটপাট-দুনীতি-অর্থপাচার ইত্যাদি বিষয় হতে মানুষ মুক্তি চায়। রাষ্ট্রকে এই দুশ্চরিত্র অবস্থা থেকে মুক্ত করতে চায়। রাষ্ট্র শুধু তার নিপীড়ক চরিত্র নিয়ে মানুষের সামনে হাজির থাকবে না বরং তার প্রবণতাই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য শক্তিক্ষয় করা। গণঅভ্যুত্থানের এজমালি ভাষাটা গড়ে উঠেছিল এসব আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই। বহু মানুষের মুক্তি- এই গণঅভ্যুত্থানের এজমালি ভাষা।
যে এজমালি ভাষার জোরে গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছিল, সে ভাষা রক্ষা করতে হবে। যেই এজমালি ভাষায় নানান পোশাকের-মতাদর্শের মানুষ এক হতে পেরেছিল সেই ভাষা রক্ষা করতে হবে। এটা সিরিয়াস ইস্যু। কারণ এটা গণঅভ্যুত্থানের নৈতিক দায়িত্ব। সব প্রশ্ন চলতে পারে। বিতর্ক চলতে পারে। তবে তা হতে হবে গণঅভ্যুত্থানের এজমালি ভাষার আওতায়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি যে সচেতন চেষ্টা না থাকলে এবং পুনমঞ্চায়ন না করতে পারলে যেকোনো ঐক্যের এজমালি ভাষা কত দ্রুত মিইয়ে যেতে আপরে। মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করলেই ব্যাপারটা কিছুটা পরিষ্কার হবে। মুক্তিযুদ্ধটা রাজনৈতিক বয়ান। যুদ্ধটাই প্রকৃত বাস্তবতা। কেউকেউ আগে থেকেই প্রচার-যোগাযোগে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা বুঝের মধ্যে আনতে পেরেছিলেন তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র ‘যুদ্ধের’ বিকট চেহারায় নিজের ঘরের সামনে উপস্থিত হলে বহু মানুষের মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রচণ্ড বাস্তবতাই নানা মত-বর্গের মানুষকে এক করে ফেলেছিল এবং যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে খুব সহজেই ফারাকটা আবার সামনে চলে আসে। আমাদের এখন ভেবে দেখবার সময়, খুঁজে দেখবার সময়, অভ্যুত্থানের এমন কি ভাষা ছিল যাকিনা এতগুলি পক্ষকে একত্র করেছে? এই চিহ্নায়ন জরুরি কাজ। পুরাপুরি ভাগাভাগি, তাও এত তাড়াতাড়ি ভাগাভাগি হলে ক্ষতিটাও এজমালি হবে। আর এজমালি নিরাপত্তা সংকট তৈরী হবে। প্রায় কেউই বাদ যাবে না।
ক্রিটিক্যাল ইন্টিমেসি
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রাথমিক অবস্থায় কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে সারা দেশে দেখা গেছে নানা মাত্রার বিশৃঙ্খলা। বাংলাদেশের মতন ঘনবসতিপূর্ণ একটা অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতি বিশেষ করে থানাগুলি ফাঁকা হয়ে যাওয়া একে তো নজিরবিহীন তার উপর নানান কারণে বিপজ্জনক। এমন পরিস্থিতি মুহুর্মুহু নানান বিপদ, বিশেষ করে বিপদের আশংকা জেঁকে বসেছিল জনমনে। বলতে দ্বিধা নাই যে প্রাথমিক বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে, গণমানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ গণপ্রতিরোধের প্রমাণ দাখিল করেছিল। ডাকাত আক্রমণ, র-জ্বর, সংখ্যালঘু আক্রমণের আশংকা প্রতিরোধে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী তাদের কওমি শক্তির সবেচেয়ে জোরালো নজির স্থাপন করেছেন। অথচ, এসব নানামুখী অর্জনকে আড়ালে রেখে শুধুমাত্র আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত ফারাকগুলিকে সামনে আনা অন্যায্য এবং ক্ষতিকর। প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার অবশেষ হিসাবে চরম বিপদের সামনে ঐক্য তৈরি করার অভ্যাসটা কাজে লেগেছে নিশ্চয়ই। এর বিপদও আছে। রাষ্ট্র কল্পনা বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র নিখাদ সামাজিক বিচার-আচার-উদ্যোগ দিয়ে জনগোষ্ঠীর সকল সমস্যার সমাধানের চিন্তা অত্যন্ত সমস্যাজনক। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আজকের জমানায় রাষ্ট্রই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান। সমাজ তুলনায় শিথিল প্রতিষ্ঠান। সমাজ চলে যাচ্ছে না, সমাজ থাকবে। তবে সমাজকে সবসময়, সব সমস্যার সমাধানে সামনে ঠেলে দেয়ার মানে হয় না। গত পনের বছরে রাষ্ট্রীয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেলেও, এই প্রতিষ্ঠানগুলি কার্যকর করে তুলতে সময়ের প্রয়োজন। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেয়া, মনোযোগ ধরে রাখা এবং দীর্ঘ মেয়াদে শক্তিক্ষয়ের বিপরীতে প্রধান বাঁধা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানান সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিষয় নিয়ে অতিমাত্রায় দ্বিধা-বিভক্তি। এ যেন এক অনিঃশেষ মারামারির পরিসর। উপনিবেশিক অভিজ্ঞতার কুফল আমরা এখানে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। প্রভু যেহেতু বিদেশী, রাষ্ট্রের প্রজা হয়ে আছি, চাইলেও নাগরিক হওয়া যাচ্ছে না- তাই আমাদের পূর্বজদের পক্ষে নিজেদের কর্মতৎপরতা এবং ক্ষমতা জাহির করবার জন্য সাংস্কৃতিক-সামাজিক পরিসরে কাজ করা ছাড়া পথ ছিল না। দুইবার স্বাধীন হবার পরও, সেই অভ্যাস এবং অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয় নাই। অনলাইন এবং মাঠে-ঘাটেও সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিষয়ে দুইভাগ হয়ে মারামারি করাটাই সকলের প্রাথমিক প্রবণতা। সেই তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিষয়ে চিন্তা-সংলাপ অনেকের কাছে ম্যাড়মেড়ে লাগে। আমরা ক্রমাগত দেখতে পাচ্ছি, এমন সাংস্কৃতিক পরিসরে নিত্যনতুন বিতর্ক, হিংসা-বিদ্বেষে প্রচুর শক্তিক্ষয় হচ্ছে। এমন অবস্থায় বেদিশা হয়ে পড়া এবং নিজের জনগোষ্ঠীর উপর বিতৃষ্ণা চলে আসতে পারে। এব্যাপারে দুই একটা সাবধানবানী উচ্চারণ করা প্রয়োজন।
অনেকেই শুধু নিজের দেশের গণমানুষের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। হয়তোবা কিছু কারণও আছে। তবে বিশেষভাবে বাংলাদেশের গরিব মানুষজনের উপর গোস্বা করা অন্যায্য হবে। আবার অনেকের কাছেই, এক্সক্লুসিভ্লি নিজের দেশের মানুষকে ছোট নজরে দেখা স্বভাবদোষ বা ফ্যাশন। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের মনের কল্পিত সাম্যের বা আদর্শের সাথে দিন দুনিয়ার আদতে কোন সম্পর্ক নাই। সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বৈষয়িক প্রস্তুতি, নতুন ভাষা আবিষ্কার আর লম্বা ন্যারেটিভ প্রচারের কাজটা যদি আমরা না করতে পারি তবে কিসের জন্য এত কান্নাকাটি? আম্রিকায় যান, ইউকে যান বা ফ্রান্সে যান, ডানপন্থিরা আপনার মুক্তমনকে কি সম্মান দেয় দেখেন। ইভাঞ্জেলিকালদের প্রাতিষ্ঠানিক দৌরাত্ম্য টের পাবেন। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা পাশের দেশের প্রবল প্রতাপ হিন্দুত্ব শ্রেষ্ঠত্ববাদ কি আমরা টের পাচ্ছি না? পশ্চিমে যদি কিছুটা শান্তি বজায় থাকে, তার একমাত্র কারণ প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি। কয়েক প্রজন্মের প্রস্তুতির কারণে রাষ্ট্র মিনিমাম বিমূর্ততা লাভ করেছে, তাই সেটার লাভ ইমিগ্র্যান্ট বা অশ্বেতাঙ্গরাও পায়। পুরাটা মবের দখলে তাই যেতে পারে না। মিনিমাম ওয়েজ আর্নার হোয়াইট ওয়ার্কিং ক্লাসের সাথে কথা বলেন, প্রান্তিক এমেরিকার রিপাবলিকান ফ্যামিলির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের সাথে কথা বলে দেখেন। টের পাবেন আপনার আদর্শগত দুনিয়া কত দূরে। কিন্তু ওটা অনেকেই হয়তো মেনে নেবেন। কারণ আমাদের অনেকেই বেশ নাকউঁচা স্বভাবের না হয় নাদান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, দুনিয়ায় চলাফেরা করার জন্য প্রস্তুত নন। অপরিপক্ব।
কাঠামোগত ভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, আইনের শাসন জারি করে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির মাধ্যমে দ্রুতই কিছুটা শান্তি হাসিল করা সম্ভব। কিন্তু এটা প্রাথমিক কাজ। মতাদর্শিক লড়াইয়ের জন্য, বিরোধীপক্ষকে নিজের দলে যুক্ত করার জন্য লম্বা বয়ান তৈরি করতে হয়, নানান সামাজিক-সামস্টিক উদ্যোগের মাধ্যমে পাবলিক পরিসরে নিজের হাজিরা দিতে থাকতে হয়। প্রতিনিয়ত হাজিরা দিতে থাকতেই হবে। পাবলিক পরিসরে সবাই নিজের মত নিজস্ব যুক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। এই সংলাপ অনিঃশেষ। যার বয়ান বেশী মানুষকে একত্র করতে পারবে তার হেজিমনিই কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা আবার চিরস্থায়ী কিছু না। যেকোনো দল-পক্ষ আরেক পক্ষের প্রতি সমর্থন সরিয়ে নিতে পারে। এভাবেই গণতন্ত্র চলে। প্রথম চিন্তায় অনেক হাউকাউ-বেড়াচেরা মনে হলেও, এই পথে না চললে সমাজও স্বৈরাচারী হয়ে যেতে পারে। গণমানুষের আচরণে বহু সমস্যা থাকতে পারে, এর কারণ কি তার মজ্জাগত নাকি তার অর্থনীতিক অবদমনের প্রতিক্রিয়া? দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাহীন হয়ে থাকা, জনগোষ্ঠীর আচরণগত সমস্যাকে তার মজ্জাগত সমস্যা হিসাবে দেগে দিচ্ছি নাতো? আইনের শাসনের দীর্ঘমেয়াদি অনুপস্থিতি কি প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে না? তাছাড়া বিগত স্বৈরাচারী কাঠামোর ফেলে যাওয়া কাঠামো এবং সুবিধাভোগীরা এখনো সচল আছে। এই পরিস্থিতিতে জনগোষ্ঠীর আচরণ-ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকে সজাগ নজর রাখতে হবে, তবে সমস্যাগুলির বৈষয়িক পূর্বশর্তগুলির ব্যাপারে হুঁশ রাখাও দরকারি কাজ। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের উত্থাপিত চিন্তাকে ধার করে, দূরত্ব বজায় না রেখে বরং কাছে থেকে বুঝে ক্রিটিকাল ইন্টিমেসি তৈরির মাধ্যমে আমরা দীর্ঘমেয়াদি লিপ্ততার জন্য প্রস্তুত হতে পারি।
যৌথ উদযাপন এবং যৌথ শোক
যাত্রাবাড়ি-মোহাম্মদপুরসহ সারা বাংলাদেশে যেসব জায়গায় গণমানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, আহত হয়েছেন, শহিদ হয়েছেন সেসব জায়গায় নিজেরাই সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের আত্মত্যাগ স্মরণ করতে পারেন। যে যেভাবে যোগ দিতে চায় সেভাবে যেন দিতে পারে। কেউ গান গাইতে চাইলে গাইতে, কবিতা পড়তে চাইলে পড়তে, কেউ দোয়া-দুরুদ পড়তে চাইলে পড়তে, বক্তৃতা দিতে চাইলে যেন বক্তৃতা দিতে পারেন। তাও যাতনা-শোক-আকাঙ্ক্ষা ভাগাভাগি করার পরিসর যেন থাকে।
বহু ক্ষেত্রেই কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যেমন স্বৈরাচারের শক্তিকে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিরোধ করেছেন, ডাকাতদের সামাল দিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকিয়েছেন, ঠিক একইভাবে নিজ নিজ উদ্যোগে নিজেদের অর্জন স্মরণ, ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলতে থাকতে হবে। কারো জন্য অপেক্ষা করার কারণ দেখি না। এবারের গণঅভ্যুত্থানের চরিত্রই এই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিকনির্দেশনা যেমন ছিল, ছিল বহু রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষাও ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই বহু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। এব্যাপারে হুঁশ না থাকলে বাংলাদেশের মানুষের কর্তাসত্তা বা পিপলস এজেন্সিকে অস্বীকার করা হবে। সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ- উভয়কে পাশাপাশি মূল্যায়ন না করলে যেমন এই গণঅভ্যুত্থানের চিহ্নায়ন করা যাবে না ঠিক তেমনি এর চরিত্রটাও বোঝা যাবে না। এই অর্গানিক চরিত্র বজায় রাখতে হবে। আমাদের সকলের চোখের সামনেই বিভেদ তৈরি করার অনেক প্রজেক্ট ফরমুলেট করা হচ্ছে। আর বহু আগে থেকেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিভেদ বিদ্যমান। তাই বার বার ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া পথ নাই। বারবার নিজেদের ঐক্যের প্রমাণ নিজেদের সামনে এবং বিশ্বদরবারে প্রদর্শন করতে থাকতে হবে। খেলা শেষ বলার সুযোগ নাই। এই ঐক্য রক্ষা করতে হবে। এবারের কওমি শক্তি বৃহত্তর শক্তি। এই কওমে সবার জায়গা আছে। কারণ বৈচিত্র্য স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য। মুখের কথায় আবার এটা প্রমাণ হবে না। সবাই বার বার এক হতে হতে, নিজেদের মধ্যে মোলাকাত, সংলাপ, যৌথ শোক, যৌথ উদযাপন ইত্যাদির মধ্য দিয়েই নতুন ঐক্যের ভাষা তৈরি হতে পারে। ক্রমেই নতুন কওমের আকার সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন।
অভ্যুত্থানের তত্ত্বায়ন এবং লম্বা ন্যারেটিভ তৈরির প্রয়োজনীয়তা
বিভিন্ন কাজে আন্দোলন চলাকালীন অবস্থার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের লিখিত রিপোর্ট পরীক্ষা করে দেখছিলাম। বয়ানের অবস্থা খুব খারাপ। খারাপ এই কারণে না যে আমাদের প্রশংসা করা হয় নাই। বরং রিপোর্টগুলিতে আগে থেকেই পজিশন নিয়ে আন্দোলনকারীদের ডিহিউম্যানাইজ করা হয়েছে, মোটের উপর তান্ডবকারি হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন যেন হঠাৎ অশিক্ষিত-অপ্রস্তুত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী একটা নৈরাজ্যর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আওয়ামী খুন-খারাবির কথা এমনভাবে আসছে যেন অসহায় নান্নুবাচ্চা সরকারের এ ছাড়া আর পথ ছিল না। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে, ভয়ের রাজত্বের মধ্যেও যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি এবং আকাঙ্ক্ষা জমা হচ্ছিল এমন কোন নজির লেখাগুলিতে নাই। এর মধ্যে অনেক লেখাই ভারতীয় গণমাধ্যমের। প্রকাশ্য গোদি মিডিয়ার কথা বাদ দিলাম, তথাকথিত সৎ গণমাধ্যমের পজিশনও প্রায় এক। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিজেপির বয়ান তো আছেই এমনকি ভারতের সৎ-গণতন্ত্রকামী-বামপন্থী অংশটা যারা বহুদিন ধরে প্রবল প্রতাপ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারাও বাংলাদেশ চেনেন না। হয়তো চিনতে চানও না। বাংলাদেশর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব করার বা তত্ত্বায়ন করার প্রস্তুতি নাই এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ইছাও নাই। এইকাজটা বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের বাইরে থাকা নানান ডিসিপ্লিনের বাংলাদেশি পেশাজীবীদেরই করতে হবে। এই আন্দোলনের তত্ত্বায়ন, ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা এবং অবদমিত অবস্থাতে থাকেলেও দীর্ঘমেয়াদি যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি এবং পূর্বশর্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপস্থিত ছিল তা দেগে দিতে হবে। কিছু বাক্যখরচ করে এসব ফলিয়ে তুলতে হবে।
স্থানিক সাংস্কৃতিক উৎপাদনের ব্যবহার
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে রাষ্ট্রীয় বয়ানকে সাংস্কৃতিক উৎপাদনের দিক থেকে সবচেয়ে জোরালোভাবে সমস্যায়িত করে আবীর আব্দুল্লাহ’র ফটোসিরিজ ‘War Veterans Of Bangladesh Liberation War in 1971’। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার উদযাপনে, পলিটিক্যাল পার্টিগুলি বা সিভিল সোসাইটি বা মার্জিত সুরুচিসম্পন্ন ঢাকাই মানুষজন নিজেদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযুদ্ধ করে মুখে ফেনা তুললেও, লাভের গুড়টা নিজেদের ঘরে তুললেও আদতে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা যে নাই সেটা ২০০০ সালে এক তরুণ আলোকচিত্রির কাজের বরাতে সকলের সামনে চলে আসে। ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি বলে একে আবেগি শিল্পচর্চা বলে এড়িয়ে যাওয়ারও স্কোপ কম ছিল, দালিলিক প্রমাণ হিসাবেও মানুষের সামনে ছিল। আবীরের ফটোসিরিজে স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের একটা বড় অংশ জনগোষ্ঠীর ‘সুবিধাবঞ্চিত’ অংশের প্রতিনিধি, কতটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই যন্ত্রণা শারীরিক তো বটেই পাশাপাশি অর্থনীতিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং মনস্তাত্ত্বিকও। হাড় জিরজিরে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের চাহুনির সামনেই মুক্তিযুদ্ধের মহাবয়ান হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক বয়ানের পাশাপাশি সামস্টিক চালিয়াতি এবং ব্যর্থতার হিসাব করার ফুরসৎ তৈরি হয়। সুযোগ ছিল নানান ডিসিপ্লিন থেকে দুর্দান্ত সব রিডিং হাজির করার। কিন্তু এই ফটোসিরিজের উছলায় মুক্তিযুদ্ধের মহাবয়ানকে সমস্যায়িত করতে কোন রকমের ক্রিটিক্যাল টেক্সট ঢাকার বাজারে আমার চোখে পড়ে নাই। এইটা একটা টাস্কি খাওয়ার মতন বিষয়। বিষয়টা নিয়ে দুই একজনের সাথে কথা হয়েছিল। ততদিনে আবীর আব্দুল্লাহ অনেক সিনিয়র এবং প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী। তারপরও দেখলাম কারো আগ্রহ নাই। বড়জোর বলেন যে এসব বিষয়ে আপনাদেরই লিখতে হবে। তাহলে সাংস্কৃতিক উৎপাদন কাজে খাটানোর আস্ফালনের মানে কি? নিজেদের কালচারাল প্রোডাকশন কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা বা সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার যে বৈশ্বিক জ্ঞানগত কালচার তৈরি হয়েছে, তার সাথে কি বাংলাদেশি চিন্তক শ্রেণী যুক্ত না? ব্যাপারটা কি শুধু আলোকচিত্র বলে? নাকি সমস্যাটা আরও গভীর? ঢাকাই লোকজন যে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের বয়ানেই আরাম পান এবং ভাবেন যে আওয়ামীলীগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নাই সেটা ভুলে গেলেও চলবে না।
মুক্তিযুদ্ধের মহাবয়ানকে সাংস্কৃতিক পরিসরে সমস্যায়িত করতে বাংলাদেশকে অন্তত ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হল কেন? ২০০০ সালে এসে নতুন জমানা আর চিন্তার ধাক্কা জ্ঞানে অজ্ঞানে এই কাজটা করে থাকতে পারে? তাছাড়া, হাই-আর্টের প্রচলিত ফর্মগুলি আর শিক্ষা ব্যবস্থা এমন কাজ উৎপাদনের পরিসর তৈরি করতে পারে নাই। বিকল্প একটা শিক্ষা মাধ্যম থেকে এই উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। অথচ এই শক্তিশালী কাজ নিয়ে কোন লম্বা ইংরাজি বা বাংলা টেক্সট আমাদের চোখে পড়ে নাই। নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎপাদন আমরা কাজে খাটাতে পারি নাই। নানা ডিসিপ্লিনের শাস্ত্রীয় চর্চার পরিসরে থেকেই নানান কাজ করা যেত। কিন্তু করা হয় নাই। এই কথাগুলি বলার কারণ এই যে, আমার আশঙ্কা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সাথে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক উৎপাদনগুলিও আমরা হয়তো কাজে লাগাতে পারবো না। এই অভ্যাসই আমাদের নাই। প্রস্তুতি এবং আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের নানা দিকগুলি বিচরে দেখাও এই অভ্যুত্থানের নৈতিক দায়িত্ব। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ভাষার মধ্যে যেমন আর্টের প্রচলিত ফর্মগুলি আছে, একই সাথে আছে পাড়া-মহল্লার সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার নানান সৃজনশীল তরিকা। এসব সপ্রান অংশগ্রহণের বিস্তারিত চিহ্নায়ন এবং বিচারবিশ্লেষণ না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাহা-হিহি করে দিন গুজরান বা হতাশায় ডুবে হেরে যাওয়ার কোন মানে হয় না। বরং, অবদমিত অবস্থায় থাকা মুক্তির বহুমাত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দেয়ার সময় এটাই। এখন না হলে, আর কখন?
ব্রিজিং ক্যারেক্টারস
বাংলাদেশে মোটের উপর একটা বড় সমস্যা হলো বিবাদরত নানান পক্ষ-বিপক্ষ বর্গগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ব্রিজিং ক্যারেক্টারের অনুপস্থিতি। এমন সব চরিত্র না থাকায় যেসব বিপদ হওয়া সম্ভব তার সবগুলিই আমাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে। ব্রিজিং ক্যারেক্টার কোন ব্যক্তি হতে পারেন অথবা কোন প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। কিন্তু সামাজিক-সামস্টিক পরিসরে এমন চরিত্রের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সারা দুনিয়াতে কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন চরিত্র কমই থাকে। আশংকার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে এমন ন্যূনতম জনগ্রাহ্যতা সম্পন্ন লোকজনের সংখ্যা অনেক কম। সবাই কাঁটায় কাঁটায় নির্দিষ্ট মতাদর্শের নির্দিষ্ট কিছু বয়ানে ঈমান রেখে সমাজে বিদ্যমান থাকতে চান। তবে আরও আশঙ্কার কথা, যারা এমন ব্রিজ তৈরি করার নতুন ভাষা নানান মাধ্যমে তৈরির চেষ্টা করছেন তাদের বেশীরভাগ মানুষ সন্দেহের চোখে দেখেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষ খালি মারামারির ভাষা বোঝেন। নানা কারণে অনেকের মনে কষ্ট-ক্ষোভ থাকা দোষের কিছু না। তবে বিরোধীপক্ষকে পারসু করার ভাষা আয়ত্তে না থাকলে বিপদে পড়তে হবে। সমাজ একটা অনিঃশেষ মারামারির মল্লযুদ্ধে পরিণত হবে। প্রত্যেক সময়ে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন কিছু ব্রিজিং চরিত্র থাকতে হয়। বাংলাদেশেই বরং অতি আবেগের ঠেলায় ব্রিজিং চরিত্রগুলির উদ্যম নষ্ট করে দিতে দেখি। এটা আমাদের কালচারাল প্রবলেম। অস্বীকার করবার কিছু নাই। আর কেউ দাবি করতে পারে না যে তাদের পক্ষ এই রোগে আক্রান্ত নয়। সবাই আক্রান্ত। কেউ বিরোধীপক্ষের ঘরের খবর আন্তরিকতার সাথে, আদব-সহবতের সাথে পর্যালোচনা করেন না। মনে মনে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন। বিরোধীপক্ষের ভাষা আয়ত্তে এনে, তাকেই প্রতিনিয়ত নিজের দিকে পারসু করার আইডিয়াটাই বিকশিত হয় নাই। আছে কেবল বিরোধীপক্ষকে ক্রমাগত আক্রমণ-হেয় করার জজবা। হয়তো বৃহৎ পরিসরে গণতন্ত্র এই কারণেই বিকশিত হতে পারেনি। অথচ গণতন্ত্রের মানেই হচ্ছে, প্রতিনিয়ত বিরোধীপক্ষকে পারসু করা। নিজের দিকে ভজানোর চেষ্টা। একে আবার ‘পপুলিস্ট’ আইডিয়া দিয়ে বুঝা যাবে না। পপুলিজমের যে খণ্ডিত বোঝাপড়া বাংলাদেশের বাজারে চালু আছে সেটা আমার কাছে প্রায় সময়ই কথার কথা মনে হয়। দেমাগ দেখানোর চাবি শব্দ মনে হয়। কারণ নানান বয়ানের মধ্যে, পজিশনের মধ্যে যে বহু জটিল উপাদান গুঁজে দেয়া থাকে, আকাঙ্ক্ষা থাকে, যারা এসব কয়েক স্তরভেদ করে উপলব্ধি করতে পারেন না, শুধু তারাই কিছু একটা পছন্দ না হওয়া মাত্রই ‘পপুলিস্ট’ বলে ফেলেন। এটা দেমাগ-ই বটে। দুঃখজনক হলেও, এটাই আধিপত্যশীল প্রবণতা।
পরস্পর বিরোধী বর্গের মধ্যে যোগাযোগ
প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা আয়োজনে নতুন রাষ্ট্র ব্যাবস্থা, সংস্কার, শিক্ষা, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে নানান সামাজিক-সামস্টিক বালা মুসিবত প্রতিরোধের উদ্যোগ-আয়োজন হচ্ছে পাবলিক পরিসরে। এটা একটা অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। দীর্ঘজীবী মানুষজনেরা অতীত অভিজ্ঞতার সাথে বিষয়টা মিলিয়ে দেখতে পারেন। বেশীরভাগ আলোচনা প্রস্তাবনাই ‘আধুনিক’, আন্তর্জাতিক হয়ে স্থানিক অভিজ্ঞতা, জ্ঞানকান্ড, রীতিনীতি, কল্পনাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। আর আকাঙ্ক্ষাটা পরিষ্কার। অবদমিত অবস্থা থেকে মুক্তি। এই মুক্তির লক্ষ্যটাও দুনিয়াবি। মানুষের আকাঙ্ক্ষা জীবনমানের উন্নতি, সকলের আয়উন্নতি এবং মানবাধিকার। বহুদিন ধরেই রাষ্ট্রীয় পরিসরে এগুলি নিয়ে হয় ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে, গালগল্প করা হয়েছে না হয় প্রায় অচল অবস্থায় ছিল। তবে এখনো মূল আগ্রহের জায়গাটা মোটাদাগে সাংস্কৃতিক বিষয়আশয়ের প্রতি। এটা বহু পুরানা রোগ। তারউপর জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে ইসলাম জুজু। অথচ নানারকমের আতঙ্কের চাষাবাদের মধ্যেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী বলে দেগে দেয়া পক্ষ-বিপক্ষও একই মজলিশে কথা বলছেন। এরমধ্য কিছু আয়োজনে এক্সক্লুসিভলি খেলাফত-শরীয়ার দাবী জানিয়েছেন কেউ কেউ। তাতে কি হলো? তারা কি বাংলদেশের মানুষ না? তারা কি চান, কি ভাবেন বলতে পারবেন না? আমরা না গণতন্ত্র চাই, বাকস্বাধীনতা চাই? শরীয়া-খেলাফত-ইসলাম শুনলেই সর্বব্যাপী কাপাকাপি কান্নাকাটি কেন? বাকিসব আলোচনার খবর বাদ দিয়ে শুধু খেলাফত নিয়ে এত আতঙ্ক কেন? আপনি যা ভাল মনে করেন সেটা নিয়ে কথা বলেন, প্রচার করেন। সেসব আয়োজনে যোগ দেন। কেউ ধরে রেখেছে? বাংলাদেশে অনেকেই তো পুজিবাদের ধংস চান। কিন্তু সেটা কি সম্ভব হয়েছে? তারচে বড় ব্যাপার, যারা খেলাফত চান তাদের সাথে আলোচনার, যোগাযোগের ভাষা বিরোধী পক্ষের কাছে প্রস্তুত নাই কেন? প্রশ্নটা নিজেকে এবং পূর্বসুরীদের করতে হবে। বিরোধীমতের লোকজনের মতাদর্শ আন্তরিকতার সাথে অধ্যয়ন করা, আদবের সাথে তার সাথে সংলাপে লিপ্ত হওয়াই গণতন্ত্রের লক্ষণ। গণতন্ত্র মানেই মেজরিটির হ্যাডম না, গর্মি না। বিরোধী মত অধ্যয়ন করার মানে এই না যে আপনাকে তার মত সাবসক্রাইব করতে হবে। আপনি আপনার মতেই থাকবেন। বরং তাতে আপনি অপরকে অন্তরঙ্গভাবে বুঝতে পারবেন, আপনার মতটা তার বুঝে আনার ভাষাও খুঁজে পাবেন এবং তাকে পার্সুও করতে পারবেন, তাকে ভজিয়ে নিজ দলে টানবার কোশেশও করতে পারবেন। বলাই বাহুল্য, এসব শ্রমসাধ্য কাজ। কান্নাকাটি, খারিজ, মশকরা করা সহজ। তারচে সহজ ঘরে বসে ফেসবুকেই হেরে যাওয়া বা বিরোধীমতকে আয়নাঘরে পাঠানোর বা দমন করার বাসনা মনে পুষে রাখা।
ইসলাম প্রশ্ন
বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং হাল আমলের ‘ওয়ার অন টেররের’ প্রবলপ্রতাপ বয়ানের হাজিরায় একটা অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইসলামকে সঙ্কুচিত করে একাট্টা শত্রুপক্ষ হিসাবে একটা পক্ষ হাজির করতে চায় এবং অন্যদিকে ইসলামিক একটা গোষ্ঠীও ইসলামকে একক অর্থযুক্ত চিন্তাধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অথচ নানান স্থানিক হতে বৈশ্বিক ক্রাইসিস মোকাবেলায় ইসলামিক চিন্তাধারা বিশ্বমানবতার কাজ লাগতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন নতুন অর্থ উৎপাদনের জন্য আন্তরিক চেষ্টা। অন্তত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে, ইসলামিক দর্শনকে ‘দর্শন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামকে বিশ্বমানবতার এজমালি উত্তরাধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠার কাজটা ইসলামিক স্কলার আর এলেমদার মানুষজনকেই করতে হবে। পরিচয়ের দিকে থেকে ‘বিধর্মি’রা সহযোগী শক্তি হিসাবে থাকতে পারে। কিন্তু এটা তাদের কাজই না। ইসলামের ঠেকনায় যে রংবাজি করার চেষ্টা চলছে, তাতে মনে হচ্ছে বিজেপির অল্পকিছু সচেতন সমর্থকের সাথে অচেতন এক বিপুল সংখ্যক মুসলমান সমর্থক বাংলাদেশে আছে। বুঝে বা না বুঝে তারা বিজেপির রাজনীতির রসদই সরবরাহ করে যাচ্ছেন। কাজটা ভাল হচ্ছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় পরিসরে বিদেশী আধিপত্য খর্ব করা কখনো সম্ভব হলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য বাংলাদেশ সব সময়ই প্রাসঙ্গিক থাকবে। বিজেপির রাজনীতি বুঝার এলেম যদি না থাকে তবে সামনে বিপদের সীমা থাকবে না। ‘হিন্দু খাত্রে মে হ্যায়’ এবং ‘ইসলামী জঙ্গিবাদ’ বিজেপির রাজনীতির বড় পলিটিক্যাল কারেন্সি। এই কারেন্সি দেদারসে সরবরাহ করবেন কিনা ভেবে দেখেন। জঙ্গি আক্রান্ত বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য বিজেপিআওয়ামী শক্তিকে পুনর্বাসন করার ন্যারেটিভকে বাস্তবায়ন করার জন্য কেই অজ্ঞানে কাজ করছেন কিনা ভেবে দেখতে হবে। আন্তরিক আর্জি থাকবে, যদি আমরা মনে করি যে ইসলামিক দর্শন বিশ্বমানবতার ‘দর্শন’, এই দর্শনে সকলের হিস্যা আছে, সকল মানুষের উত্তরাধিকার, তবে সেই হিসাবে নতুন ভাষা টোড়ী করা ছাড়া আমাদের পথ নাই। আবুল মনসুর আহমদের কথা চুরি করে বলতে হচ্ছে, এতে করে শিক্ষায়-দীক্ষায় জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, দর্শন-সাহিত্যে, শিল্প-বাণিজ্যে, কলা-কারিগরিতে বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক অগ্রগতির এবং গণমুখী উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করা যাবে (আহমদ ২০১৭, ১১)। সভ্যতাগত পরিচয়কে কেন্দ্র করে যে আলাপ বাজারে চাউর হয়েছে তার বহুমাত্রিক প্রয়োগ এবং সামস্টিক কল্পনা-উদ্যোগের বিস্তার এভাবেই করা সম্ভব।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মানেই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা
ব্যক্তির মহিমা কমিয়ে প্রতিষ্ঠান মানে নিয়ম-কানুনের মহিমা বৃদ্ধি করাটাই এবারের রাষ্ট্র সংস্কারের মূল স্পিরিট। সংস্কার প্রয়োজন, কারণ আমাদের এই সমস্যা আছে। বাংলাদেশে মানুষ কে বলেছে বা কে করেছে আগে সেটা খেয়াল করে, কি বলেছে বা কি করেছে সেটা খেয়াল করে না। মোটের উপর প্রতিষ্ঠান চলে ব্যক্তির ইচ্ছায়। এই প্রবণতার সবচে বড় এমবডিমেন্ট শেখাসিনা। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান চলে ব্যক্তির ইশারায়। অথচ প্রতিষ্ঠান মানেই কায়দা-কানুন। বাংলাদেশে এই বালাই নাই। এটা কালচারও বটে। ব্যক্তি অনেক বড় চালিকা শক্তি, কিন্তু যেকোনো বিচার-বিশ্লেষণে ব্যক্তির মহিমাকে একটু কম করে ফুলিয়ে ধরলেই হয়। তাছাড়া যে যে বৈষয়িক পূর্বশর্তগুলি ব্যক্তিকে তৈরি করে, যাকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে কেজো শব্দের অভাবে ‘সময়’ বলে থাকি, সেসব পূর্বশর্তের দিকে খেয়াল করার রেওয়াজ চালু করতে হবে। একজন আবেগতাড়িত হয়ে আরেকজনকে মহিমা দিতে পারেন। তাতে করে ভাইরাল আচরণ করবার কিছু নাই। ব্যক্তি তার ন্যায্য মহিমা কিছুটা পেতেই পারে তবে সময় বা বৈষয়িক পূর্বশর্তের বিষয়গুলিকে বেশী উচ্চকিত করলেই বিষয়টা সামলে চলা যায়। তাছাড়া, একটা সমাজে আমরা ব্যক্তিকে নিয়ে উদযাপন করতে পারি, ব্যক্তিকে উচ্চকিত করতে পারি, তবে বুঝের মধ্যে থাকতে হবে যে উদ্দেশ্যটা হচ্ছে কোন একজন ব্যক্তিকে উচ্চকিত করে আরও বহু একই ধাঁচের ব্যক্তি তৈয়ারির রাস্তা প্রশস্ত করা। বহু মানুষকে উজ্জীবিত করা। তাই ভাষাটা সেই হিসাবে প্রস্তুত করলেই হলো। এগুলি বুঝের মধ্যে থাকলে ভাল। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বহু হাবিজাবি বিতর্ক সামনে চলে আশায় এই ব্যাপারগুলি পাবলিক পরিসরে এবং ইমাজিনেশনে রাখা আরও জরুরী হয়ে গেছে বলে মনে করি।
সহায়কপঞ্জি
আবুল মনসুর আহমদ ২০১৭, বাংলাদেশের কালচার, নবম সংস্করণ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা
3 comments
Zaman Masiuz
Really, it’s a good piece of liberal but valuable thought.
M A Palash
Tremendous writing. Your writhing is as powerful as your artwork. Enjoyed the whole thing. You have established a beautiful bridge with your motherland. July changes was necessary and we should use it in a positive way.
Thanks for your contribution through artwork and text…
Arif Ahmed
একটা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ আদর্শ দেশ গড়তেই হবে, ইনশাআল্লাহ।