জনবিতর্ক

আবু তাহের তারেক

আমার দেখা শরীফ ওসমান হাদী

December 22, 2025   0 comments   1:29 pm

তিনি ছিলেন একই সাথে প্রজ্ঞাবান, রহস্যময় লোক। অনেকটা খোয়াজ খিজিরের মতন। অধরা। গুলি খাওয়ার কিছুদিন আগে দেখলাম, কেউ কেউ উনারে ‘সঠিক পথের পথিক’ বলতেছেন। বেপারটা আমার খুব ভাল লাগল না। কাউরে সঠিক পথে আছেন বলার অর্থ হইল, তার ফিউচার জার্নিরে কন্ঠকময় কইরা তোলা। আমি লেখলাম, ‘সঠিক পথের ওসমান হাদি ভাই’ নামক কবিতা। স্যাটায়ার বলা যায় এরে। গুলি খাওয়ার পরে অবশ্য, একই নামে আরেকখান কবিতা লেখলাম। এইটা সিরিয়াস বটে! কারণ, ওসমানরা খোয়াজ খিজিরের মতন আসেন। সঠিক পথের একখান রূপ দর্শাইবার লাগিই আসেন যেন বা।

Share

সীমান্ত শরীফ, বা অধুনা ‘শরীফ ওসমান হাদি’র কাছে আমার একটা অপরাধ জমা আছে। তিনি আর ইহজগতে, আমার সেই ভুল মাফ করতে পারবেন না।

সীমান্ত শরীফ একদিন আমারে ইনবক্সে নক করলেন। তান পয়লা কিতাব ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’ আমারে পড়তে দিতে চাইলেন। আমি সানন্দে তান প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। আমার ইমেইল দিলাম।

‘লাভায় লালশাক’ কিতাবখানা মার্কেটে বাহির হইবার আগে আগে, আমি হাসান রোবায়েতের একখানা কিতাবের সমালোচনা করি। আমার অনুমান, এই সমালোচনা দেইখাই, তিনি উৎসাহিত হইছিলেন আমারে তান বইখানা দিতে। যাতে এইটা নিয়া আমি কিছু লেখি। ঘটনাটা দুই হাজার তেইশ-চব্বিশের হইব (উনার ইমেইলটা আমি আমার মেইলবক্সে সার্চ দিয়া এখন আর পাইতেছি না।)

বলা ভাল, আমি খুব একটা বিদ্রোহী গোছের কবি নই। আমার কবিতার ধরণ শান্ত। কিছুটা ইসথেটিকপ্রবণ। আমার কবিতায় দ্রোহ যদি থাকেওবা, তার প্রকাশ সংহত। ফলত, আমার পক্ষে সীমান্ত শরীফকে হজম করা কঠিনই ছিল। ‘লাভায় লালশাক’ নাম হিসাবেও খ্যাত বটে! মানে, আমার টেস্টের দিক দিয়া আর কি (পরে অবশ্য এই অদ্ভুত নামকরণ আমার খুব ভালা লাগে)!

উনার বই পড়তে শুরু করার আগে আমি খুব একটা জাজমেন্টাল ছিলাম না। অবশ্য, পাঠ শুরু করার পরে, উনার কবিতার নজরুল আর আল মাহমুদীয় গন্ধ আমি নিতে পারলাম না। বলা বাহুল্য, সীমান্ত শরীফ অতিরিক্ত পরিমাণ কানই আর আমা তাড়িত। তাদের শব্দগত দ্যোতনা, ভাষা-গঠনের রীতি হইতে শুরু করে, তাদের দ্রোহী মনোভাব দ্বারা তিনি ভীষণ জারিত।

ফলত, আমি পয়লা পাঠে (যা ছিল মূলত স্কিমিং) উনার কবিতায় উনার নিজের কুনু সিগনেচার পাই নাই। এই কারণে, পুরা বইটা পড়িও নাই। পরে যখন উনার লগে আলাপ হয়, আমি এইটাই বলি উনারে। যে, তান কবিতায় আধুনিক কবিতার প্রভাব বেশী। কিন্তুক, আমরা ত আধুনিকতা পার হইয়া আসছি! জবাবে, সীমান্ত শরীফ বিনয়ীই ছিলেন। ‘জ্বি’, ‘হ্যা’ বইলা আলাপ শেষ করলেন।

আমার মন তখনও খচখচ করতেছিল, উনার কবিতার বেপারে ভালা কিছু বলতে পারি নাই বইলা।  আমি একটা স্টোরি শেয়ার করি তখন। উনার বইয়ের কাভার দিয়া। টাইটেল দেই, ‘আমার বন্ধুর কবিতার বই’ (যতদূর মনে পড়ে, এইরকম কিছু একটা লেখছিলাম। আমার এই স্টোরিটা খুব একটা রিচ পায় নাই। খিয়াল করলাম, বন্ধু লিস্টে না থাকলেও, পারভেজ আলম স্টোরিটা দেখছেন। ফলে, উনি এই ঘটনার স্বাক্ষী থাকবেন। সীমান্ত শরীফ বোধয়, স্টোরিটা দেখেন নাই)।

এরপরে জুলাই আসল। শীমান্ত শরীফ কুনু একদিন ‘শরীফ ওসমান হাদি’ হইয়া গেলেন। জুলাইয়ের দিনগুলা যত আগাইতেছিল, আমরা ততবেশী কাছাকাছিই পাইছিলাম, একে অন্যরে। ৩৬শে জুলাইয়ের রাইতে আমি খিয়াল করলাম, তিনি  ও তার বন্ধুরা হিন্দুদের বাড়ি পাহারা দিতেছেন। এই ঘটনায় আমি যারপরনাই খুশী হইয়া, উনারে থ্যাংকস দিলাম। অবশ্য, পরের কয়েক রাইতও শরীফ হাদীরা মন্দির পাহারা দিছেন কন্টিনিউয়াসলি, আমার ইয়াদ এমন বলতেছে। এইরকম কুনু এক দিনে, তিনি আমারে বলছিলেন, ঢাকায় ‘জিয়াফত’ টাইপের কিছু একটা করা যায় কি না (এক্সাক্ট ওয়ার্ডিংটা আমার মনে আসতেছে না। উনার যেই আইডির ইনবক্সে আমরা আলাপ করি, জুলাইয়ের বেশ কিছুদিন পরে সেইটা উনি ডিএক্টিভেইট করে ফেলবেন, ও উনার নামে আলাদা একটা পেইজ খুলবেন)। আমি একটু রুড আনসারই দিছিলাম- অভ্যুত্থানের মতন জাতীয় ঘটনার পরে, ‘জিয়াফত’ করার চাইতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা অধিকতর ইনক্লুসিভ কাম, এইমতন বলতে চাইছিলাম আমি৷ উনি অবশ্য, সকল ধর্মের মানুষের জন্য, তাদের ধর্ম অনুযায়ী হালাল মাংসের বন্দোবস্ত করবেন বলছিলেন। পরে তারা জিয়াফত, বা এই টাইপের কিছু করছিলেন কি না; খিয়াল করি নাই।

এইরকম এক সময়ে, তিনি লাল জুলাই নামে একখান গান বান্ধেন। আমার অনুমান, আমার ‘লাল জুলাই’ বিষয়ক কর্মকান্ড তান চউখে পড়ছিল। আমি বার বার বলতেছিলাম, জুলাইয়ের একটা নাম দেওয়া দরকার। আর, লাল জুলাই নামখানা সবচাইতে বেশী সুইটেবল। তিনি এমনকি, জুলাই পরবর্তী বিভিন্ন মিছিল-বক্তৃতায়ও বার বার ‘লাল জুলাই’ শুব্দ উচ্ছারণ করেন।

এরপরে, উনার লগে আমার আর পারস্পরিক আলাপ হয় নাই। দুই-তিনবার আমি উনারে কিছু ডিরেকশন দিছি। যে, আপনারা স্পেসিফিক টাইটেল দিয়া মিছিল-মিটিং করেন। দায়-দাবিগুলারে স্পেসিফিক করেন। এইরকম। এইরকম। প্রত্যেকবারই তিনি উত্তরে জাস্ট একটা লাইক দিছেন। কিছু বলেন নাই। হয়ত, জাস্ট ‘হ্যা’ বলছেন। আলাপে যান নাই।

দিন যাইতেছিল এইভাবে। মাস তিনেক আগের ঘটনা। যখন উনার পরিচয় নিয়া সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন আসল। যে, উনি আসলে কি! তখন মোহাম্মদ ইশরাক উনারে কবি হিসাবে উপস্থাপন করছিলেন। ইশরাক বা অন্য কেউ উনার একটা কবিতাও শেয়ার করছিলেন এই সময়ে। আমার মনে হয়, তার পয়লা লাইনটা এমন আছিল, ‘ওয়েস্টফেলিয়ায় এলো আধুনিকতা…’ আমি আবার পড়তে বসলাম উনার বইখানা।  উনারে নিয়া কিছু বলতে না পারার খচখচ আমার যাইতেছিল না। এইবারও, উনার কবিতার ‘আধুনিক’ ভাবসাব আমার পছন্দ হইল না।

কিন্তুক, ‘আমায় ছিঁড়ে খাও হে শকুন’ যখন পড়লাম, সুপ্রিয় সাহার ওয়াল হইতে, তখন তিনি হসপিটালে। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। আমি অস্থির হইয়া আবার পড়তে শুরু করলাম ‘লাভায় লালশাক’ বইখানা। এইবার মনে হইল, আমি একটা ভুল করছি। সীমান্ত শরীফকে চিনতে আমার টু মাচ লেইট হইয়া গেছে! এই কবিতা হইতে দুইটা মোমেন্ট শেয়ার করি-

“খোদাকে বললাম, আমি মরতে চাই

তিনি বললেন, বেঁচে আছ কে বলল?”

“দোহাই শুধু মস্তিষ্কটা খেয়ো না আমার

তা হলে শীঘ্রই দাস হয়ে যাবে তোমরাও।”

প্রথম কোটেশনে ফিরে আসি। আল্লা কবিরে কইতেছেন, সে জিন্দা না। তাহলে, সে কি মূর্দা! মাওলানা রুমির কবিতার একটা পদ এমন-

“This place is a dream.

Only a sleeper considers it real.

Then death comes like dawn”

হজরত আলীর বরাতে একটা মশহুর উক্তি আছে-

“People are asleep, and when they die, they wake  up.”

ইসলামী সাইকোলজির একটা কৌর জায়গা হইল এই ড্রিমি কন্ডিশন। আদতে, ইসলামি দুনিয়ায় যারা যত বড় সাইকোলজিস্ট, তাদের অনেকেই ততবড় সুফি-দার্শনিকও। সুফি ট্রাডিশনে হজরত আলী বা রুমির মাক্বামও উচার দিকে।

সুফিরা আমাদের আত্মারে জাগাইবার কথা বলেন। আধুনিক সাইকোলজিতেও, ‘কনশাসনেসের’ উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘কনশাস’ হওয়া মানে চউখ-কান খোলা রাখাই নয়। কার্ল ইয়ুং এর মতে, ‘কনশাস’’ হওয়ার জন্য আপনার ‘আনকনশাসরে’ বুঝাও জরুরি।

অবশ্য, কবি সীমান্ত শরীফ এইখানে সাইকোলজি বা ইসলামি বিশ্ববীক্ষাতে সীমাবদ্ধ নন। পরের লাইনেই তিনি বলেন-

“সহস্রাব্দ উন্নয়নের স্বাক্ষী হিসেবে

রাজা তোমাকে মমি করে রেখেছেন”

এই রাজা মোটেও খোদাতায়ালা নহেন। তিনি মানুষের হর্তাকর্তা হিসাবে, দুনিয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসেন। এমন দুনিয়ায় আমাদের মুক্তির পথ ক্ষীণ। আর তাই, কবি ‘শহীদ’ হওয়ার বাসনা পোষণ করেন। কারণ, আত্মার নতুন জাগরণের জন্য, পুরাতন আত্মাকে ছেড়ে আসা চাই। আবার পড়ুন রুমির উদধৃতিটা:

“Then death comes like dawn.”

কবি তাতে মোটেও বেজার নন। তাই বলেন,

‘’আমায় ইচ্ছেমত ছিঁড়ে খাও তোমরা।’’

কিন্তুক, তিনি কাউরে তার মাথা খাইতে দিতে রাজি না! এইখানে আল্লামা ইকবালের প্রেরণা থাকা সম্ভব। ইকবালের দ্রোহ মোটাদাগে ইন্টেলেকচুয়াল। কবি সীমান্ত শরীফ বিহগদেরকে তার মস্তিস্ক খাইতে দিতে চান না, কারণ এইটা অগণিত বিদ্যুৎচমক ধারণ করে (আল ইলমু নু’রুন)।

অবশ্য, মস্তিষ্ক দিয়ে এইখানে অনেক কিছুই রেফার করা সম্ভব। এইটা মুসলমানের জ্ঞানগত ঐতিহ্যরে বুঝাইতে পারার সম্ভাবনাই বেশী। আদতে, কবি এই লাইন মোটেও ভিনদেশী ঈগল, চিল বা বাজদের জন্য লেখেন নাই। তিনি তার পাঠকরে বলতে চাইছেন, ইলিমের ভিতরে এমন এক তাজাল্লি আছে, যার মাধ্যমে আমরা ইহজাগতিক বাইচা থাকার ভিতরে যে মৃত্যুদশা বা ড্রিমি জগত, তারে পার হইয়া আসতে পারি। কনশাসনেস বা নির্বাণে প্রবেশ করতে পারি।

সীমান্ত শরীফের ‘আমায় ছিঁড়ে খাও হে শকুন’ কবিতায় যে আধুনিকতার ব্যবহার, তা কবির দুর্বলতা নয়। এইটা মূলত, ঐতিহ্যের প্রতি তান শ্রদ্ধা নিবেদন। এই কবিতার ভিতরে যে সুফীগত ও ইকবালীয় প্রেরণা গ্রন্থবদ্ধকরণ- এইটা তান ‘ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’। মাঝে মাঝে আর্কেয়িক হওয়াও শক্তির পরিচায়ক। এই কবিতার মাধ্যমে সীমান্ত শরীফ কাব্যে তান প্রভাবের লাইনই আমরারে দেখান নাই, তিনি যে বাংলাদেশের কবিতায় নয়া ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈয়ার করতেছিলেন, তাও এতে পষ্ট।

হাদির ‘লাভায় লালশাক’ কিতাবে এইরকম একখান বা দুইখান কবিতাই পাইবেন না। পাঠের মতন বেশকিছু কবিতা আপনে খুইজা পাইবেন বইলা আমাদের বিশ্বাস। এই যেমন, একটা কবিতা শুরু হইছে এইভাবে-

“তোমার সাথে আমি জুলুম করেছি ইয়াজিদ।”

মানে, এজিদের লগে আবার জুলুম করা কিরকম। এইটা কেমনতরো বিরোধাভাস!

লাভায় লালশাক বইয়ে প্রেম বা দ্রোহের কবিতাই বেশি। এইগুলাতে মোটামুটি একটা আল মাহমুদীয় জগত উইথ নজরুলীয় দ্রোহস্বভাব জারিত আছে। এইবারের পাঠে, আমি একটু ভিন্নতর স্বাদের কিছু খুজলাম। তা পাইলামও!

আমরা আধুনিক কবিতা বলতে বাংলা লিটারে যা বুঝি, তা মূলত শব্দপ্রবণ। ছান্দসিক। রূপ প্রধান। এই জায়গায়, আল মাহমুদ কিছুটা গদ্যভংগিমা ও ভাবুকতা নিয়া আসেন। আমাদের সাম্প্রতিক কবিতা গদ্যভংগিমায় ও ভাবের জায়গায় আরেকটু উৎকৃষ্ট। বিশেষ করে, এই সময়ের কবিতায় শব্দের ঝনঝনানি বা অলংকারের দেখানিপনার চাইতে, ছবি আকা বা আগাগোড়া একটা ভাব জারিত করায় বেশী মশগুল। এইরকমই একটা কবিতা ‘বোবার আবার বর্ণমালা’। আহমদ ছফার উপন্যাসের বোবা মহিলাটার মতন সে। তার বর্ণমালা আছে। অথচ, কথা কইতে পারে না। এমন এতিম সে!

‘লাভায় লালশাক’ কবির পয়লা বই। বয়সের দিক দিয়াও, সীমান্ত শরীফ অতটুকু প্রৌড় ছিলেন না। তার আছিল বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি হইয়া উঠার অবারিত সময়। তিনি যখন বাইচা আছিলেন, তখন তারে এই কথাটা বলতে পারলাম না। আমার এই ভুল কি উনারে কবিতা হইতে বিমুখ করল! পলিটিকসে সরায়া দিল! নাকি, ‘শরীফ ওসমান হাদি’ হইয়া উঠার লাগিই, তিনি বিচিত্র রূপ ও খোলসের ভিতর দিয়া যাইতেছিলেন!

ওসমান হাদির কৃতিত্ব এই, যে তিনি কবিতায় ‘বহু’রে ধারণ করতে চাইছেন। তার কবিতার ‘আমি’ খুব অল্প ক্ষেত্রেই ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ আমি। এই ‘আমি’ আমরা সবাই। একইভাবে, এক্টিভিস্ট হিসাবে, তিনি ইসলামের নির্দিষ্ট কুনু ঘরানারে প্রমোট করেন নাই। তার আশেপাশে টাইনা নিছেন বিচিত্র মত ও পথের মানুষরে। এইমতন, তিনি এই অঞ্চলে নেতা হইবার একটা ‘আদল’ বাতলাইয়া দিতেছিলেন আমরারে। আমাদের বিশ্বাস, কালচারে ইন্টারভেনশন করার তাগিদ হইতে ইনকিলাব মঞ্চ খুললেও, তিনি কালচারের বিচিত্র স্রোত ও গতির বেপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি ধ্বংসাত্বক নয়, গঠনমূলক রাজনীতিই স্থাপন করতে চাইছিলেন, কালচারের ক্ষেত্রে।

আমাদের ট্রাডিশনাল কালচারের অনেক কিছুই অপছন্দ করেন, এমন অনেকের মনেও কালচারের ধারণা প্রবিষ্ট করাইতে পারছিলেন তিনি। ওসমান হাদি বাংগালি কালচার বনাম ইসলামি কালচার, সালাফি ইসলাম বনাম সুফি ইসলাম, রাষ্ট্র বনাম ধর্ম ইত্যাদির মইদ্যকার আরোপিত দেওয়ালগুলা অনেকটাই ব্লার কইরা দিতে সক্ষম হইছিলেন।

তিনি ছিলেন একই সাথে প্রজ্ঞাবান, রহস্যময় লোক। অনেকটা খোয়াজ খিজিরের মতন। অধরা। গুলি খাওয়ার কিছুদিন আগে দেখলাম, কেউ কেউ উনারে ‘সঠিক পথের পথিক’ বলতেছেন। বেপারটা আমার খুব ভাল লাগল না। কাউরে সঠিক পথে আছেন বলার অর্থ হইল, তার ফিউচার জার্নিরে কন্ঠকময় কইরা তোলা। আমি লেখলাম, ‘সঠিক পথের ওসমান হাদি ভাই’ নামক কবিতা। স্যাটায়ার বলা যায় এরে। গুলি খাওয়ার পরে অবশ্য, একই নামে আরেকখান কবিতা লেখলাম। এইটা সিরিয়াস বটে! কারণ, ওসমানরা খোয়াজ খিজিরের মতন আসেন। সঠিক পথের একখান রূপ দর্শাইবার লাগিই আসেন যেন বা।

তার পথচলায় অনেক ত্রুটি ছিল। পপুলিজম ছিল। আর ছিল অবোধ্য সময়রে নিজের হাতের মুঠোয় নিবার সুপারহিউম্যানসুলভ গতি-পকরিতি। সে একটা আশ্চর্য জাদুবলে ফার রাইট হইতে ফার লেফট সকলের সিম্প্যাথি পাইবার মতন চরিত্র গঠন করে। তার কারণ মে বি, যত ভুল ভ্রান্তিই থাকউক তার কর্মপদ্ধতিতে, সে হামেশা পিপলরে বেইজ করতে চাইছে। দেশরে অউন করতে চাইছে। জীবনের জন্য ‘লড়াইরে’ হাসিমুখে মাইনা নিছে। ওসমান হাদি আমাদেরকে অনেকভাবেই পথ দেখাইতে সক্ষম।

নিচে, শরীফ ওসমান হাদির আমাকে ছিঁড়ে খাও হে শকুন কবিতাখানা রাখলাম।

//আমাকে ছিঁড়ে খাও হে শকুন//

হে সীমান্তের শকুন

এক্ষুণি ছিঁড়ে খাও আমাকে

হে আটলান্টিকের ঈগল

শিগগির খুবলে খাও আমাকে

হে বৈকাল হ্রদের বাজ

আঁচড়ে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করো আমাকে৷

আমার রক্তরসে শুধু অসহায়ত্ব আর অভাব;

কাগজের কামলারা তারে আদর করে মুদ্রাস্ফীতি ডাকে।

ঋণের চাপে নীল হয়ে যাচ্ছে আমার অনুচক্রিকা

সংসার চালাতে অন্তরে হয় ইন্টারনাল ব্লিডিং

কী আশ্চর্য, তবুও আমি মরছি না!

ওদিকে দোজখের ভয়ে

আত্মহত্যা করবারও সাহস পাই না আমি!

খোদাকে বললাম, আমি মরতে চাই

তিনি বললেন, বেঁচে আছ কে বলল?

সহস্রাব্দ উন্নয়নের সাক্ষী হিসেবে

রাজা তোমাকে মমি করে রেখেছেন!

বাজারে দীর্ঘশ্বাস ফেললে নাকি

রাজ্যের ভীষণ বদনাম হয়

রাজারও মন খারাপ হয় খুব।

কোতোয়ালরা ফরমান জারি করেছে

আমাকে সারাক্ষণই হাসতে হবে!

নইলে দেশি কুকুর ও বিদেশি মাগুরকে

একবেলা ভালোমন্দ খাওয়ানো হবে আমার মাংস দিয়ে

নিত্যদিন ব্রয়লারের ভুঁড়ি নাকি ওদের ভাল্লাগে না!

অথবা আমাকে ভাগ দিয়ে বেচা হবে

মানুষেরও তো মানুষ খাওয়ার সাধ হতে পারে, তাই না?

ভাগ্যিস তা বিদেশি সুপারশপে বিক্রি হবে না

দেশি মানুষেরই তো হক বেশি আমাকে খাওয়ার!

এ দোজখই যখন নিয়তি

তখন আমি উদাম হয়ে ডাকছি

দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মাংসাশী বিহগদের

হে ঈগল, চিল ও ভয়ংকর বাজেরা

হে সাম্রাজ্যবাদী সাহসী শকুনিরা

তোমরা এফ-থার্টি ফাইভের মতো

মিগ টুয়েন্টি নাইনের মতো—

দল বেঁধে হামলে পড়ো আমার বুকে

আমার রান, থান, চক্ষু, কলিজা

আজ সব তোমাদের গনিমতের মাল

দেশি শুয়োর খুবলে খাওয়ার আগেই

আমায় ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে খাও তোমরা!

দোহাই শুধু মস্তিষ্কটা খেয়ো না আমার

তা হলে শীঘ্রই দাস হয়ে যাবে তোমরাও।

Leave the first comment