উপাধ্যায় আট
১.আওয়ামী নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক চেতনা
শেখ মুজিব-নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ পার্টির সর্বাপেক্ষা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ তড়িৎ গতিতে দেশের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা। তড়িৎ গতিতে মানে বিনা বিচারে সাত তাড়াতাড়িতে নয়। এ তড়িৎ গতির অর্থ স্বাধীনতা হাসিলের অল্প কালের মধ্যে দেশের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনা। এটা বিশেষভাবে প্রশংসনীয় এই জন্য যে এই অঞ্চলের বিশেষতঃ আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য এটা নয়। এখানকার ঐতিহ্য এই যে বিনা-সংবিধানে যতদিনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আকড়াইয়া থাকা যায়। পাকিস্তান আমাদের রাজনৈতিক পূর্বগামীরা শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনায় পাক্কা নয় বছর লাগাইয়া ছিলেন। অধিকতর গণতন্ত্র চেতন আমাদের প্রতিবেশী ভারতও তিন বছরের আগে সংবিধান রচনা সমাপ্তকরিতে পারেন নাই।
সেস্থলে আওয়ামী-নেতৃত্ব স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল গণপরিষদের বৈঠক ডাকেন। তাতে সংবিধান রচনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির মুসাবিদা আলোচনার জন্য সেপ্টেম্বর মাসে গণ-পরিষদের বৈঠক দেওয়া হয়। গণ-পরিষদের দ্বারা সংবিধান গৃহীত হয়। মোট কথা স্বাধীনতা হাসিলের এক বছরের মধ্যে সংবিধান রচনা, গ্রহণ ও প্রবর্তন হয়। ১৬ই ডিসেম্বরে সংবিধান চালু হয়। অত তাড়াতাড়ি করিবার কোন তাকিদ ছিল না। সমসাময়িক নযিরও ছিল না। শেখ মুজিবের দেশে ফিরিবার পরদিনই ১১ই জানুয়ারি তারিখে একটি অস্থায়ী সংবিধান রচনা করিয়া বাংলাদেশের সরকারকে পার্লামেন্টারি সরকারে রূপান্তরিত করা হইয়াছিল। ১৪ই জানুয়ারী শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট পদ হইতে নামিয়া আসিয়া প্রধান মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। এ অবস্থায় শেখ মুজিব যদি শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনায় দুই-চার বছর বিলম্বেও করিতেন, তবু তাঁকে কেউ দোষ দিতে পারিতেন না। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে ছিন্নমূল দেশবাসীকে পুনর্বাসন, ঝড় বন্যা-দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশবাসীকে খাওয়ান-পরান ফেলিয়া সংবিধান রচনা করিলে তাঁকে কেউ কর্তব্য-ছতির এলমও দিতে পারিতেন না।
তবু শেখ মুজিবের নেতৃতে খুব সম্ভবতঃ তাঁর তাকিদে, আওয়ামী লীগ পার্টি শুধু সংবিধানই দিলেন না, তার বুনিয়াদে ১৯৭৩ সালের মার্চের মধ্যে একটা সাধারণ নির্বাচনও দিয়া ফেলিলেন। এত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিবারও কোন তাকিদ ছিল না। ১৯৭০-৭১ সালের নির্বাচনের বলে আওয়ামী লীগ বিনা-তর্কে ১৯৭৪-৭৫ সালতক মেম্বর থাকিতে পারিতেন। একই দিনের নির্বাচনে পশ্চিম-পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) মেম্বররা আজও মেম্বর আছেন।
আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব সংবিধান প্রবর্তনের পরে নির্বাচন দেওয়া তাঁদের গণতান্ত্রিক কর্তব্য মনে করিলেন। গণ-পরিষদের আওয়ামী লীগই ছিলেন একমাত্র পার্টি। অপযিশন বলিতে একজন মেম্বরও ছিলেন না। এমন এক দলীয় গণ-পরিষদ সংবিধান রচনার পর ঐ সংবিধানেই ‘অস্থায়ী বিধান হিসাবে লিপিবদ্ধ করিতে পারিতেনঃ ‘এই গণপরিষদই পার্লামেন্টে রূপান্তরিত ই’ তারপর সেই পার্লামেন্টের আয়ু কতদিন হইবে, কতদিন পরে পার্লামেন্টের নয়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে, এ সব ব্যাপারেই তাঁদের সুবিধা-মত বিধান করিয়া লইতে পারিতেন। আওয়ামী লীগ এসব কিছুই করেন নাই। বরঞ্চ অবিলম্বে নির্বাচন দিয়া পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় আদর্শ নযির স্থাপন করিলেন। এই নির্বাচনের কথা পরে বলিতেছি। আগেশাসনতান্ত্রিক সংবিধানের কথাটাই আলোচনা করিয়া লই।
২. সংবিধানের ভাষিক ক্রটি
আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব কালহরণ না করিয়া শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনায় হাত দেওয়ায় আমি যেমন খুশী হইয়াছিলাম, সংবিধানের মুসাবিদা দেখিয়া তেমন খুশী হইতে পারিলাম না। আমার মনের ভাব আনন্দ বিষাদ মিশ্রিত হইল। একদিকে ভোটারের বয়স-সীমা ১৮ বছরে নামানোতে যেমন আনন্দিত ও গর্বিত হইলাম, মৌলিক অধিকার, শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃতিতে কৃপণতা দেখিয়া তেমনি বিষণ্ণ ও লজ্জিত হইলাম। বাংলা মুসাবিদার পান্ডিত্য ও সাংস্কৃত্য দেখিয়া ঘাবড়াইলাম। খুব চিন্তিত হইলাম। প্রভাবশালী কয়েকজনের কাছে আমার মনের কথা বলিলামও। তাদের কেউ বোধ হয় শেখ মুজিবের কাছে কথাটা তুলিয়াছিলেন। কিছুদিন পরে কয়েকজন আসিয়া এক কপি মুসাবিদা সংবিধান দিয়া বলিয়া গেলেন, প্রধানমন্ত্রী বলিয়া দিয়াছেন : আপনি যা যা সংশোধনী দিবেন, সবই তিনি মানিয়া লইবেন। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সময় আমার খাটুনির যে দশা হইয়াছিল, এবারও তাই হইল। আমি তাই সংবাদপত্রে নিজের কথা বলিয়া সংবিধান রচয়িতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করিলাম। বিশেষ করিয়া দৈনিক ইত্তেফাকে ধারাবাহিক অনেকগুলি প্রবন্ধ লিখিলাম। আমার এই বই যতজন পাঠক পড়িবেন, তার চেয়ে বহু গুণ বেশী পাঠক ইত্তেফাকে আমার ঐসব লেখা পড়িয়াছেন। কাজেই সে সব কথা বিস্তারিতভাবে এখানে আলোচনা করিলাম না। শুধু মূল ক্রুটিগুলির দিকেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলাম।
আমাদের সংবিধানের মূল ত্রুটি দুইটি এক, বিধানের ত্রুটি; দুই, ভাষার ক্রটি। ভাষার ক্রটির আলোচনাটা সহজ ও স্বল্প কাজেই সেই কথাটাই আগে আলোচনা করিতেছি। মাতৃভাষায় আধুনিক দেশের আধুনিক সংবিধান রচনার ইচ্ছা প্রশংসনীয় এবংউদ্যমসমর্থনযোগ্য। বাংলাদেশেরসংবিধান-রচয়িতারা এই কারণে আমার শ্রদ্ধার পাত্র। শাসনতান্ত্রিক সংবিধান একটা আইন। দেশের শ্রেষ্ঠ আইন। গণ-পরিষদের মেম্বরদের বিপুল মেজরিটি আইনবিদ ও আইন-ব্যবসায়ী। তাঁদের জন্য সংবিধান রচনা খুব কঠিন ছিল না। ইংরাজ আমলের দুইশ’ বছর ও পাকিস্তান আমলের পঁচিশ বছর ধরিয়া আদালতের সর্বোচ্চ স্তর বাদে আর সর্বত্র মোটামুটি বাংলাভাষা চালু থাকায় আমাদের দেশে একটা আইনের ভাষা ও সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। কাজেই একটা সহজবোধ্য পরিভাষাও গড়িয়া উঠিয়াছিল। শুধু গণ-পরিষদের মেম্বররা তাঁদের আইন-আদালতের অভিজ্ঞতা লইয়া শাসনতান্ত্রিক আইন রচনা শেষ করিলে কোনও অসুবিধা বা জটিলতা সৃষ্টি হইত না। তাঁরা প্রচলিত সহজ ও পরিচিত শব্দই ব্যবহার করিতেন। কিন্তু তাঁরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনের দলিলটিকে সাহিত্যে উন্নত করিবার ইচ্ছা করিলেন। ভাষা বিজ্ঞানীর সাহিতিকদের আশ্রয় লইলেন। ভাষার পন্ডিতেরা অভিধান ঘাটিয়া সংস্কৃত শব্দের দ্বারা ইংরাজি শব্দের বাংলা তর্জমা করিলেন।
এইখানে সংবিধান-রচয়িতারা শিশুসুলভ সাদা-মাটা একটা চালাকি করিলেন। তাঁরা বলিলেন, মুসাবিদাটি তাঁরা প্রথমে বাংলাভাষায় রচনা করিয়া উহার ইংরাজি তর্জমা করিয়াছেন। কথাটা বলার কোনও দরকার ছিল না। আমাদের দেশের। কনস্টিটিউশনের মুসাবিদা আগেই ইংরাজিতে রচিত হইয়া পরে বাংলায় তার তর্জমা হইয়াছিল, না আগে বাংলা হইয়া পরে ইংরাজিতে অনূদিত হইয়াছিল, এটা বলার বা জানার কোনও দরকার ছিল না। বলাটাও খুব সহজ, নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। কারণ দুনিয়ার বহু দেশেই ইংরাজিতে সংবিধান রচিত হইয়াছে। আমাদের গণ পরিষদের মেম্বারদের অনেকেই তার অনেকগুলি পড়িয়াছেন। পক্ষান্তরে ইতিপূর্বে আর কোনও দেশেই বাংলায় সংবিধান রচনার নযির নাই। অতএব আমাদের রচয়িতারা যদি বলিতেন, তাঁরা দুনিয়ার সব ভাল ভাল সংবিধানগুলি গভীর মনোযোগে পড়িয়া এবং ভাবনা করিয়া প্রথমেই ইংরাজিতে একটা মুসাবিদা খাড়া করিয়াছেন এবং তারপর সেই অনুমোদিত মুসাবিদার বাংলা তর্জমা করিয়া তাই বাংলা ভাষা-বিশারদগণকে দেখাইয়াছন, তবে তাতে আমাদের রচয়িতাদের কোনও অসম্মান হইত না। বাংলা ভাষায় রচিত খসড়া সংবিধানেরই ‘ইংরাজি অনুবাদ’ হওয়ার ফলেই সংবিধানের নং অনুচ্ছেদের শেষে লিখিতে হইয়াছে। বাংলা ও ইঞ্জাজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে। এই একটিমাত্র কথা দ্বারা ভবিষ্যতের জন্য কত যে বিরোধের বীজ বপন করা হইয়াছে, তার হিসাব করা কঠিন। সংবিধানের যে কোনও অনুচ্ছেদের বাংলা ও ইংরাজি পাঠ মিলাইয়া পড়িলেই বোঝা যাইবে যে সুস্পষ্ট সুন্দর ও প্রাঞ্জল ইংরাজি পাঠটির অস্পষ্ট, দুর্বল ও দ্ব্যর্থবোধক অক্ষম, অনুবাদ করা হইয়াছে। সাধারণ আইন-আদালতে বা সাংবিধানিক আদালতে কোনও বিধানের ব্যাখ্যার উপর বিতর্ক বাধিলে সংবিধানের প্রকৃত মর্মার্থ ও আইন-রচয়িতার উদ্দেশ্য হৃদয়ংগম করিতে হইলে ইংরাজি-পাঠটির প্রাধান্য না দিয়া উপায় নাই। অথচ আমাদের সংবিধানে এই কাজটিই নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।
এই ধরনের অনেক জটিলতা সৃষ্টি ছাড়াও অনেক সহজ কাজকে কঠিন করা হইয়াছে। আমরা স্মরণাতীত কাল হইতে সরকারের তিনটি মূল বিভাগঃ এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ ও জুডিশিয়ারিকে যথাক্রমে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ অভিহিত করিয়া আসিতেছি। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর জনগণের কাছেই এই নামে এরা সুপরিচিত। কিন্তু আমাদের সংবিধান-রচয়িতারা বোধ হয় ভাষা-বিজ্ঞানীদের পরামর্শে মৌলিকতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে শাসন বিভাগ না বলিয়া নির্বাহী বিভাগ বলিয়াছেন। অনুবাদের দ্বারা পরিভাষা সৃষ্টির চুলকানি হইতেই এটা করা হইয়াছে।
আমাদের পার্লামেন্টকে ঐনামে না ডাকিয়া জাতীয় সংসদ সংক্ষেপে সংসদ বলা হইয়াছে। জাতীয় সংসদের ইংরাজি ন্যাশনাল এসেম্লি। অথচ আমাদের সংবিধানের ইংরাজি পাঠে একে পার্লামেন্ট বলা হইয়াছে। পার্লামেন্টের সরেনটি ইংলণ্ডের পার্লামেন্টের সভারেনটির অসীম ব্যাপার দ্বারা সুনির্দিষ্ট। আর ন্যাশনাল এসেল্লি বা সংসদের নিজস্ব কোনও সরেনটি নাই; সংবিধান দ্বারা বর্ণিত ক্ষমতাতেই তা সীমাবদ্ধ। এখন ধরুন যদি বাংলাদেশের আদালতে সংসদের সভারেনটি লইয়া তর্ক উঠে, তবে একে কেউ পার্লামেন্টের অসীম সভারেনটির অধিকারী বলিয়া দাবি করিতে পারিবেন না। খোদসংসদ শব্দটারই কোন তাৎপর্যগত অৰ্থনাই।
ঠিক সেইরূপ পরিচিত ইংরাজিশব্দের পরিভাষা রূপে ‘অভিসংশন’, ‘অধিগ্রহণ’ ‘অধ্যাদেশ’ ‘প্রবিধান’ ‘ন্যায়পাল’ ইত্যাদি যেসব অপরিচিত নিরাকার শব্দ ব্যবহার করা হইয়াছে, সেগুলির বোধগম্য অৰ্থ হইতে পারে তাদের নিজ-নিজ ইংরাজি প্রতিশব্দের দ্বারা। হাইকোর্ট ও সুপ্রমিকোর্টের বেলাও উচ্চ-আদালত ও সর্বোচ্চ আদালত বলিয়াই রেহাই পাওয়া যাইবে না। ইংরাজি শব্দের ব্যবহারেই তাদের এলাকা সুস্পষ্ট হইবে। সংবিধানে এটাও নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।
৩. সংবিধানের বিধানিক ক্রটি
ডিমক্র্যাসি, সোশিয়ালিম, ন্যাশনালিষম ও সেকিউলারিমঃ এই চারটিকে আমাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হইয়াছে। এর সব কয়টির আমি ঘোরর সমর্থক। শুধু এমনি সমর্থক না, মূলনীতি হিসাবেও সমর্থক। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক যুগে সব রাষ্ট্রকেই সেকিউলার ডিমক্র্যাটিক নেশন-স্টেট হইতে হইবে।
কিন্তু আমার মত এই যে, এর কোনওটাই সংবিধানে মূলনীতিরূপে উল্লিখিত হইবার বিষয় নয়। গণতন্ত্র ছাড়া আর বাকী সবকটিই সরকারী নীতি-রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। দেশে ঠিকমত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেই আর সব ভাল কাজ নিশ্চিত হইয়া যায়। ভাল কাজ মানে জনগণের জন্য ভাল; জনগণের ইচ্ছামতই সে সব কাজ হইবে। জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সবই জনগণের জন্য, সুতরাং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর। নিরংকুশ গণতন্ত্রই সে কল্যাণের গ্যারান্টি। গণতন্ত্র নিরাপদনা হইলে ওর একটাও নিরাপদ নয়।
এই কারণে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধান করিয়া আর-আর বিষয়ে যত কম কথা বলা যায়, ততই মংগল। সাধারণ কথাবার্তার মতই শাসনতন্ত্রেণ্ড যত বেশী কথা বলা হয়, ভূল তত বেশী হইবার সম্ভাবনা বেশী। সে জন্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে শুধু নিরংকুশ গণতন্ত্রের নিচ্ছিদ্র বিধান করিয়া বাকী সব ভাল কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ পার্লামেন্টের রচিত আইনের দ্বারা তা না করিয়া আইনের বিষয়বস্তুসমূহ সংবিধানে ঢুকাইনে সংবিধানের স্থায়িত্ব, পবিত্রতা ও অপরিবর্তনীয়তা আর থাকে না। নির্বাচনে যে দল বিজয়ী হইবেন, সেই দলই তাঁদের পছন্দমত সংবিধান সংশোধন করিয়া লইবেন, এমন হইলে শাসনতান্ত্রিক সংবিধানের আর কোনও দাম থাকে না।
এই ধরনের একটি বিচ্যুতির কথা বলিয়াই আমি আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের ত্রুটির প্রমাণ দিতেছি। এটা সমাজবাদের বিধান। সমাজবাদ একটা অর্থনীতি। এটাকে সংবিধানের মূলনীতি করার কোনও দরকার ছিল না। যেকোনও গণন্ত্রী পার্টি যদি সমাজবাদ-প্রতিষ্ঠাকে তাঁদের পার্টি-প্রোগ্রাম রূপে গ্রহণ করেন, তবে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের জনগণের বিপুল সমর্থন তাঁরা পাইবেনই। তবু আওয়ামী লীগ পার্টি অনাবশ্যকভাবে সমাজবাদকে সংবিধানের মূলনীতিরূপে গ্রহণ করিয়াছেন। এ ব্যাপারে আমি মুখে-মুখে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী নেতৃবৃন্দকে ভারতের নেতা পন্ডিত জওয়াহেরলালের পদাংক অনুসরণ করিতে উপদেশ দিয়াছিল। বর্তমান যুগে গণতন্ত্রী দুনিয়ায় জওয়াহেরলালই একমাত্র নেতা যিনি আজীবন গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করিয়াছেন।
কিন্তু আওয়ামী নেতারা সংবিধান রচনায় জওয়াহেরলাল-নেতৃত্বের কংগ্রেসের অনুসরণ না করিয়া চৌধুরী মোহম্মদ আলীর নেতৃত্বের মুসলিম লীগকেই অনুসরণ করিয়াছেন। এটা করিয়া আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব সংবিধানের প্রস্তাবনায় মুসলিম লীগের মতই ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন। পাকিস্তানের দুইটি সংবিধানেরই প্রস্তাবনায় বলা হইয়াছে : পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানকে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করিতে চাহিয়াছিলেন। কথাটা সত্য নয়। কায়েদে আযম তাঁর গণ-পরিষদ উদ্বোধনী ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন : ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সহিত ধর্মের কোনও সম্পর্ক নাই।’ পাকিস্তানের সংবিধান-রচয়িতারা নিজেরা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ করিতে চাহিয়াছিলেন বলিয়াই যুক্তি হিসাবে কায়েদে-আযমের নামে ঐ ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছিলেন।
আমাদের সংবিধান রচয়িতারাও তাই করিয়াছেন। প্রস্তাবনায় তাঁরাও বলিয়াছেন : ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শই আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল।‘ তথ্য হিসাবে কথাটা ঠিক না। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র এ্যাকশন কমিটির এগার-দফার দাবিতেই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। এইসব দফার কোনটিতেই ঐ সব আদর্শের উল্লেখ ছিল না। ঐ দুইটি দফা ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি মেনিফেস্টো ছিল। তাতেও ওসব আদর্শের উল্লেখ নাই। বরঞ্চ ঐ মেনিফেস্টোতে ব্যাংক-ইনশিওরেন্স পাট-ব্যবসা ও ভারি শিল্পকে জাতীয়করণের দাবি ছিল। ঐ ‘দফা’ মেনিফেস্টো লইয়াই আওয়ামী লীগ ৭০ সালের নির্বাচন লড়িয়াছিল এবং জিতিয়াছিল। এরপর মুক্তি সংগ্রামের আগে বা সময়ে জনগণ, মুক্তি যোদ্ধা ও শহীদদের পক্ষ হইতে আর কোনও দফা বা মেনিফেস্টো বাহির করার দরকার বা অবসর ছিল না। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ঐ মহান আদর্শকে সংবিধানভুক্ত করিবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তি যোদ্ধাদের নামে ঐ ভূল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।
রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত বা ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহু বার বহু দেশে। সব সময়েই যে তার খারাপ হইয়াছে, তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালও হয় নাই। পাকিস্তানের সংবিধানের বেলায় ইসলাম ও বাংলাদেশের সংবিধানের বেলায় সমাজতন্ত্র, জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতাও তেমনি অনাবশ্যকভাবে উল্লিখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। এসব জটিলতার গিরো খুলিতে আমাদের রাষ্ট্র নায়কদের অনেক বেগ পাইতে হইবে।
পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচনার সময় আমি বলিয়াছিলামঃ পাকিস্তানে ইসলাম রক্ষার চেষ্টা না করিয়া গণতন্ত্র রক্ষার ব্যবস্থা করুন। গণতন্ত্রই ধর্মের গ্যারান্টি। বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতাদেরও আমি বলিয়াছিলাম : বাংলাদেশের সমাজবাদের কোনও বিপদ নাই, যত বিপদ গণতন্ত্রের। গণতন্ত্রকে রোগমুক্ত করুন, সমাজবাদ আপনি সুস্থ হইয়া উঠিবে। পাকিস্তানের নেতাদের মতই আমাদের নেতারাও এই ‘বৃদ্ধের বচন’ শুনেন নাই। ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করিবার চেষ্টায় পাকিস্তানের নেতারা তার অনিষ্ট করিয়াছেন। আমাদের নেতারা ‘সমাজতন্ত্র’কে রাজনৈতিক হাতিয়ার করিবার চেষ্টায় আমাদের রাষ্ট্রের তেমন কোনও অনিষ্ট করিয়া না বসেন, সেটাই আমার দুশ্চিন্তা। আমাদের নেতৃবৃন্দ ও তরুণদের মধ্যে এক শক্তিশালী গোষ্ঠী আছেন, যাঁরা মনে করেন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এক সংগে চলিতে পারে না। পাকিস্তানের চিন্তা-নায়কদের মধ্যেও একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিলেন যাঁরা বলিতেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র এক সংগে চলিতে পারে না। বাংলাদেশের কোনো-কোনো প্রভাবশালী নেতা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়াছেন : ‘যদি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এক সাথে চলিতে নাই পারে, তবে আমরা গণতন্ত্র ছাড়িয়া সমাজতন্ত্র ধরিব।‘ অবশ্য এ কথার জবাবে কোনও-কোনও নেতা এমন কথাও বলিয়াছেন : ‘যদি দুইটা এক সংগে নাই চলে তবে আমরা সমাজন্ত্র ছাড়িয়া গণতন্ত্রই ধরিব।‘ জনগণের উপর নির্ভর করিলে এই ‘ধরা-ছাড়ার’ কোনও প্রয়োজন হইবে না।
কিন্তু বিপদ এই যে আমরা যারা বিপ্লবে বিশ্বাস করি, তারা জনগণের উপর নির্ভর করি না। মাশাআল্লাহ, আমাদের মধ্যে বিপ্লবীর অভাব নাই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপ্লব ও আমাদের সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ বলার লোক নেতাদের মধ্যেই অনেক আছেন। তাঁরা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লড়াই-এর বেলা যদি ‘বিপ্লব’ করিয়া বসেন, তবে গণতন্ত্রের পরাজয় অবধারিত। বীর জনগণকে জিগার্সা না করিয়াই যদি তেমন বিপ্লব হইয়া যায়, তবু সেটাকে বীর জনগণের অভিপ্রায় বলিয়াই চালান হইবে। বলা হইবে পশ্চিমা গণতন্ত্র বুর্জোয়া গণতন্ত্র। তার চেয়ে বিপ্লবী সর্বহারার গণতন্ত্র অনেক ভাল।
আমাদের সংবিধানে তেমন বিপদের সংকেত অনেক আছে। তার মধ্যে প্রধানটি এই যে, নির্বাচিত কোনও সদস্য দলত্যাগ করিলে বা দল হইতে বহিষ্কৃত হইলে তাঁর মেম্বরগিরি আপনা-আপনি চলিয়া যাইবে। এ কথার তাৎপর্য এই যে, ভোটারদের নির্বাচনটা কিছু নয়, পার্টির মনোনয়নটাই বড়। এটা একদলীয় শাসন ও পার্টি ডিক্টেটরশিপের পূর্ব লক্ষণ। পার্টি ডিক্টেটরশিপই পরিণামে ব্যক্তি-ডিক্টেটরশিপে পরিণত হয়। গণতন্ত্রের বিপদ এখানেই।
বিপদ আরও আছে। গণতন্ত্রকে যখন বিশেষণে বিশেষিত করা হয়, তখনই গণতন্ত্রের অসুখ শুরু হয়। পাকিস্তানে ও দুনিয়ার অন্যত্র পাঠকগণ তা দেখিয়াছেন। তেমনি রাষ্ট্রনামের প্রজাতন্ত্রের যদি কোনও বিশেষণ দেওয়া হয়, তখনই সেটাকে ব্যতিক্রম মনে করিতে হইবে। প্রজাতন্ত্র মানেই জনগণের শাসন। সেটাকে যদি গণপ্রজাতন্ত্র বলিয়া ডাবল গ্যারান্টি দেওয়া হয়, তবে সেটা ব্যাসিক ডেমোক্র্যাসির রূপ ধারণ করিলে বিস্ময়ের কিছু থাকিবে না।
রিপ্রিন্ট ফ্রম: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর। উপাধ্যায় আট। পৃষ্ঠা ৬১৫, আবুল মনসুর আহমদ। প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯। খোশরোজ কিতাবমহল, ২০১৩।