প্রথম পর্ব
📎 কেন সংবিধান পরিবর্তন দরকার
‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে, বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি’—
: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪-৭
এই লেখার দুইটা পর্ব। এক. কেন সংবিধান পরিবর্তন দরকার। এইটা ভূমিকা এবং কিছুটা দীর্ঘ। দুই. আফটারফ্যাসিস্ট পলিটিক্যাল মেনিফেস্টো। এখানে কীভাবে পরিবর্তনটি হবে, তার ধাপ এবং কেমন সংবিধান চাই, পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট পরবর্তি রাষ্ট্রগঠনের রূপকল্প নিয়ে আলাপ করেছি। ফ্যাসিস্টের পতনের পর আমাদের রাষ্ট্রগঠনের রূপকল্প কী হবে, তার জন্য আমার প্রস্তাবিত ‘আফটারফ্যাসিস্ট পলিটিক্যাল মেনিফেস্টো’ আকারে লিখছিলাম এই লেখা। যদিও অনুমান করি, এত এত আলেম ও সাধুসঙ্গের ভেতরে আমার এই প্রস্তাব তেমনভাবে গুরুত্ব পাবে না। তবে, ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট হিশেবে এই আলাপ থাকুক।
এই প্রস্তাবের প্রথম ড্রাফট আমি প্রকাশ করেছিলাম, অভ্যুত্থানপরবর্তি আগস্ট দুই হাজার চব্বিশের শেষদিকে, আমার সোশাল হ্যান্ডেল-এ। পরে, এইটাতে বিভিন্ন সময়ে সংযোজন ও এডিট করা হইছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি ছোট বড় সেমিনারে পড়েছি এই লেখা। কেন সংবিধান পরিবর্তন দরকার, এই অংশটা আমার সেই প্রস্তাবের ভূমিকা বা ফুটনোট, নতুন সংবিধান নিয়ে সেমিনারগুলোতে কথা বলতে গিয়ে ও পাঠকদের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিতে নিতে যুক্ত করা দরকার মনে হল। যারা অধৈর্য হবেন, তারা পরের পর্ব, অর্থাৎ আফটারফেসিস্ট মেনিফেস্টো থেকে পড়া শুরু করতে পারেন।
শুরুতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের এই অংশটুক কোট করার উদ্দেশ্য হল, ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, ইতিহাসের ঠিক কোন মুহূর্তে, কীভাবে আমরা রাষ্ট্রের উপর নিজেদের মালিকানা ঘোষণা করা জরুরি মনে করলাম, এবং কেন। কেননা, আমি এই মালিকানা দাবি করতে পারার যে ঘটনা, তারে একটি জনগোষ্ঠির দার্শনিক মুহূর্ত হিশেবে পড়ি, এবং সেই মুহূর্তের সাথেই রাষ্ট্রগঠন, গণঅভ্যুত্থান ও নতুন সংবিধানের দরকারের এবং সম্পর্কের আলাপ তুলছি এখানে।
আসুন, সংক্ষিপ্তভাবে ইতিহাসের সেই উপরি খোলসটারে পড়ি আগে। হুসেনশাহীর বাংলা, ব্রিটিশ উপনিবেশ, তিতুমিরের আন্দোলন, আর আমাদের পূর্বপুরুষদের ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানে’র পরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা চালায়। এর আগ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কেবল তিনটি পরিচিত রাজনৈতিক ফেনোমেনন ছিল। আওয়ামীলীগের ছয় দফা, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা এবং গণপরিষদ নির্বাচন। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি তেমন কইরা ছিল না।
এই গণপরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংবিধানের যে খসড়া প্রস্তাব করেছিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, তার একটা ধারণা নেওয়া যায় এখানে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সেই খসড়া সংবিধান শুরু হয়েছিল ‘পরম করুণাময় আল্লাহর নাম’ দিয়ে।[1] পাকিস্তানের মুসলমানদেরকে তাদের জীবন ‘কোরআন এবং সুন্নাহতে বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ী চালিত করার অধিকার’ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল।[2] তৃতীয় অধ্যায়ে ‘Directive Principles of State Policy’ হিশেবে কয়েকটি মূলনীতির উল্লেখ করা হয়েছিল, এর ইসলাম অংশটা পইড়া বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির কথা মনে পড়বে। তবে, মজার ব্যাপার হল, বাহাত্তরের সংবিধানে আইসা মূলনীতিগুলো পুরো উলটে যাওয়া। যেমন, প্রথম মূলনীতি হল, ‘কোরআন ও রসুলের সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করা হবে না’।[3] তবে, এই যে ‘কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী আইন’ না করা— এই মূলনীতির উপরে সওয়ার হওয়ার ঘটনা, এর পরেও মাঝে মধ্যে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন বিপদমুহূর্তে দেখা গেছে, যেমন স্বাধীনতার বহু বছর পরও আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সাথে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের চুক্তিতে। এর পরের মূলনীতি হল, ‘পাকিস্তানের মুসলমানদের পবিত্র কুরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে’।[4] তৃতীয় মূলনীতি হল, পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে ‘ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো হবে’।[5] অবশ্যই, এর পরে, অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের অধিকার, শোষণমুক্ত সমাজ অর্জনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা, যা বাহাত্তরের সংবিধানের সমাজতন্ত্রের সাথে মিল আছে কিছুটা, আর কৃষক ও শ্রমিকের অধিকারের কথাও বলা হইছে।[6] এই সাংবিধানিক খসড়া, মানে নির্বাচনি মেনিফেস্টোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের জনগন সত্তর সালে পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছিল।
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে, ইয়াহিয়া খান মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করলেন। সেই সময়টাতেই এর প্রতিবাদে রাজনৈতিক সভা সমাবেশগুলোতে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি হঠাৎ হঠাৎ উচ্চারিত হওয়া শুরু হল।
পরে ২৫ মার্চের গণহত্যার পরে ছয় দফা এবং গণপরিষদ ফেনোমেনন পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে ‘স্বাধীনতা’ উচ্চারিত হল এবং মেজর জিয়াসহ বাঙালি সেনা অফিসারেররা বিদ্রোহের ডাক দিলেন এবং জিয়া কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করে, নিজের নামে এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যদিও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করেন অই রাতেই। গ্রেফতারের আগেই ইপিআর বার্তার মাধ্যমে মুজিব নিজে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলেও তথ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন মাধ্যমে।
এই বিদ্রোহের সময়েই তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ এর নেতৃত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায়, পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এদিনই ২৬ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ইপিআর বার্তার মাধ্যমে’ দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং একই সাথে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণাপত্র, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানিক দলিলও।
মোটামুটি এই হল বাহ্য। আমরা সেই বাহ্যরেই, আরো একটু তার ভাষা ও বিভঙ্গের ভেতর থেকে পড়ি আবার, আসেন। এই ঘোষণাতেই বলা হইতেছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে’; তার অংশ হিশেবেই ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে’ বাংলাদেশকে একটি ‘সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ করা হইতেছে এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে ‘শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা’ অনুমোদন করা হইতেছে জনগনের পক্ষ থেকে। মানে, এই ধরনের একটি ঘোষণার আগে, প্রথমত এই ঘোষণার জন্য কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, মানে লেজিটিমেসি তৈরীর ব্যাপার আছে। যে লেজিটিমেসি বাংলাদেশের জনগন প্রতিষ্ঠা করেছে বইলা জানানো হইতেছে এই ঘোষণায়। কীভাবে তা তৈরী হল? বইপত্রের তত্ত্বকথা নয়, আমরা কীভাবে সেই লেজিটিমেসি ঘোষণা করলাম, সেই ঘোষণাপত্রের মধ্য থিকাই পড়ি, আসেন। বলা হইতেছে, ‘তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে’। একাত্তরের এপ্রিলে এই ঘোষণা দেওয়া হইতেছে, এর ভেতরেই গণহত্যা আর তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগনের মধ্য থেকে ‘বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে’ জনপ্রতিরোধ, মানে মুক্তির যুদ্ধ শুরু হইছে। এই শুরু হওয়ার মানে হল, রাষ্ট্রের দাবীর উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্যই, বদরুদ্দিন উমর একাত্তরের ঘটনারেও গণঅভ্যুত্থানই কইতেছেন, অভ্যুত্থান পূর্ববর্তি বণিকবার্তার সাক্ষাৎকারে পড়লাম। [7]
তো, চব্বিশে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে প্রথমে আপনার গোষ্ঠিস্বার্থের আন্দোলন মনে হইলেও, পরে এই আন্দোলনের যে রাজনৈতিক পরিণতি, সবার হয়ে ওঠতে পারল ও ফ্যাসিস্টের পতনে ভূমিকা রাখতে পারল, চব্বিশের এই ঘটনারে ইতিহাসের সেই ছয় দফা থেকে ‘মুক্তির আন্দোলনে’ রূপান্তরের ঘটনার সাথে মিলিয়ে পড়তে পারেন কি? আমি একটা দৃশ্যকল্প দিই। তাহলে হয়তো কিছুটা পড়তে পারবেন।
ছয় দফা ও নির্বাচন = বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও কোটা সংস্কার। শেখ হাসিনা কর্তৃক আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকার সম্বোধন = ইয়াহিয়া খানের গড়িমসি ও তাচ্ছিল্য। ২৫ মার্চ = ১৫ জুলাই। এইদিন সারাদেশে একযোগে হামলা ও গণহত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, পূর্বপাকিস্তানে যেমন শুরু হইছিল। পূর্বপাকিস্তানে জিয়া প্রমুখ সৈনিক যেমন প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেন, এখানেও একই সাথে ছাত্রদের নেতৃত্বে পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হয়। ২৬ মার্চ = ৩ আগস্ট। একাত্তরে বেতারে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রথমে নিজের নামে, পরে মুজিবের নামে। এখানেও ছাত্ররা এক দফার ঘোষণা দেন এবং পতন পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। ৫ আগস্ট = ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়। ফলে, এই জায়গা থেকে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মুহূর্তটিরে পড়তে পারেন।
২.
এই আলাপের প্রথম কেন্দ্র সংবিধান। সংবিধান নিয়া আলাপ আইনের লোকেরাই করবেন, এরকম একটা প্রিজাম্পশন সমাজে চালু আছে। এইটারে আমি সমস্যাজনক মনে করেছি এবং প্রশ্ন করতে চেয়েছি সব সময়। তো, এক বন্ধুরে যখন আমার এই কী-নোটরে কেন্দ্র কইরা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবিধান নিয়ে কথা বলতে আমন্ত্রণ জানালাম, যিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ান, উনি প্রথমেই আঁতকে কইলেন, আমি কীভাবে সংবিধান নিয়া বলবো? আমি কি আইনের মানুষ? তো, আমি কইলাম, সংবিধান কি আইনের মানুষের জন্য বানানো? উনি কইলেন, না, তা তো না। কইলাম, এইটা কি আইনের কিতাব বইলা মনে করেন আপনি? উনি চুপ থাকলেন। আমি প্রশ্ন করতে থাকলাম, নাকি আমাদের রাষ্ট্র-গঠনের দলিল আকারে তৈরী করি? যদি রাষ্ট্রগঠনের দলিল আকারেই তৈরী হইছে মনে করেন, তাহলে এইটারে উকিল মোক্তারদের বিষয়ে পরিণত করার মানে হল, আর একটা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হাতে আপনার কল্পিত ধর্মগ্রন্থ তুলে দেওয়া। যেটি আপনি ছুঁতে পারবেন না, বা ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। এতদিন ধইরা এটাই করা হইছে। ফলে, তা যদি আর না চান, রাষ্ট্র গঠন নিয়া ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক কী ভাবছেন, কৃষক কী ভাবছেন, বা শ্রমিক, মাদ্রাসার হুজুর, তারে লইয়া বলতে আসেন। ফলে উনি আসছিলেন এবং সংবিধান নিয়া উনার আকাঙ্ক্ষার কথা বলছিলেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এইটা বলে নিলাম এজন্য যে, আমার আলাপরে যাতে আপনারা আইনের বা বিশেষজ্ঞের আলাপ ঠাউরে বিবেচনা করতে না আসেন। আমি সেই অর্থে আইনের লোকও না, কাকতালীয়ভাবে যদিও আমি এই ডিসিপ্লিনের ছাত্র। ‘আইন’ নয়, আইনের চরিত্র বা দর্শন নিয়ে আলাপ হতে পারে সর্বোচ্চ। কারণ, পলিটিক্যাল ফিলসফি, মানে কিছুটা দর্শন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এরিয়া নিয়াই আমার তর্ক ও কাজের পরিধি। যদিও দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকরাও আমার সেই এলাকারে রহিত করতে চাইবেন। শিক্ষকরা সীমিত করতে থাকুন, সমস্যা নেই। শিক্ষকদের কাজই এই।
বরং আমরা একটা আইডিয়া, রাষ্ট্রদার্শনিক তর্কের কথা বলছি। সেটি হল, চব্বিশের জন-অভ্যুত্থানের পরে আমাদের নতুন রাষ্ট্রের যে দর্শনগত জায়গা, তা এর আগের দর্শনগত জায়গার সাথে এক না। একাত্তরের ২৫ মার্চের আগের পূর্ব পাকিস্তান আর পরের পূর্ব পাকিস্তান যেমন এক না, চব্বিশের যে জেনোসাইড, তার আগের এবং পরের বাংলাদেশও এক না। ফলে, আমরা যে একটা নতুন সংবিধানের জরুরতের কথা বলছি, পুরাতন সংবিধান-সংশোধনি ধরনের পরিবর্তন আমাদের নতুন রাষ্ট্রগঠনে কোন ভূমিকা রাখতে সক্ষম না বলছি, তারে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এই জায়গায় দাঁড়িয়েই। মানে, আমাদের এই নতুন সংবিধান তর্ক, এইটা কোনভাবেই আইন প্রশ্ন না।
আর যদি আইন প্রশ্ন না হয়, তাহলে সংবিধান ব্যাপারটা মূলত কিসের প্রশ্ন? চট্টগ্রামে এক প্রবীণ প্রফেসর সংবিধান নিয়া এক দীর্ঘ আড্ডা শেষে, আমারে ডাইকা হঠাৎ এই প্রশ্নটিই জিগেশ করলেন, আচ্ছা রিফাত, আপনাদের আপত্তিটা ঠিক সংবিধানের কোন জাগায়? অধ্যাপক সাহেবের উত্তরে আমি কইলাম, আমাদের আপত্তি স্রেফ সংবিধানের কোনো জাগায় না। উনি কইলেন, তাহলে পরিবর্তন চান কেন? আমি বললাম, এইটা আপনাদেরকে বুঝাইতে বড় আয়োজন করতে হবে। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে তো হবে না। বরং আপনারা আমাদের কথা শোনার প্রোগ্রাম করেন একদিন। সারা জীবন তো আপনাদের কথা আমাদেরকে শোনানো হইছে, টেলিভিশনে, ইতিহাসে, সবখানে। প্রবীন প্রফেসর মঈনুল ইসলাম সাহেব আর উনি মূল আলোচক ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। উনি, এবং উনারা আমার কথা শুনে হাসলেন। কারণ, আমরা উভয়েই জানি, আমাদের সেই সময় কখনোই আসবে না। উনাদের সময় হবে না। বরং, অই অনুষ্ঠানে প্রফেসর ইসলাম বলতেছিলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে হাত দেওয়ার চিন্তা করলে এইটা উনারা ‘সহ্য করবেন না’। উত্তরে উনার মন্তব্যরে আমার প্রতি ‘হুমকি’ হিশেবে অবজার্ভ করলাম আমি, কেননা আমি নতুন সংবিধান জরুরি মনে করি এবং কেন আমি পরিবর্তন চাই, তা ব্যাখ্যা করলাম। মঈনুল ইসলাম সাহেব পরে বক্তৃতায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে জানালেন, উনারা স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন, সেজন্য একাত্তর নিয়া উনাদের আবেগ বেশি, অথচ, জানালেন, ২০১২ সালে উনিই প্রথম হাসিনাকে নির্বাচিত একনায়ক বলেছেন। হাহা, এই যে উনি একনায়করে কোন না কোন সময় অল্পের জন্য হলেও চিনেছেন, এইটা গুরুত্বপূর্ণ বটে। অবশ্যই, পরে, মঈনুল ইসলাম সাহেব যে শেখ হাসিনার সময়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত, এইটাও নোক্তায় রেখেছি, উনার ‘সহ্য’ সমস্যারে পড়ার জন্য।
৩.
এলা আরো সহজতর আলাপে আসি। সংবিধানরে আমি একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির দার্শনিক মুহূর্তের ঘটনা বলি। আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রসাধনাও তাই। ফলে, আমাদের যে একটা নতুন সংবিধান লাগবে, এইটা কোন আইনি আলাপ নয়, রাষ্ট্রদার্শনিক আলাপ। এই আলাপের মূল বিন্দু হল, রাষ্ট্রে জনগনের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেই নতুন সংবিধান তৈরীর দরকার পড়ে। কারণ, সংবিধান হল রাষ্ট্রের উপরে জনগনের মালিকানা ও সার্বভৌমত্বের রাষ্ট্রদার্শনিক দলিল, একই সাথে চুক্তিও।
কিন্তু একাত্তরে বিজয়ের পরপর দুইটি ঘটনা ঘটল। এক. তৎকালীন পাকিস্তানের কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়াই নতুন বাংলাদেশের জন্য পূর্ণাঙ্গ সংবিধান এডপ্ট করা হল। দুই. এই এডপ্টশেনের প্রসেসে স্বাধীন বাংলাদেশের কোন সংবিধান সভা আহ্বান, এমন কি ড্রাফ্ট পরবর্তি রেফারেন্ডামেরও উদ্যোগ নেওয়া হয় নাই। ফলে সেই সংবিধানে জনইচ্ছার প্রতিফলন যাচাই করা হয় নাই। এবং, আমরা দেখি যে, এই সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উপর জনগনের মালিকানাও প্রতিষ্ঠা হয় নাই। বরং গণপরিষদ নির্বাচন পূববর্তি পাকিস্তান আওয়ামীলীগের যে সাংবিধানিক ইশতেহার বা খসড়া, পরে ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা, এবং বৈদ্যনাথতলার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও তার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের যে স্পিরিট, তার কোনটাই রক্ষা করা হয় নাই এই নতুন সংবিধানে।
ফলে, দেশ গঠনের পর পর একটা বিভাজনের রাষ্ট্রে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের নাগরিকদেরকে ভাগ করা হল ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’, স্বাধীনতার ‘পক্ষ’ এবং ‘বিপক্ষ’ শক্তি দিয়ে। এবং তার অল্প দিনের মধ্যেই একদলীয় ফ্যাসিস্ট শাসনেও ঢুকতে হইছিল আমাদের, এই সংবিধান প্রণেতার হাতেই, যা এই সংবিধান থামাতে পারে নাই। এই সংবিধান মুজিবের আওয়ামীলীগকেও বাঁচাতে পারে নাই। স্রেফ একটা সংশোধনী কইরা, বাকশাল কায়েম কইরা নিজের পার্টি সহ রিজলভ করতে হইছিল মুজিবকে, নিজের ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত করার প্রয়োজনে। এবং, এর পরেও ইতিহাসে বারবার নানান চেহারায় আমাদের উপরে কখনো ফ্যাসিস্ট, কখনো স্বৈরাচারি শাসন ফিরে এসেছে, এই সংবিধানের পুলসিরাতে ভর কইরা। ষোল বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন, গুম খুন, সংবিধানের মুজিবাইজেশন এবং পরে হাসিনাইজেশন এর কারিগর এই সংবিধান। সর্বশেষ, এই পঞ্চাশোর্ধ বছর বয়সি সংবিধান, জুলাইয়ের জেনোসাইডের দিনে ছাত্র ও নাগরিকদের জীবনের রক্ষাকবচ হিশেবে ফ্যাসিস্টের বন্দুকের বিরুদ্ধে নৈতিক ক্ষমতা আকারে দাঁড়াতে পারে নাই। ফলে, জুলাইয়ের অভ্যুত্থান সংবিধানের এই না দাঁড়াতে পারার, অক্ষমতার, জনগনের পক্ষে এথিক্যাল অথরিটি হিশেবে থাকতে না পারার বিরুদ্ধেও ছিল, যা অনেকেই পড়তে পারছেন না, বা পড়ার জন্য তৈরী না।
আমি বলি, পড়ার চেষ্টা করুন। কারণ, পরে সময় আর পাবেন না। কারণ, সংবিধান হল মূলতই একটি জনগোষ্ঠির এথিক্যাল অথরিটির প্রশ্ন, আইনের প্রশ্ন না। এবং আমরা যে নতুন সংবিধানের কথা বলছি, তা হল পুরনো সংবিধান যে আমাদের এথিক্যাল অথরিটি হয়ে উঠতে পারল না, এই ব্যর্থতার কারণে। যে কারণে একটা ভাল, কিন্তু অপদার্থ শাসকের পতন হওয়ার দরকার, সে কারণে একটা অপদার্থ সংবিধানেরও রিপ্লেসমেন্ট হওয়া দরকার। আমাদের যে একটা নতুন পিউপলস উইল, জন আকাঙ্ক্ষা তৈরী হল, যা জনঅভ্যুত্থানে দেখা গেছে, এই অভ্যুত্থানের ভেতরে থেকেই নতুন সংবিধান দরকার। এবং এইটা জনগনকেই করতে হবে।
যেহেতু জুলাই জন-অভ্যুত্থান ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই, ছাত্রদের জীবন বিসর্জন ও ফ্যাসিস্টের পতনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উপর নাগরিকদের যে মালিকানার দাবি, তা নতুন করে প্রত্যার্পন করেছে, এই প্রত্যার্পনের ফলে, রাষ্ট্রের নয়া মালিকানা রিক্লেইম করার মুহূর্ত এসেছে আবার। এইটা একটা রাষ্ট্রের সেই দার্শনিক মুহূর্ত। এই দার্শনিক মুহূর্তের নয়া মালিকানা রিক্লেইম করার জন্যই, নতুন সংবিধান, মানে সেই মালিকানার দলিল প্রণয়ন জরুরি সবার আগে। যার ভিত্তি হবে সেই শুরুর বিন্দু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। আর স্পিরিট হবে ১৯৭১ সালের গণমুক্তিযুদ্ধ এবং দুই হাজার চব্বিশের জনঅভ্যুত্থান।
আরো একটা নোক্তা। সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলা হচ্ছে। এইটা বেশ আজগুবি ব্যাপার। সংবিধান কোন লেখার পুস্তক না। ফলে পুনর্লিখন না, সংবিধান নতুনভাবে এডপ্ট করার ব্যাপার আছে। এডপ্টেশনের সাথে প্রতিনিধিত্ব জড়িত, যা স্রেফ একজন বুদ্ধিজীবী বা জ্ঞানী ব্যক্তির লেখার কারণে লেজিটিমেসি পায় না। পায়, জনগনের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে। তাই আমি প্রস্তাবে অভিভাবক কাউন্সিল গঠনের কথা বলছি।
৪.
এথিক্যাল অথরিটি যে হারাল, আসুন, তার আরো কিছু ইন্টারেস্টিং চিহ্ণ খেয়াল করি। তাহলে বুঝতে পারবেন, এই সংবিধান আদৌ কখনো আমাদের, বা আপনার ছিল কিনা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতনের পরে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় পত্রিকা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে ভারতকে অনুরোধ করে বলেন, ভারতই যাতে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান সমুন্নত রাখে।[8] সজিব ওয়াজেদ জয়ের এই খুল্লমখোলা আহ্বানরে ছোট মানুষের খেলা মনে করা উচিত না। কারণ, জয় হলেন, এই সংবিধান যার নেতৃত্বে তৈরী হইছিল, তার ‘পবিত্র’ রক্ত ধারণ করেন। বরং, এভাবেই পড়া ভাল, জয়ের সম্ভবত এরকম ধারণাই পোক্ত আছে, যে, এই সংবিধান অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব দিল্লীরই। কারণ, সমালোচকদের মত জয়ও হয়ত মনে করেন, এই সংবিধানে সবচাইতে বেশি সংরক্ষিত হয় দিল্লীর স্বার্থ। বাংলাদেশের জনগনের না।
কেন? একটা উদাহরণ দিই। ৭২ এর যে সংবিধান, তাতে আপনার ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র মত অসাধারণ একটা ব্যাপারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার উপরে ‘বার’ তৈরী করে শর্ত দেওয়া হয়েছে বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্করে। মানে, প্রথম সংবিধান লেখার দিনই আমাকে মনে রাখতে হইছে, আমাদের চারপাশে যে ভারত নামের রাষ্ট্র, তার নিরাপত্তা ও ‘বন্ধুত্ব’ প্রশ্ন আগে। একই সাথে চার মূলনীতির মধ্যে চরমভাবে সাম্প্রদায়িক ও হিন্দুত্ববাদি বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সেকুলারিজম রাখা হইছে এই ভারতরে নির্ভার ও ভারতীয় আধিপত্যরে প্রশ্নহীন রাখার জন্য। এই চার মূলনীতি নিয়া সেই সময় আওয়ামীলীগের ভেতরেও, যেমন, আবুল মনসুর আহমদের আপত্তিগুলোও আমরা পড়েছি।[9]
বাঙালি জাতীয়তাবাদরে আমি পড়ি হল, ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের নিরাপত্তা ভাবনা ও স্পর্শকাতর রাজ্যগুলোতে তাদের আধিপত্যের যে রাজনীতি, তার সাথে সামরিক ও কৌশলগত সখ্যতার রাজনীতি দিয়ে। ফলে, সংবিধানের এই ক্লজরে কিছুটা বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে প্রতিবেশি ভারতীয় কনফেডারেশ আর ক্ষুদ্র প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর উপরে রাষ্ট্র ভারতের ডোমিনেন্সির আইডিওলজি সরবরাহের ক্লজ হিশেবে পড়া সম্ভব। রাষ্ট্রচিন্তায় বন্ধু তো একটা আজগুবি ধারণাই। ফলে, জয় হয়ত ঠিকই বলেছিলেন, এই সংবিধানের অক্ষুণ্ণ রাখার ভার ভারতেরই নেওয়া উচিত, যা তেমন কইরা আমাদের কিছু ছিল না কখনোই।
আর একটা গল্প, এইটা ইতিহাসের। এই সংবিধান ড্রাফট কমিটি ও ‘অনুবাদে’র সঙ্গে সেই সময়কার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার প্রফেসর আনিসুজ্জামান জড়িত ছিলেন। ৭২ এ সংবিধান এডপ্টেশনের পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয় লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সরকার গঠন করে। এই নির্বাচনের ব্যাপারে প্রচুর কারচুপির অভিযোগ করা হয়। দেখা গেল, আনিসুজ্জামানও যখন ভোট দিতে গেলেন, উনারেও বলা হল, উনাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।[10] ভাবতে পারেন, এইটা সংবিধান এডপ্টেশনের পরমুহূর্তের ঘটনা, আর, সংবিধান ড্রাফ্ট কমিটির সদস্য আনিসুজ্জামান আত্মজীবনীতে এই গল্প লিখছেন। এখন, এই সংবিধান যে উনারে তখনও ভোটের অধিকার দিতে সক্ষম হয় নাই, কখনোই না, এইটা নিয়ে উনার কখনো আত্মগ্লানি তৈরী হয় নাই? আমি দেখেছি, হয় নাই। এই ছোট ব্যক্তিগত বঞ্চনা ছাড়া আর কোন অভিযোগ উনার ছিল না। উনি বরং স্মৃতিকথা রচনায় ব্যস্ত ছিলেন। আমি যেহেতু স্মৃতিকথার থেকে বেরুনোরে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, আমি এই ঘটনায় সবচেয়ে জরুরি যে ঘটনাটি দেখি এবং পড়ি, তা হল, আনিসুজ্জামানদের রচিত সংবিধান নাগরিকদের এথিক্যাল অথরিটি হইতে এডপশনের পরমুহূর্তেই ব্যর্থ হইছে।
বরং, পবিত্রতাবাদীরা এই সত্যরে লুকান যে, এই সংবিধানই ক্ষমতার এককেন্দ্রিকরণ সম্ভব করেছে। মুজিবাইজেশন অব কন্সটিটিউশন, এবং পরে হাসিনাইজেশন সম্ভব করেছে, যার সংশোধন নিয়া চিন্তা করলেও আপনার মৃত্যুদণ্ড হওয়া সম্ভব। ১৫৩ টি অনুচ্ছেদের প্রায় এক তৃতীয়াংশই এটারনিটি ক্লজ করা হইছিল, অথচ একটা সংবিধানে এরকম এটারনিটি ক্লজ উইদাউট মেন্ডেট একটা দলীয় সরকার দিতেই পারে না।
মানে, এই সংবিধানের ভেতরে থাইকা বাকশাল সম্ভব হলে, বা ‘রাতের ভোট’, ১৬ বছরের একনায়কতন্ত্র, নজিরবিহীন গুম খুন, ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা বা পঞ্চদশ সংশোধনী, মানে আপাদমস্তক হাসিনাইজেশন সম্ভব হলে, এখন ছাত্ররা বা আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলছি, তাও হয়ত সহজেই সম্ভব। কারণ, ক্ষমতার পরিবর্তনে সবই সম্ভব। শুধু সেই নায্যতা উৎপাদন সম্ভব না, ফ্যাসিস্টের পতনে ছাত্রদের আন্দোলন ও আত্মাহুতির ফলে এখন যে নায্য ক্ষমতা তৈরী হয়েছে বইলা আমরা দাবী করছি। সেই নায্য ক্ষমতার সদ্ব্যবহার না কইরা স্রেফ বাকশালের মতই, কলমের খোঁচায় পুরো সংবিধানের চরিত্র পরিবর্তনকারী বা পঞ্চম সংশোধনীর মতই, আর এক কলমের খোঁচায় তারে সংশোধন কইরা নিলে, তা ক্ষণস্থায়ী হবে। উভয় পরিবর্তনই তো রিভার্সেবল, বাকশালের মতই, বা পঞ্চম সংশোধনীর মতই। এই ঠুনকো, ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তনই কি অভ্যুত্থানে জীবন দেওয়া ছাত্রদের লক্ষ্য ছিল?
বরং আপনারা যে এই সংবিধান বাতিল কইরা নতুন সংবিধান তৈরীর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনারে পাশ কাটাতে চাইতেছেন, তার কারণ হল তিনটি। এক. আপনি গণঅভ্যুত্থানের এই দার্শনিক মুহূর্তটি ধরতে পারছেন না। দুই. ভয় পাইতেছেন। আমরা তো মাত্রই একটা ভয়ের রিপাবলিক থেকে বের হলাম। এখনো ভয় চারপাশে ওঁত পেতে আছে। তিন. আপনি পুরনো ব্যবস্থার সুবিধাভোগি, ফলে জিঁইয়ে রাখার পক্ষে।
দ্বিতীয় পর্ব
📎 আফটারফ্যাসিস্ট পলিটিক্যাল মেনিফেস্টো
প্রথমত, লক্ষ্য। আমি মনে করি, বিপ্লব নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সাধনা আমাদের। ফলে, ফ্যাসিস্টের পতনকে জন-অভ্যুত্থান হিশেবেই পড়ছি। এবং এই সরকাররে অন্তর্বর্তি সরকার। কেউ কেউ প্রতিবিপ্লব রুখার কথা বলছে। বিপ্লবকে ডিফাইন করার আগে প্রতিবিপ্লবও একটা কল্পনাই। ফলে, আমি বলি কি, প্রতিবিপ্লব নিয়া হাহুতাশ করার আগে, আপনার ‘বিপ্লব’ কী, সেটি ডিফাইন করুন। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ সেইটা। আমার মতে, তার জন্য, নতুন সরকারকে ‘ইন্টারিম’ চরিত্র থেকে, জাতীয় এবং অভ্যুত্থানের সরকারে রূপান্তরিত করতে হবে।
ফলে, এই মুহূর্তে আমাদের ভাবনার বিষয় চারটি।
এক. জাতীয় এবং অভ্যুত্থানের সরকারে রূপান্তর, পরিধি এবং টাইমলাইন নির্ণয়।
অভ্যুত্থানের প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য, অন্তর্বর্তি সরকারকে ‘জাতীয় ও অভ্যুত্থানের সরকার’-এ রূপান্তর হল পরিবর্তনের প্রথম জরুরি ধাপ। অন্তবর্তি সরকারকে জাতীয় এবং অভ্যুত্থানের সরকারে রূপান্তরিত করার লক্ষে, সরকারের স্কোপ এবং টাইমলাইন নির্ণয় করতে হবে সবার আগে। আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কী সংস্কার করতে চাই। এবং কোন স্কোপের ভেতরে করতে চাই। আমার মতে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, অভ্যুত্থানের বিপ্লবী দলিল তৈরী, সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিল গঠন এবং সবশেষে নতুন সংবিধান প্রণয়ন।
১. অভ্যুত্থানের বিপ্লবী দলিল
এর জন্য, প্রাথমিকভাবে, জন অভ্যুত্থান ও দীর্ঘদিন ধরে চলা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পক্ষগুলোর একটা সমন্বিত কনসেন্ট ও বিপ্লবী দলিল তৈরি হতে হবে। যে দলিলে আমাদের সামাজিক চুক্তি আর গণঅভ্যুত্থানে আমাদের যে নতুন ন্যাশনাল হোপ তৈরী হইছে, তা ডিফাইন হবে, এবং জনঅভুত্থানের সর্বদলীয় রূপরেখা হবে এটি। এই সর্বদলীয় রূপরেখা ও সামাজিক চুক্তি কেউ লঙ্ঘন করবে না। এই চুক্তির ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান তৈরীর দিকে অগ্রসর হবে দেশ। এবং নতুন সংবিধানে এই চুক্তিরে মূল ভেল্যু হিশেবে সংযুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যেভাবে আমাদের বিদ্যমান সংবিধানের অংশ হিশেবে সংযুক্ত হয়েছে।
এই দলিল যে হল না, তারে নিয়া ভাবতে গিয়ে খেয়াল করলাম, না মুহাম্মদ ইউনুস, যিনি অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ও সব দলগুলোর জন্য এই সরকারের পছন্দের নেতা, না এতদিন ধইরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনরত দলগুলো, যেমন বিএনপি, এদের কারোই কোন হোমওয়ার্ক, মানে প্রস্তুতি দেখা গেছে এই অভ্যুত্থানের আগে ও পরে। এইটা ছাত্রদের বাইরে, এই অভ্যুত্থানের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার ও পছন্দের নেতাদের সবচাইতে দুর্বলতার দিক।
তাদের কাছে এই জনঅভ্যুত্থান একটি হঠাৎ চইলা আসা অতিথির মতো, ওরা শুধু ‘ঝামেলার যতটুকু দিক আছে’, বোঝার, তার চাইতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এই লেখা প্রকাশের মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন কি, মুহাম্মদ ইউনুসও। ফলে, ক্ষমতা গ্রহণের দীর্ঘদিন পরও ইউনুসের বক্তব্য অস্পষ্ট। পাশাপাশি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত দলগুলোর হোমওয়ার্ক থাকলে, সব বিরোধী দল মিলে একটা সমন্বিত প্রস্তাবনা দিতে সক্ষম হত। যেইটা অভ্যুত্থানের সরকারের জন্য একটা গাইডেন্স হিশেবে কাজ করত। মুহাম্মদ ইউনুসকেও, আরো স্পষ্ট পাওয়া যাইত।
আমার প্রস্তাব, এই কাজটা দ্রুত করতে হবে।
২. সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিল
এই দলিল তৈরীর জন্য জনঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্ব এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াইরত দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটা সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিল গঠন করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবের পর এই অভিভাবক কাউন্সিলের নজির আছে। ছাত্রদের যে লিয়াজোঁ কমিটি আছে, তারে বাতিল করে, বা এই কমিটিসহই অন্তর্ভূক্ত হয়ে, দ্রুতই এই সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিল গঠন করতে হবে। এই অভিভাবক কাউন্সিলের পরামর্শেই অভ্যুত্থানের সরকার চলবে। এখন যারা উপদেষ্টা আছেন, তারা একই ক্ষমতায় এডমিনিস্ট্রেটিভ নির্বাহী থাকবেন, যদি বহাল থাকেন। আর, উপরের এই সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিলই হবে মূলত উপদেষ্টা পরিষদ, যাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাই অভ্যুত্থানের নির্বাহি সরকারের কাজ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই এই অন্তর্বর্তি সরকার জাতীয় সরকারে পরিণত হবে। এই অভিভাবক কাউন্সিলই সরকারের স্কোপ ও টাইমলাইনগুলো ডিফাইন করবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।
৩. নতুন সংবিধান
এই পর্বের সর্বশেষ স্তর, নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও ঘোষণা।
যেহেতু সংবিধান হল রাষ্ট্রের উপরে জনগনের মালিকানার রাষ্ট্রদার্শনিক দলিল ও চুক্তি, আর রাষ্ট্রে জনগনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেই নতুন সংবিধান তৈরীর দরকার পড়ে, কিন্তু ৭২ এর সংবিধানের মাধ্যমে জনগনকে রাষ্ট্রের মালিকানা থেকে বেদখল করা হইছে এবং চব্বিশের জন-অভ্যুত্থানের ফলে জনগনের সেই মালিকানা রিক্লেইম করার নয়া মুহূর্ত তৈরী হল বইলা দাবী করছি আমরা, তার জন্যই, নতুন সংবিধান, মানে সেই মালিকানার দলিল প্রণয়ন জরুরি সবার আগে। যার ভিত্তি হবে ইতিহাসের সেই শুরুর বিন্দু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। আর স্পিরিট হবে ১৯৭১ সালের গণমুক্তিযুদ্ধ এবং দুই হাজার চব্বিশের জনঅভ্যুত্থান।
ফলে, নতুন সংবিধানের উদ্দেশ্যে অতি দ্রুত অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে অভ্যুত্থান-উত্তর সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করতে হবে, যাদের কাজ হবে অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণ করে একটি নতুন সংবিধান ড্রাফট করা। (যদিও একটা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যেটি প্রথমে এডভোকেট শাহদীন মালিককে, এবং পরে তার স্থলে প্রফেসর আলী রিয়াজকে প্রধান করে করা হয়েছে। কিন্তু এই সংস্কার কমিটি নির্বাহী বিভাগের নিয়োগমাত্র। এই নিয়োগ অভিভাবক কাউন্সিল বা সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত থেকে হয় নাই, ফলে সর্বদলের ও জনগনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে বলে বিবেচিত হবে না।) পরে, এই সংবিধান কমিটি তাদের ড্রাফট এর উপর জনগনের মতামত আহ্বান করবে ও প্রয়োজনীয় সংশোধন শেষে, সর্বশেষ, সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিলের অনুমোদনের পর গণভোটে পাঠাবে। এই গণভোটের মাধ্যমেই অভ্যুত্থানপরবর্তি বাংলাদেশের নতুন সংবিধান এডপ্টেশনের সাথে সাথে, অভ্যুত্থানের সরকারের মেয়াদ, স্কোপ ও চলমান কাজের বৈধতাও নেওয়া হবে জনগনের কাছ থেকে।
এখানে নোক্তা নেওয়া দরকার, এই অভ্যুত্থানটা যে হেফাজত, বিএনপি বা বামের মত আদর্শিক দলের হাতে না হয়ে একটা আম, রিজিড আইডিওলজির বাইরের, বৈচিত্রপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনের হাতে হল, এই ঘটনা অভ্যুত্থানকে অনেকগুলো আদর্শিক অবলিগেশন থিকা মুক্ত করল। এই মুক্তি জরুরি ছিল, কারণ, আইডিওলজিও একটা ফ্যাসিস্ট ফাঁদ। ফলে, নতুন সংবিধানে আইন ও ভাবাদর্শের সব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল, এবং রাষ্ট্রে জনকনসেন্ট ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের হাজিরা নিশ্চিতের বিরুদ্ধে যে দল ও ভাবদর্শিক বাধা, এই বাধা থেকেও মুক্ত থাকার শর্ত তৈরী হল। এই মুক্তিকে উদযাপনের সর্বোচ্চ সুযোগের ব্যবহার করতে হবে নতুন সংবিধানে। এই মুক্তিকে সামনে রাইখা, পুরনো সংবিধানবিদদের অগ্রাহ্য করতে হবে। পুরনো সংবিধানের জ্ঞানীদের লইয়া আমাদের তেমন কাজ নেই।
📎 নতুন সংবিধানটি কেমন হতে হবে?
এক. নতুন সংবিধানের চরিত্র নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে প্রাথমিকভাবে অভিভাবক কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা, জনগনের প্রতিনিধি হিশেবে। তবে, আমরা কিছু অনুমান ও প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, আমাদের নাগরিক আগ্রহের জায়গা থেকে। যেমন, নতুন সংবিধানেও কি আপনার ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’য় কোন বন্ধুরাষ্ট্র আইসা হামলা করতে সক্ষম হবে?
দুই. রাষ্ট্রের একটা এসেনশিয়াল এনিমি দরকার হয়। ৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের এসেনশিয়াল এনিমি ঠিক করা হইছিল ধর্মকে, যা এখানে ইসলাম। ফলে, একাত্তরের পরে মুসলমানি চিহ্ণ ও আচরণ আদার হিশেবে গন্য হইত। নতুন সংবিধানে আমরা এরকম জনগনকে এনিমি কইরা রাখার সংবিধান চাই না।
নতুন সংবিধানের প্রাথমিক চেহারাটা আমরা চাই, এখানে চার মূলনীতির মত কোন বায়বিয়, ধরে দেখা যায় না এমন কল্পনা থাকবে না, যারে ‘দি অ্যালজাবরা অব ইনফিনিট জাস্টিসে’র মত করে ব্যবহার করা যায়। পুরনো সংবিধানের সেই ‘দি অ্যালজাবরা অব ইনফিনিট জাস্টিস’ হল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার বায়বিয় মূলনীতির যে কোন একটারে উপলক্ষ কইরা হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলার পরও বলা সম্ভব, যে, আমরা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এই ‘নেসেসারি কিলিং’ করেছি। ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা নামের কল্পনারে ব্যবহার কইরা আওয়ামীলীগ এবং তাদের ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা এরকম গণহত্যাযজ্ঞের ঘটনারে নেসেসারি কাজ মনে করতেন, যা উনারা সভা সেমিনারগুলোতে বলতেন এবং মিডিয়াগুলোতে আসত। আবুল মনসুর আহমদ বলছিলেন, আমরা এইসব ভেলুজের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করি নাই। না ছয় দফা, না ঘোষণাপত্র, কোথাও তো এইসব ছিল না। আমাদের দরকার হল গণতন্ত্র, তাইলে বাকি ভেলুজগুলো আপনি আসবে।
দ্বিতীয়ত, জাতি পরিচয়ের বৈষম্য থাকবে না নতুন সংবিধানে। পুরনো, বিশেষত শেখ মুজিবুর রহমানের সংবিধান মতে, বাংলাদেশে বসবাসকারী সবাই ‘বাঙালি’ বলে গণ্য হবে। সংবিধান থেকেই পড়ুন, ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি’। ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’।
‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালী জাতি’ বলা হইতেছে এই ভূখণ্ডে বসবাসরত সবাইরে এবং আমাদের জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি বলা হইতেছে এই জাতিগত পরিচয়রে, সংবিধানের মূলনীতিতে। এইটা একটা মিথ্যা ভাষণ। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বহুভাষাভাষি ও জাতি পরিচয়ের মানুষের বসবাস। যে বাংলা ভাষাভাষি নন, স্রেফ একটা রাষ্ট্রীয় পরিচয় নির্মাণের জন্য তারে বাঙালি কেন হইতে হবে?
রবীন্দ্রনাথের একটা ভারতবর্ষ কল্পনা ছিল, যেখানে বসবাসকারি প্রত্যেকটি মুসলমান খ্রিস্টান সবাই হিন্দু হিশেবেই বিবেচিত হবেন। আত্মপরিচয় নামের লেখায় পাবেন। সংবিধানে বাংলাদেশে বসবাসকারী সবার ‘বাঙালি’ পরিচয় নির্ধারণ রবীন্দ্রনাথের এই গায়ের জোরের ‘হিন্দু কল্পনা’র মতই, বা তার চাইতে ভয়ংকর। নতুন সংবিধানে আমার পরিচয়রে কেড়ে নেওয়ার জন্য নতুন জাতীয়তা ডিফাইন করতে আসবে না রাষ্ট্র। সব জাতিগোষ্ঠিগুলোর পরিচয় হবে নিজ নিজ পরিচয়ে। ‘উপজাতি’, ‘আদিবাসি’ বা ‘নৃগোষ্ঠি’ হিশেবে নয়। চাকমার পরিচয় হবে চাকমা। মারমা হবে মারমা। আর বাঙালি হবে বাঙালি। সবাইরে বাঙালি হতে হবে না। তার রাষ্ট্রীয় পরিচয় হবে বাংলাদেশী।
তৃতীয়ত, নতুন সংবিধানের কাজ হল মানুষ বা নাগরিকের যে ইনএলিয়েনেবল রাইটস, যারে আপনি তার শরীর থেকে আলাদা করতে পারবেন না, জাতিসংঘের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস এ যা উল্লেখ আছে, তার সংরক্ষণ করা। তা যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে। এইটা হবে সংবিধানের ইটারনিটি ক্লজগুলোর একটি।
চতুর্থত, আমাদের অধিকারের ধারণাগুলোর বৈষম্যে সমতা আনা। রাজনৈতিক অধিকার, যেমন কথা বলা ও সভা সমাবেশের অধিকারের মত কইরা ভাত কাপড় বাসস্থান চিকিৎসা এগুলোর অধিকারকেও আদালতে ক্লেইমেবল অধিকারের মর্যাদা দেওয়া, যা আগের সংবিধানে ছিল না। এইটারে লিগেলি এনফোর্সেবল অধিকার এর মর্যাদার জন্য যদিও দীর্ঘ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও সাধনা দরকার, কিন্তু এর শুরুটা করতে হবে নতুন সংবিধান থেকে।
পঞ্চমত, গণঘৃণার প্রচার আর উইচহান্টিংকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিশেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের এখানে এইটারে ‘দেশপ্রেম’ বানানো হইছে গত পঞ্চান্ন বছর ধইরা, এবং সমাজের বিভিন্ন সেক্টরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিভেদ জারি রাখতে হেইট ছড়ানোকে ‘রাজনীতি’ ও ‘দেশপ্রেম’ বলা হইত। এবং তাদের বিরুদ্ধে উইচহান্টিং করা হইত। যেমন, ‘শিবির সন্দেহ’। এই ধরনের সন্দেহে যে উইচহান্টিং হত, সাধারণ আইনের বাইরে তার কোন স্পেসিফিক আইনি প্রতিকার ছিল না। এই ধরনের গণঘৃণা তৈরীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন হওয়া দরকার, এবং নতুন সংবিধানে তার বাধ্যবাধকতা রাখা দরকার। এইটা আমাদের সভ্য হওয়ার প্রথম শর্ত।
ষষ্ঠত, এবসলিউট একনায়কের যে শাসন শেখ মুজিব প্রচলন করছিলেন বাহাত্তরের সংবিধানে, প্রধানমন্ত্রীর এবসলিউট ক্ষমতা, পরে চতুর্থ সংশোধনীতে আইসা যা হল প্রেসিডেন্টের এবসলিউট ক্ষমতা, আর সত্তর অনুচ্ছেদ, যেখানে সংসদের অপিনিয়নের গলা টিপে রাখা হয়েছে, নতুন সংবিধানে যাতে তার ছায়াও না থাকে। এমন বিধান ও আইডিয়াকে সামনে রেখে এই সংবিধান করতে হবে, যাতে কোনভাবেই নতুন কোন ‘স্বৈরাচার’ তৈরী হতে না পারে এই সংবিধানের অধীনে। ‘অবৈধ ক্ষমতা দখলে’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থার চাইতে এই একনায়ক হয়ে ওঠার সুবিধা যাতে না থাকে, তার জন্য খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে অবৈধ ক্ষমতা দখলের সুযোগ ও সম্ভাবনা কোনটাই থাকবে না।
৪. পরিকল্পনা ও টাইমলাইন
সর্বোচ্চ দুই মাসের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ঘোষণা করতে হবে, এর বেশি নয়। এই দুই মাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন শেষে নতুন টাইমলাইন ঘোষণা হবে, আরো সর্বোচ্চ দুই মাস। এইভাবেই, সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিলের অধীনেই প্রতি দুই মাস পরপর নিজের মেয়াদ ও স্কোপ রিডিফাইন হবে, দরকার হলে বাড়াবে, বা নতুন কর্তব্য ঠিক করবে। এই অভিভাবক কাউন্সিলই নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য কমিটি ঘোষণা থেকে শুরু করে, তার প্রাথমিক অনুমোদন দেবে। এবং সরকারের প্রায়রিটি লিস্টগুলো ঠিক করবে। সর্বশেষ, নতুন সংবিধানের অধীনে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাহী সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচন দেওয়ার মাধ্যমেই এই অভিভাবক কাউন্সিলের কাজ শেষ হবে।
এইখানে বইলা নিই, দল হিশেবে বিএনপি বা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে থাকা ক্লাসিক্যাল দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, আগের যে বিএনপি, বা কায়েমি দলবাজ ভেল্যু ব্যবস্থা, সরকার ও ক্ষমতা কাঠামো, প্রতিরোধ ধারণা, তারে নেই করে দিয়েই এই জনঅভ্যুত্থান হইছে। ফলে, তাতে না ফেরার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করার লড়াইয়ে শামিল হতে হবে সবাইকে। এবং এই কাজে যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অবহেলা করবে, তারা ইতিহাস থেকে দূরে সরে যাবে। কারণ, এই মহূর্তে এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করতে সক্ষম না হলে, আপনার রাজনীতি লেজিটিমেসি হারাবে।
📎 দুই. ট্রুথ এণ্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন
আমরা মনে রেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের পরে ক্ষমতায় আসা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বইলা দাবীদার আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে আমাদের জাতীয় রিকনসিলিয়েশন প্রসেসে নেতৃত্ব দিতে পারে নাই। জামাত ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের প্রশ্নে একটা রাজনীতি ও বিভাজনের টুল জিঁইয়ে রেখেছিল, যে বিভাজনের বিরুদ্ধে আমাদের দীর্ঘ লড়াই ছিল। এখন, আমাদের সামনে, ঠিক একই চেহারায়, জামাত প্রশ্নের মতই, আওয়ামীলীগ প্রশ্ন হাজির হয়েছে, ২৪ এর অভ্যুত্থানের জেনোসাইডের দায় ও পরাজয়ের পর। এই ঘটনার পর, আমাদের আওয়ামীলীগ প্রশ্নটা ঠিক আগের যে কোন সময়ের আওয়ামীলীগ প্রশ্নের মত না, যারে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা সম্ভব। বরং, এর একটা অন্য সমাধান দরকার, যে সমাধানটি জামাত বা বাকি স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলোর ব্যাপারে আওয়ামীলীগ কইরা যেতে ইচ্ছুক হয় নাই, সচেতনভাবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি এই ইস্যুরে টুল হিশেবে জিঁইয়ে রাখব, এবং আরো অর্ধশত বা তারো বেশি বছর ধরে, এর কোন সমাধান না কইরা তাদের ব্যাপারে কেবল ফ্যাসিস্ট ও বাকশালের ছানাপোনার গল্প বইলাই বিভাজন টিকিয়ে রাখব? মানে, সুস্পষ্টভাবে, আমাদেরকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতির নায্য ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে হবে, এই সর্বদলীয় অভিভাবক কাউন্সিলের পক্ষ থেকে। এইটা আইন ও সংবিধান সম্পর্কিত আলাপের চাইতে, আমার কাছে নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত আলাপও। আমার মত হল, দল, ব্যক্তি ও হুকুমদাতা নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে মামলা ও শাস্তি যদি চলে, এই অভিযোগ, এবং জনগনের বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক অপরাধের ও শত্রুতার হিস্ট্রির পরে, একই নামে রাজনীতি আইনের চাইতেও তাদের জন্য বেশ ভারিও হবে। যে ভার, বহু দিন ধইরা জামাত নামের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী ও কোলাবরেটর দলও বহন কইরা চলছে, আপনারা জানেন। ফলে, এইটার সমাধান স্রেফ আইনি পরিসরের নয়, আওয়ামীলীগকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা এই ভার কীভাবে বহন করতে চায়, নাকি ফেলে দিতে ইচ্ছুক।
ঐতিহাসিকভাবে, এই ধরনের পরিস্তিতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, একটা রিকনসিলিয়েশন প্রসেস শুরু করা। আমি একটা ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের কথা কইতেছি, তার অর্থ ও গন্তব্য হল গুম খুনের রাজনীতিগুলোরে তওবা, মানে অনুশোচনার দিকে নিয়ে আসা। আর, রাজনীতি ও অপরাধরে আলাদা কইরা মবের থেকে বাঁচিয়ে কেবল অপরাধীদের শাস্তি, মানে জাস্টিস নিশ্চিত করা। এবং ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিস্ট আইডিওলজির যাতে পুনর্বাসন না ঘটে, তার জন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শর্তে নাগরিকদের ঐক্যমত ও সে ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র তৈরী করা। এই উদ্দেশ্যে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ পরবর্তি ইতিহাসের মত কইরা ট্রুথ এন্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করার কথা ভাবা যায়। এবং দল হিশেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চাইতে, শর্তসাপেক্ষে, যেমন, একটা যৌক্তিক সময়ের জন্য তাদেরে এই নামে রাজনীতির অধিকার রহিত করার কথা বলবো আমি। এবং এই সময়টাতে, নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধনও বাতিল করার কথা বলবো। এইটা হল সেই জাস্টিস, যে জাস্টিস আওয়ামীলীগ জামাত প্রভৃতি দলের প্রতি করতে পারে নাই।
কারণ, আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের পপুলেশনের বড় অংশ। এদেরকে পুরোপুরি আদার, মানে নিষিদ্ধ করে দিয়ে একটা দেশ চালানো, প্রায় অসম্ভবই। কিন্তু, এই ব্রুটালিটির পরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগকে ঠিক আগের মত কইরা ফিরে আসতে দেওয়া, বা বিনা প্রশ্নে তাদেরে রাজনীতি করতে দেওয়াও একটা বড় ইনজাসটিসরে প্রতিষ্ঠা করবে, অভ্যুত্থানপরবর্তি বাংলাদেশে। ফলে, প্রস্তাবিত কমিশনের কাজ হবে, যারা গুম খুনের মত বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন, এই ভিত্তিতে কনফেশনের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় এর আওতায় আসতে ইচ্ছুক, তাদের কনফেশন ও তার ভিত্তিতে অভিযুক্ত এবং ভিকটিম উভয়ের গণশুনানির ব্যবস্থা করা এবং তাদের মধ্যে ক্ষতিপূরণ, আর অপরাধে জড়িত না হওয়া ইত্যাদি প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে রিকনসিলিয়েশনের আউতায় নিয়ে আসা। শর্ত থাকবে যে, এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে কমিশনের আওতায় রিকনসিলিয়েশনে আসা তার পুরনো ও নতুন সব অপরাধ পুনর্বার নিয়মিত আদালতে বিচার ও শাস্তির আওতায় আনা হবে। এবং এর বাইরে, যারা গুম খুনের অপরাধে সরাসরি বা হুকুমের বরাতেও অপরাধী, তারা এই কমিশনের কোন সুবিধা পাবে না। বরং, তাদেরে তাদের নিজেদের তৈরী মানবতাবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালের অধীনে বিচার এনশিওর করা সম্ভব। তবে, এই ট্রাইবুনালে কোন দল ও ব্যক্তির নতুন কইরা জেনোসাইডের বিচার শুরুর আগে, ট্রাইবুনাল ও এর জংলি আইনগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। স্কোপগুলো নতুনভাবে ডিফাইন করতে হবে ও বাড়াতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে যেরকম রাজনৈতিক বিচার ও বিচারিক খুনোখুনি হইছে বইলা অভিযোগ আছে, তার সুরাহা করতে হবে। কোনভাবেই, তাদের ন্যায়বিচারের অধিকার রহিত করা যাবে না। বরং, ন্যায়বিচার এবং সব ধরনের নাগরিক সুবিধা বজায় রাইখাই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে এই জুলাই গণহত্যার হোতাদের। আমরা কোন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধেই ইনজাসটিস চাই না, যে ইনজাসটিস তারা এদেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে জারি রেখেছিল।
📎 তিন. ফ্যাসিস্ট আইডিওলজির মোকাবেলা প্রশ্ন
আদর্শিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোকাবেলা, যেটি ফ্যাসিস্টের আইডিওলজি ছিল, এবং ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে সব সময়ই। যেমন, হিটলার থেকে মুক্তির পরও, নাৎসি আইডিওলজি থেকেও মুক্তির লড়াই করতে হয়েছে জর্মানদেরকে। এইখানেও, এই লড়াই আমাদের একই সাথে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। তবে, অভ্যুত্থান পরবর্তি সংবিধান এবং অভ্যুত্থানের সর্বদলীয় বিপ্লবী দলিল, যা একই সাথে সংবিধানেরও অংশ হবে, তাতে এই লড়াইয়ের স্পিরিটরে ধারণের জরুরতের কথা বলি আমি। যেমন, সংবিধানে গণঘৃণার প্রচারকে অপরাধ সাব্যস্ত করা এবং যে জাতি বৈষম্য বিলোপের কথা বললাম, যে বৈষম্য আপনার জাতিগত পরিচয়রে সবার উপরে চাপিয়ে দিতে তৎপর, তাও এই ফ্যাসিস্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোকাবেলাই।
📎 চার. ভারত প্রশ্ন
ভারত আমাদের সীমান্ত। বাণিজ্য থেকে শুরু করে পানি, সীমান্তহত্যা, সব ইস্যু লইয়াই ভারতের সাথে আমাদের বোঝাপড়ার বাস্তবিক ও ঐতিহাসিক কারণ তৈরী হয়ে আছে। এই মুহূর্তে ভারত ও তার আশে পাশের দেশগুলোতে, যেমন মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান সব জায়গার জনরাজনীতিতে ভারতপ্রশ্ন গুরু ও ডিসিসিভ ফ্যাক্টর আকারে হাজির আছে। বাংলাদেশেও গত ষোল বছরের একদলীয় শাসন এবং এই শাসনের প্রতি ভারতের শাসকদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের কারণে, এবং ছাত্র-জনঅভ্যুত্থান পরবর্তি নতুন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বৈরী আচরণের কারণেও ভারতপ্রশ্ন আবার নয়া কইরা রাষ্ট্রের এসেনশিয়াল ফেনোমেনন আকারে হাজির হইছে। যার মোকাবেলার কৌশলপত্র ও নীতিমালা ঠিক করতে হবে অভ্যুত্থানের সরকারকে। এই কৌশলপত্র সংবিধান না হোক, অভ্যুত্থানের বিপ্লবী দলিলের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশে ভারতপ্রশ্নটি বেশ জটিল। সাধারণত, রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক হয় রাষ্ট্রের। রাজনৈতিক দলের সাথে নয়। কিন্তু, ভারতের সাথে বাংলাদেশের কেবল একটা রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক, যা চরিত্রে ব্যক্তিগত, এমন কি নির্ভরতারও। এইটা অনৈতিক ও পরকিয়ার ঘটনার মত। চরিত্রগতভাবে, এইটারে আমি দুই শয়তানের ঘোটপাকানি বলি। এইখানে মোদি গাঁধি সবই এক। এই ঘোটপাকানির সমাধান কী? সমাধান না যদি করা হয়, বাংলাদেশের এই যে এমার্জিং ভারতপ্রশ্ন, যা ফ্যাসিস্টের সময়ে বয়কট ইন্ডিয়া আকারে দেখা দিয়েছিল, এখনো চলমান, ভারতের জন্য এইটারে মোকাবেলা কঠিন হবে।
আমার মতে, সমাধান হল, বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়রেই নিজেদের স্বার্থগুলো নিয়া খুল্লমখোলা, পরিস্কার আলোচনা করতে পারতে হবে ও সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে পারতে হবে।
ভারতকে সুষ্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে অন্তত দুইটি বিষয়ে। এক. পার্বত্য চট্টগ্রামে সব ধরনের ইন্টারভেনশন বন্ধ রাখবে ও কোন রকম সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সম্পর্ক রাখবে না। দুই. কোন অবস্থাতেই সীমান্তে গুলি চলবে না এবং তার নজির দেখাতে হবে। এরপরে, স্তরে স্তরে পানির নায্য হিস্যা, বাণিজ্য ঘাটতি, এইসব আলাপেও আন্তরিকতা দেখাতে হবে ভারতকে। এই ঘোষণাগুলো রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশের জনগনের মধ্যে কার্যক্ষেত্রে ভারতবৈরী যে মনোভাব, তা কমাবে। ফলত রাজনৈতিক দলগুলোও, যেমন বিএনপি জামাত, এমনকি ভারতপন্থি বইলা পরিচিতদের রাজনীতিও ভারতপক্ষ বা বিরোধিতার চাইতে আরো ডাইনামিক হবে। রাষ্ট্র হিশেবে ভারতও স্রেফ জনকনসেন্টহীন একটা দলমাত্রের অনৈতিক সমর্থক হিশেবে বিবেচিত হবে না বাংলাদেশের জনগনের কাছে। ভারত একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উপরে নির্ভরতার চাইতে বেটার পলিটিক্যাল সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
একই সাথে, বাংলাদেশেরও রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি হতে হবে, তাদের ক্ষমতাকালে বাংলাদেশও ভারতের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথে কোনরকম সম্পর্ক রাখবে না ও আশ্রয় দেবে না। যেটিরে শেখ হাসিনা, বেশ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ততার সাথেই বলতে সক্ষম হইছিলেন, বাংলাদেশের মাটি ভারতের শত্রুদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যারে আমরা স্রেফ ঘোটপাকানির বাইরে পড়তে পারি নাই তখন।
উভয়ের এই সুষ্পষ্ট সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা ছাড়া, রাষ্ট্র হিশেবে ভারতের সাথে রাজনৈতিক দল হিশেবে আওযামীলীগের যে একাট্টা ও অনৈতিক ঘোটপাকানি, তারে মোকাবেলা করা যাবে না। আবার, ভারতেরও রাষ্ট্র হিশেবে মুক্তি হবে না। আর আমরাও ভারতীয় পণ্য বর্জন ইত্যাদি জনপ্রিয় শ্লোগানে মশগুল থাকব। ভারত কি এই সমাধানেই নির্বাণ চায়?
প্রথম ড্রাফ্ট: ২৭ আগস্ট, ২০২৪। সর্বশেষ সংস্করণ: ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪।
[1] In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful, We, the peoples. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), দ্বিতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭৯৪-৭৯৫।
[2] in pursuance of this object to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quoran and the Sunnah. প্রাগুক্ত।
[3] No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quoran and Sunnah. প্রাগুক্ত।
[4] Facilities shall be provided for the teaching of the Holy Quoran and Islamiat to the Muslims of Pakistan. প্রাগুক্ত।
[5] Observance of Islamic moral stundards should be promoted amongst the Muslims of Pakistan. প্রাগুক্ত।
[6] II. RIGHTS OF MEMBERS OF OTHER RELIGIOUS DENOMINATIONS. III. ESTABLISHMENT OF A SOCIALIST ECONOMIC SYSTEM WITH A VIEW TO ACHIEVING A SOCIETY FREE FROM EXPLOITATION. V. RIGHTS OF WORKERS AND PEASANTS
[7] সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর, ১৯৫২ থেকে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এটিই সবচেয়ে ব্যাপক। বণিকবার্তা, সোমবার ২৯ জুলাই ২০২৪।
[8] Bangladesh unrest: Govt should have spoken out against quota earlier, met protesters, says Hasina son. Sajeeb Wazed Joy. The indianexpress. আগস্ট 14, 2024।
[9] দ্রষ্টব্য: পৃষ্ঠা ৬১৫, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। আবুল মনসুর আহমদ। প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯। খোশরোজ কিতাবমহল, ২০১৩।
[10] দ্রষ্টব্য: পৃষ্ঠা ৭০, বিপুলা পৃথিবী। আনিসুজ্জামান। প্রথমা প্রকাশনী। প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪২১, ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
5 comments
M Fazlul Karim
A master piece. I wish the current government led by Prof. Yunus engages the intellectuals and people of Bangladesh at large for adopting a new constitution based on the spirit of the July movement, reforming the existing constitution will not solve the issues that created a fascist like Hasina who used the constitution as shield to carry on her fascism. Most of the problematic parts of the current constitution are declared unamendable anyway, we really need a fresh start.
Jobaer Hossain
কি এক মোহাবিষ্টের মত পড়ে গেলাম ! কতক্ষণ লাগলো পড়তে খেয়ালও করিনাই। স্বাধীন – সার্বভৌম আর যা যা ইতিবাচক অভিধায় একটা রাষ্ট্রকে অভিহিত করা যায় তার একটা পরিপূর্ণ ইশতেহার মনে হল আমার কাছে। দল-মতের উর্ধ্বে উঠে নিজেকে একজন বাংলাদেশ ম্যান হিসেবে না ভাবতে পারলে এমন নির্মোহ লেখা কারো পক্ষে সম্ভব না।
Ahmed Syed
পড়লাম। প্রস্তাবনা গুলো বেশ প্রয়োজনীয় তবে কার্যকর করা বেশ কঠিন। তবে এর মধ্যে সামাজিক চুক্তি ও অভিভাবক পরিষদ একটা চমৎকার প্রস্তাবনা। এই দুইটি বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা আরো বিশদ ভাবে হওয়া উচিত।
Risalat Karim
অসাধারণ!
একটানা মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।
কাওসার আহম্মেদ
পড়তে পেরেছি সম্পূর্ণটি, সবগুলো কথাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এখানে রাষ্ট্রের জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে লাস্টের কর্মচারীদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল সে বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য পেলাম না। রাষ্ট্র জনগণের মালিকানায় কিন্তু রাষ্ট্রের কর্মচারী জনগণের মালিকানায় কেন নয়। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েমে যাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে সেই সূত্রটাকে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
ধন্যবাদ, প্রিয় রিফাত হাসানকে পরবর্তীতে আরো মতামত দিব। ইনশাআল্লাহ।