জনবিতর্ক

দ্রাবিড় হাসান খান

সরকার কেন গণমানুষের পক্ষের প্রতিষ্ঠান না

September 23, 2024   0 comments   2:21 pm

ভয়ের বিষয় হইলো যেহেতু দেশের বিবিধ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক নাই, ফলে জনগণ যেহেতু তাদের বিশ্বাস এই ‘ভাল মানুষদের’ সরকারের উপর সম্পূর্ণ অর্পণ করছে ফলে হইতে পারে তারা তাদেরকে ব্যবসার দায়িত্বও দিয়া দিতে পারে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে হবে এইটা সরকার! ফলে ‘সরকারের ব্যবসার’ ফলাফল রাশিয়ার সরকারের গোডাউনে থাকা ট্রাক্টরের মতই হবে যেগুলাকে আর পাওয়া যায় নাই ফসল কাটার সময়।

Share

চমস্কির সরকারের ধারণা নিয়া যে আলাপ গুলা আছে সেইখানে তিনি কখনোই সরকারকে মহান কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেন নাই বরং তিনি মনে করতেন সরকার কখনই জনগনের জন্য কাজ করে না। একই সাথে তিনি মনে করতেন সরকার একটা ইনহেরেন্টিলি ভায়োলেন্ট প্রতিষ্ঠান। গভর্নমেন্টকে ট্রাস্ট করার বিষয়ে তার খুব বিখ্যাত উত্তর হইলো ‘বাই ডেফিনেশন দেয়ার ইস নো ফরম অব অথরিটি ইউ ক্যান ট্রাস্ট। অথরিটি ইস সামথিং টু বি চ্যালেঞ্জড’!

চমস্কির এই আলাপগুলার যে ধারণা তার সাথে অনেকই হয়ত পরিচিত কিন্তু চমস্কির নাম নিয়া বলেলে আমাদের যে ‘একাডেমিক’ মন সেইটা সহজে আর্গুমেন্ট মানতে প্রস্তুত হয়।

বাংলদেশের মত দেশ গুলা যারা কখনোই ঐভাবে গুড গভর্নেন্স পায় নাই তাদের একটা কমন বিশ্বাস হইলো একটা ভালো সরকার মূলত তাদের সব সমস্যার সমাধান কইরা দিবে। অথচ যারা অনেক দিন ইউরোপ কিংবা নর্থ আমরিকাতে থাকেন তাদের কাছে যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন সেখানকার সরকার আর তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে, তাহলে তারা সরকারের অদক্ষতার ১০১ টা উদাহরণ আপনাকে দিতে পারবে ইনক্লুডিং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনের মত মৌলিক বিষয়গুলা সহ।

তাই মনে রাখতে হবে সরকারের ধারণা আমাদের সমস্যা সমাধানের একটা স্বীকৃত কৌশল কিন্তু কনসেপ্ট হিসাবে দুর্বল এবং অনেকাংশেই খারাপ।

সরকারের ধারণার দুর্বলতা এবং এর ভিতরকার থাকা ভায়োলেন্সের ইনহ্যারেন্ট ফর্ম সমুহ আমরা সহজেই ভুইলা যাই যখন একটা ব্যাপক জনসমর্থনের ‘জনপ্রিয়’ সরকার ক্ষমতায় আসে। বিপ্লব পরবর্তী সরকারের মধ্যে আমরা এইটা বেশি দেখতে পাই।

খেয়াল করলে দেখবেন গণতন্ত্রের অধীনে সরকার মাত্রই সারভাইভাল মেকানিক্স এর মধ্যে থাকে। মানে সবসময় টিকা থাকার ক্রাইসিসের ভিতর দিয়ে যায়। ফলে তার নিজের নিরাপত্তার যে কৌশল সমূহ তা গণমানুষের জন্য অধিকাংশ সময়ই ভালো হয় না।

সরকারের নিরাপত্তার কৌশল সুসংগঠিত হয় এর মধ্যকার ১. কনসেনট্রেটেড পাওয়ার ২. ফোর্স এর মনোপলি এবং ৩. মানি প্রিন্টিং এর ক্ষমতার মধ্য দিয়ে। যার সবগুলাই প্রবলেমেটিক। আবার এতদ সত্ত্বেও সরকার একটা মূলত ইনেফিসিয়েন্ট প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুইড়া যেইটা আমরা ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্যে পাই। তবে এই বিশাল শক্তি সমেত ইনিফিশিয়েন্সি নিঃসন্দেহে ভীতিকর জনগণের জন্য!

এখন দেশের প্রসঙ্গে যদি আসি তাইলে আমরা দেখি এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে কাজগুলা করার জন্য চেষ্টা করতেছে তার মধ্যে ফিলোসফিক্যালি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হইলো অধিকার আর সংস্কার/উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য। কিন্তু সরকারের জন্য অধিকার ও সংস্কারের ভারসাম্য করা কঠিন কাজ যেহেতু এই মুহূর্তে শুধু সরকার না দেশ হিসাবে  বাংলাদেশও এক্সিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়া যাইতেছে। মানে আর ভারতের খপ্পড়ে ফেরত যাওয়ার সুযোগ নাই যেহেতু! কারণ এরপর দিল্লি আর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা একই ভুল আর করবে না।

তবে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, সংবাদ মাধ্যম সবাই ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়া গেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। এই সমর্থনটা দরকার এই মুহূর্তে সেইটাও ঠিক আছে।

কিন্তু জনগণের অধিকারের প্রশ্ন আর সংস্কার/উন্নয়নের মধ্যে বিরোধ দেখা দিবে খুব শীঘ্রই। আমরা দেখলাম ফ্যাসিবাদ চইলা গেলেও ফ্যাসিবাদের ছায়া যেহেতু আমরা সর্বত্র দেখতে পাই ফলে যেকোনো রকম আপরাইসিং কে ফ্যাসিবাদের শক্তি বইলাই ট্যাগ দিতেছে এমনকি উপদেষ্টারাও এই ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলতেছে।

ট্যাগ দিলে দমন সহজ হয়, ফলে সরকার তার ফোর্সের মনোপলি ব্যবহার করতে পারে যাকে ট্যাগ দেয়া হইলো তার বিরুদ্ধে। এখন কতদিন পরে গার্মেন্টস কর্মী তার দাবি জানাইলে তার দাবির মধ্যে আর ফ্যাসিবাদ পাওয়া যাবে না সেইটা স্পষ্ট না হইলে (বা আদৌ করা সম্ভব কিনা), এই চলতে থাকা ট্যাগিং আগের ফ্যাসিবাদিদের ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি’ ট্যাগিং এর মতই হইয়া যাবে।

আবার লক্ষ্য করলাম রাষ্ট্র চিন্তার মত বাম ঘরানার শক্তি গুলা পরামর্শ দিতেছে গত সরকারের সময় দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারকে হস্তক্ষেপ করার জন্য। অথচ কমিউনিস্ট সোশ্যালিস্ট এই ধারণা গুলা আরো তিন চার দশক আগেই তার অদক্ষতার জন্য দুনিয়া থেকে বিদায় হইছে।

ভয়ের বিষয় হইলো যেহেতু দেশের বিবিধ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক নাই, ফলে জনগণ যেহেতু তাদের বিশ্বাস এই ‘ভাল মানুষদের’ সরকারের উপর সম্পূর্ণ অর্পণ করছে ফলে হইতে পারে তারা তাদেরকে ব্যবসার দায়িত্বও দিয়া দিতে পারে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে হবে এইটা সরকার! ফলে ‘সরকারের ব্যবসার’ ফলাফল রাশিয়ার সরকারের গোডাউনে থাকা ট্রাক্টরের মতই হবে যেগুলাকে আর পাওয়া যায় নাই ফসল কাটার সময়।

আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক আগের সরকারের আমলে দুর্বল হয়ে যাওয়া ব্যাংক গুলা কে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এর বিরোধী।

ক্যাপিটালিজম মূলত সারভাইভেল অফ দা ফিটেস্ট। ক্যাপিটালিজমের মৌলিক শর্ত হইতেছে ফ্রি মার্কেট। যেখানে মার্কেট ডিটারমাইন্ড করবে কে মার্কেটে থাকবে কে মার্কেটে থাকবে না। এই জোর কইরা টিকায় রাখার চেষ্টা  জন্ম দেয় জম্বি প্রতিষ্ঠানের। সেই জন্য ব্যাংক যে “টু বিগ টু ফেইল” এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা দুনিয়া জুইড়া দেখছি সেন্ট্রাল ব্যাংক এবং গভর্নমেন্ট যখন মার্কেটে ইন্টারভেইন করে তখনই   ইনফ্লেশনের মধ্যে দিয়া জনগণের পারচেজিং পাওয়ার ডায়লুটেড হয়ে যায়। তাই আমাদের এখন থাইকাই ইনফ্লেশন কে থেফট হিসাবে ডিল করতে হবে।

যদিও বাংলদেশ সেন্ট্রাল ব্যাংক জানাইছে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারা টাকা ছাপায় সাহায্য করবে না বরং তারা গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু মূলত এই গ্যারান্টি হইল তাদের টাকা প্রিন্ট করার ক্ষমতার জানান।

আবার আই এম এফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের লোনের টাকা দিয়া মৃত ব্যাংক গুলোকে রিহ্যাবিলিটেড করার মধ্য দিয়ে ফ্রি মার্কেটে যে হস্তক্ষেপ করা হয় সেইটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মার্কেটে যে সমস্যা সেটা সমাধান না কইরা বরং ক্যান্সার সেলে সুগারের কাজ করে।কারণ এর মধ্যে যেই কারণে ব্যাংক গুলা সমস্যায় পড়ল সেইটা সমাধান করার ইনসেনটিভ থাকে না বরং তারা জানে জনগণের আমানতের দোহাই দিয়ে তাদের বারবার বেইল আউট দেয়া হবে। এই ব্যাপারে আপনারা কঙ্গো বা জায়ারের ইতিহাস দেখতে পারেন বা ২০০৭ সালের রিসেশনের পরে ওয়ার্ল্ড স্ট্রীটে হওয়া কোয়ান্টিটিটিভ ইজিং এর ফলাফল দেখতে পারেন।

আর আমাদের মনে রাখা দরকার আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ফ্রি মার্কেট এক্টিভেট করতে পারব না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা sovereign money ব্যবহার না করতে পারব। যাদের আগ্রহ আছে তারা এই বিষয়ে বিস্তর আলাপ খুঁজে পাবেন ইন্টারনেটে।

এই লেখা শেষ করার আগে আবার যদি আমরা সরকারের আলাপে ফেরত আসি তাইলে আমাদের বুঝা উচিত জনগণের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিবর্গ সরকার চালাইলেও সরকারের যে ইনহেরেন্ট নেচার তার কারণে এর সমালোচনা থাকবে। ফলে  সমালোচনা করলেই সে আগের ফ্যাসিবাদের পক্ষের লোক হয়ে যায় না। বরং বেশি জনপ্রিয় সরকারের বেশি সমালোচনা দরকার যাতে ক্ষমতার কনসেন্ট্রেশন এবং ফোর্সের মনোপলি অজনপ্রিয় মতামত এবং ব্যক্তির জন্য হুমকি না হইয়া ওঠে।

Leave the first comment