জনবিতর্ক, সংবিধান তর্ক

রিদওয়ানুল হক

জুলাই বিপ্লবের বৈধতা ও বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশ

September 12, 2024   0 comments   2:21 pm

আমাদের জুলাই বিপ্লবের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক সাম্য এবং, শেষের দিকে, গণতন্ত্রের পুনরূদ্ধার। সদ্য ক্ষমতাচ্যূত সরকার যখন গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করে তখন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সমতার পরিবর্তে বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুন্ঠন, রাজনৈতিক ও জন-পরিসর থেকে বিরোধীদের বিতাড়ন বা বহিস্কার প্রভৃতি অনাচার প্রতিষ্ঠা পায়।

Share

১.

গত জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। ৫ আগস্ট তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের সাথে জনগণের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা এক মহাপরাক্রম-শালী স্বৈরাচারের পতন হলো।

৫ আগস্টের বিজয়কে স্বাভাবিকভাবে অনেকেই বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে রায় দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসও এই শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন বিপ্লবের সফলতায় তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশের জন্য। একজন অশীতিপর বরেণ্য কথা-সাহিত্যিক ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের পর এমন আনন্দঘন মুহূর্ত তাঁর জীবনে আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন। দ্বিতীয় স্বাধীনতা শব্দদ্বয়ের ব্যবহার রূপক বা আলঙ্করিক অর্থে কিনা সে বিতর্কে না গিয়েও যে কথা অবলীলায় বলা যায়, তা হলো এখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির বিশাল তাৎপর্য রয়েছে। এই ‘স্বাধীনতা’ আসলে ফ্যাসিবাদ থেকে, লাগামহীন সামাজিক বৈষম্য থেকে, এবং সর্বোপরি মানুষের ভোট, ভাত ও কথা বলার অধিকারহীনতা থেকে মুক্তির কথা বলে।

শেখ হাসিনা সরকারের বিগত প্রায় ১২ বছরের (বিশেষত, 2011 থেকে) শাসনকাল ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ এ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দু’এক বছর হাসিনা অতটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠেননি তখনো।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ফ্যাসিবাদের উত্থান ১৯২০-৪০ এর দশকে ইউরোপে। ফ্যাসিবাদের সাথে ইতালির মুসোলিনির জাতীয় ফ্যাসিস্ট দলের জন্ম-ইতিহাস রয়েছে। মুসোলিনি ছিলেন ইউরোপের প্রথম ফ্যাসিস্ট নেতা। তিনি রোমান ফ্যাসেস (fasces) শব্দ থেকে তার দলের নামটি ধার নিয়েছিলেন। Fasces বলতে কুড়ালের মতো একটি অস্ত্রকে বোঝায় – যা প্রাচীন রোমে দণ্ড-দানের কর্তৃত্ব বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। ফ্যাসিবাদের একটি সাধারণ চরিত্র হলো এধরনের সরকার নির্বাচন, গণতন্ত্র, ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উদারতায় বিশ্বাস করে না। ফ্যাসিস্ট সরকার আইনের শাসনের পরিবর্তে কতিপয় এলিটদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। জুলুম-নির্যাতন অথবা গুম-খুন হলো যে কোন ফ্যাসিস্ট সরকারের দেশ-শাসনের হাতিয়ার।

২০০৮ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় নিয়ে ২০০৯ এ সরকারে আসলেও ‘শেখ হাসিনা’র আওয়ামী লীগ’ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদীয় নির্বাচন ছিল লোক-দেখানো ও পাতানো নির্বাচন। এই তিনটি ভুয়া ও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা মূলত একটি অলিখিত সাংবিধানিক রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। সেই রূপান্তরের ফলাফল ছিল ১৯৭৫ সালের সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মতো – যার মাধ্যমে দেশে একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

সকলের জানা রয়েছে, কী নিদারুণ নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, ও স্বৈরাচারী কায়দায় বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে আওয়ামীলীগের একদলীয় সরকার দেশ শাসন করেছে। সংসদে ও সংসদের বাইরে কোন বিরোধী দল ও মত ছিল না ও সহ্য করা হতো না। নিঃসন্দেহে, বিগত সরকার ছিল ফ্যাসিবাদের এক যুতসই উদাহরণ। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট এবং তার পরের কিছু দিন সরকারের হাতে শত শত শিশু-কিশোর, ছাত্র-যুবা ও সাধারণ নাগরিকদের নিষ্ঠুরভাবে খুন হওয়া সেই সরকারের ফ্যাসিবাদের চরম প্রকাশ।

২.

বিপ্লব বা যুদ্ধ কখন হয়? রাজনৈতিক-দার্শনিক হানাহ আরেন্ডট (Hannah Arendt) তাঁর ১৯৬৩ সনের ‘বিপ্লব’ নামক বইতে যুদ্ধ ও বিপ্লবকে আধুনিক যমানার দুটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক বিষয় বলেছেন। তার মতে, যুদ্ধ পুরনো ব্যাপার হলেও বিপ্লব হলো একটি আধুনিক ধারণা। যুদ্ধ ও বিপ্লব দুটোই রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ও নতুন সরকারের প্রবর্তন করতে পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে যুদ্ধের মাধ্যমে। আর, ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদ থেকে মানুষের মুক্তি মিলেছে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে।   

যুদ্ধ ও বিপ্লব দুটোতেই সহিংসতা (violence) উপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু সহিংসতাই একমাত্র উপাদান নয়। তবে, বিপ্লব সহিংসতাবিহীন হতে পারে। ২০২৪ এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব কি সহিংস ছিল? অথবা, এ-বিপ্লব কি সহিংসতার ভিত্তিতে হয়েছিল? ২০২৪ এর বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর অন্যান্য বিপ্লব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিপ্লব অন্যান্য দেশে সংঘটিত অনেক বিপ্লব থেকেও আলাদা। এই বিপ্লবে সহিংসতা যা-ই হয়েছে তা মূলত রাষ্ট্র কর্তৃক এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামীলীগের ব্যক্তিদের কর্তৃক সংঘটিত। আর, শুরুর দিকে এই বিপ্লবের ভিত্তি ছিল একটি বৈষম্যহীন কর্মব্যবস্থা বা সমাজের দাবি। বিপ্লবের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর ভিত্তি এবং চাওয়াও বদলে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী সরকার এবং সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ-ই একমাত্র দাবিতে পরিণত হয়।

বিপ্লবের এই দাবি বা চাওয়ার পরিবর্তনের পিছনে সরকার কর্তৃক গণহারে নারী-শিশুসহ সাধারণ শান্তিকামী মানুষদের নির্বিচারে নির্মমভাবে হত্যা একটি বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা তো বটেই, একেবারে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে সরকারের পতন ও পরিবর্তন ছাড়া ফ্যাসিবাদ হতে জাতির মুক্তি নেই। ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে জুলাইয়ের বিপ্লব সফল হয়।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের বৈধতা (legitimacy) ও ন্যায্যতার ভিত্তি হলো এ-দেশের ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায়, এবং একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংগ্রাম। বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর অংশীদার ছিলনা। তবে সব-বিরোধী দলের বিগত ১৫ বছরের সংগ্রাম ছিল স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে। জুলাই বিপ্লবের বিজয়ের পর পর অবশ্য সকল বিরোধীদল অর্জিত বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিপ্লবের কারণকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছে। এই-বিষয়টি বিপ্লবের গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতার জন্য অপরিহার্য ছিল।  

বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈধতা নিয়ে রাজনীতি-বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের অনেকের বড় বড় কাজ রয়েছে। এ ব্যাপারে, অন্যান্যদের মধ্যে ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) এবং জুরগেন হেইবারমাস (Jürgen Habermas) এর কাজ উল্লেখযোগ্য। কান্টের তত্ত্ব কিন্তু একটু জটিল এবং সব সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। কান্ট যেমন মানুষের বিপ্লব করার অধিকার বিষয়ে খুবই রক্ষণশীল। তাঁর মতে সভ্য রাষ্ট্রে নাগরিকদের একটি দায়িত্ব রয়েছে রাষ্ট্রের আইন মান্য করা – এমনকি সেই আইন অন্যায্য হলেও। এই-তত্ত্বের নিরিখে, আমাদের জুলাই বিপ্লবকে বিচার করা আদৌ সমীচীন হবেনা। এই দেশে এবং উপমহাদেশে অহিংস বিপ্লব বা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারী সরকারের আদেশ-নির্দেশ ও আইন অমান্য করার ইতিহাস পুরনো। জুলাই বিপ্লবের এক পর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন এবং তাঁরা সচেতনভাবেই কার্ফিউ ভঙ্গ করেছিলেন। এই কার্যক্রমগুলো বিপ্লবকে সফলতা যেমন এনে দিয়েছে, তেমনি বিপ্লবের বৈধতাকেও সমর্থন যুগিয়েছে।

৩.  

এখন ফিরে যাওয়া যাক বিপ্লবের মূলমন্ত্র বা মূলদাবি কী ছিল সে-প্রশ্নে। আর এই প্রশ্নের সাথে জড়িত রয়েছে আমরা বিপ্লব পরবর্তী কেমন বাংলাদেশ চাই তার উত্তর। পূর্বোক্ত পন্ডিত হানাহ বলেছেন, বিপ্লব ‘সামাজিক’ বা ‘অর্থনৈতিক’ প্রশ্নে হতে পারে। দরিদ্র, নিষ্পেষিত, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবে অর্থনৈতিক প্রশ্নই মুখ্য।

আমাদের জুলাই বিপ্লবের মূল ভিত্তি ছিল সামাজিক সাম্য এবং, শেষের দিকে, গণতন্ত্রের পুনরূদ্ধার। সদ্য ক্ষমতাচ্যূত সরকার যখন গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করে তখন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সমতার পরিবর্তে বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুন্ঠন, রাজনৈতিক ও জন-পরিসর থেকে বিরোধীদের বিতাড়ন বা বহিস্কার প্রভৃতি অনাচার প্রতিষ্ঠা পায়।

কাজেই বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলতে হলে এবং জুলাই বিপ্লবে হাজারেরও বেশী আত্নদানকারী এবং কয়েক হাজার আহত মানবসন্তানদের প্রতি সুবিচার করতে হলে আমাদেরকে একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়-ভিত্তিক ও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে মনোনিবেশ করতে হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন ক্ষমতা ও সম্পদ কোনটাই একজন ব্যক্তি বা একটি দল অথবা গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে।

নতূন ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বন্টন এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় জনগণের সমতার-ভিত্তিতে অংশগ্রহণের সুযোগ তথা সামাজিক ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যে কোন ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় যেমনটি হয়ে থাকে, বিগত সরকারের আমলে ধনী-গরীবের ব্যবধান ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিকট রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা চলে গিয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশ সমাজের বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায়, এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ও তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া একটি বহুমত ও বহুদলের গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। বলতে দ্বিধা নেই, এ ধরনের একটি সমাজের স্বপ্ন নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কারণ হিসাবে জনগণের জন্য ‘সমতা, মানবিক-মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়-বিচার’ নিশ্চিত করার কথা ব্যক্ত হয়েছিল। গণতন্ত্র চর্চায় রাজনৈতিক দলগুলোর অনিচ্ছা এবং নির্বাচন ব্যবস্থা কলুষিত করে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধীদের বিতাড়নপূর্বক ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসিকতার কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বারবার পরাস্ত হয়েছে আর সামাজিক ন্যায়-বিচার অধরাই রয়ে গেছে।

সহায়ক-সূত্র

১। হানাহ আরেন্ডট, ‘বিপ্লব’, ১৯৬৩, পেঙ্গুইন সংস্করণ ১৯৯০। ২। স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলসফি, এপ্রিল ২০১০, পরিমার্জিত প্রকাশ ডিসেম্বর ২০২৩। ৩। ইম্যানুয়েল কান্ট, প্র্যাকটিকাল ফিলসফি, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৯৯।

Leave the first comment