১৯৪৭ সালে কলকাতার হিন্দুত্ববাদী নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বাধার মুখে অখণ্ড বাংলা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হতে পারেনি। তখন পূর্ববঙ্গ (আজকের বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এ প্রসঙ্গে বলেন, আপাতত আমরা এটা মেনে নিলাম।
পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাওয়ায় বৃটিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে জমিদারি পেয়েছিলেন যে হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগীরা; তারা কলকাতায় তাদের সেকেন্ড হোমে চলে যেতে বাধ্য হন। সেই পূর্ববঙ্গের জমিদারি হারানোর বেদনা একদিনের জন্য ভুলতে পারেননি তারা। বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই জমিদারি পুনরুদ্ধারের সংকল্প আরো ঋজু হয়েছে।
কলকাতার ১৯৪৭-এর সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি থেকে ২০০৮-এর প্রণব মুখার্জি; পূর্ববঙ্গের জমিদারি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের ধণুক ভাঙ্গা পণের এতোটুকু নড়চড় হয় নি। প্রণব মুখার্জি তার আত্মজৈবনিকে উল্লেখ করেছেন, কীভাবে তিনি এক এগারোকালের সেনা প্রধান মইন উ আহমেদকে নতুন দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে মহীনের ঘোড়াগুলি উপহার দিয়ে ভারতের মনোনীত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনার সমঝোতা করেন। ভারতের সুজাতা সিং কি করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বানাতে ঢাকায় এসে প্রকাশ্যে কার্যকলাপ চালিয়েছেন; সেটা বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া অনেক ভিক্টিমের বয়ানে উঠে এসেছে কিভাবে ইন্টেরোগেশন সেলে হিন্দি ভাষায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা; তাদের স্থানীয় এসেটদের এই জিজ্ঞাসাবাদে অংশ গ্রহণের নজির আছে। বাংলাদেশ থেকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ভারতে খুঁজে পাওয়া ছিলো নিত্য নৈমিত্তিক এক ঘটনা। এমন কি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ভারতীয় গোয়েন্দাদের অফিস কক্ষ স্থাপন করে নজরদারির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি ডিকটেট করেছে দিল্লির সাউথ ব্লক। কে সেনা প্রধান হবে, কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না; এসবই নির্ধারণ করেছে ভারতীয় প্রশাসন। তাই তো হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন রাখঢাক না রেখে বলেন, আমি দিল্লিতে গিয়ে বলে এসেছি, যেভাবেই হোক হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ভারত ঠিক তো আমরা ঠিক। ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচন ও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের আগে আওয়ামী নেতা হাসান মাহমুদ ও মোহম্মদ আরাফাতদের আমরা দেখেছি দিল্লির ক্ষমতাসীন বিজেপি অফিসে গিয়ে বাংলাদেশ শাসনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নবায়ন করতে। এমনকি গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদেরও দিল্লি গিয়ে অনুকম্পা ভিক্ষা করে আসতেন।
সবশেষে জুলাই বিপ্লবে আহতদের মুখ থেকে আমরা শুনলাম, জুলাই বিপ্লবে হাসিনার লেলিয়ে দেয়া খুনে বাহিনীতে হিন্দিভাষী ভারতীয় কোটাল পুত্র উপস্থিত ছিলো; যারা অত্যন্ত রুক্ষ্ম আচরণ করেছিলো।
এই পুরো দৃশ্যপট বিবেচনায় জুলাই বিপ্লব আসলে ছিলো ভারতীয় উপনিবেশ সরিয়ে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লড়াই। শেখ হাসিনা ভারতের এসেট মাত্র, যাকে ভারত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে তাদের অনুচরদের মাধ্যমে বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিল্লিতে নিয়ে গেছে।
ভারতের বয়স্ক নীতিনির্ধারকরা ২০০৮-২৪ বাংলাদেশে বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থীদের রণকৌশল অনায়াসে বুঝতে পারতেন। ফলে হাসিনাকে ভোটহীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু জেনারেশন গ্যাপের কারণে জুলাই বিপ্লবের তরুণ-তরুণীদের রণকৌশল একেবারেই বুঝতে পারেননি তারা। ২০২৪ সালে ১৬ জুলাই থেকে ভারতীয় মিডিয়া তাদের বহু ব্যবহারে জীর্ণ বয়ান প্রচার করেছে। জুলাই বিপ্লবকে ইসলামপন্থীদের দুবৃত্তপনা বলে তকমা দিয়ে মুখে ফেণা তুলে ফেলেছিলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী চিন্তাকামানেরা। কিন্তু অল্পবয়েসী তরুণ ও তরুণীদের সমন্বয়ে জুলাই হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবার আকাংক্ষার বিস্ফোরণ। ফলে পথে নেমে আসতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি আবাল বৃদ্ধ বণিতা।
জুলাই বিপ্লবের তরুণ তরুণীদের রণকৌশলের আরেকটি মাস্টার স্ট্রোক ছিলো নোবেল বিজয়ী ড মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত করা। কারণ ড ইউনুসের বিশ্বব্যাপী যে গ্রহণ যোগ্যতা তার ধারে কাছে নেই ভারতের সমকালের নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা। এতে করে ভারতীয় মিডিয়ার বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডা পশ্চিমে মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের মতো শুনিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জনমানুষ সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার স্বাদ পেয়েছে পুরোপুরি।
ভারতের কলকাতায় বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় যে হিন্দুত্ববাদী বেঙ্গল রেনেসাঁ ঘটেছিলো; সেখানে কৃত্রিমভাবে নির্মিত বাঙালি সংস্কৃতিকে পূর্ববঙ্গের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এরফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর কলকাতার হিন্দুত্ববাদী বাঙালি সংস্কৃতির ব্যাপ্টিজমকেই প্রগতিশীলতা বরণ বলে কল্পনা করতে শুরু করে শিক্ষিত প্রজন্ম। এই ব্যাপ্টিজমে সাংস্কৃতিক উচ্চ বর্ণ হবার লোভ ছিলো। কলকাতার ঢঙ্গে কথা বললে, রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দুলালে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের নারী ও পুরুষের মতো পোশাক পরলেই তা প্রগতিশীলতার গজদন্তের মিনার; এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয় শিক্ষিত প্রজন্মের মাঝে। পুজোর অনুষ্ঠান প্রগতিশীলতা আর নামাজে অংশগ্রহণ রক্ষণশীলতা, গীতা মহাভারত ও রামায়ণের আলাপ অসাম্প্রদায়িক আর কুরান-হাদিস নিয়ে আলোচনা সাম্প্রদায়িক, নমস্কার বলা আধুনিকতা আর সালাম-আদাব দেয়া পশ্চাদপদতা; এমন হীনমন্যতায়; সংস্কৃতি দুপুরে আড্ডায় ইসলাম নিয়ে হাসাহাসি প্রগতিশীলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনদ লাভের পূর্ব শর্ত ; এইভাবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল।
এর গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করে রেখেছিলেন, বেঙ্গল রেনেসাঁর লেখক বংকিম চন্দ্র। তিনি পূর্ব বঙ্গের মানুষকে নিম্নবর্গের মানুষ বলে রায় দিয়ে দেন। “তুইতো নমশুদ্দুর থেকে মুসলমান” হয়েছিস; এই ধমক শুনে বড় হওয়া নারী-পুরুষ তাই কলকাতার দেয়া “বাঙালি” সার্টিফিকেট পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। শরতচন্দ্র তার কথাসাহিত্যে লিখেছিলেন, বাঙ্গালিদের সঙ্গে মুসলমান বালকদের ফুটবল ম্যাচের কথা। তাই বাঙালি হতে বাংলাদেশের কালচারাল উইং-টি ভারতের স্থানীয় প্রতিনিধি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে দিনমান কাজ করে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভারত বর্ণনা করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে। সে কৃপা করে পাকিস্তান উপনিবেশ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। সুতরাং সারাজীবন ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপনিবেশে বসবাস করতে হবে। আর এই উপনিবেশের দেওয়ানির ওপর একচ্ছত্র অধিকার তাদের একমাত্র প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের। ভারত তার পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় দাদাগিরি করতে পারবে না; তাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে; এই বাস্তবতা কখনো স্বীকার করে না। মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তারা, মুক্তিযুদ্ধ ছিলো বাংলাদেশের সেনা-পুলিশ-মেহনতী মানুষের রক্ত ও ত্যাগের ফসল। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং-এর কাজ ছিলো কিভাবে বয়ান তৈরি করতে হয়; তা ঠিক বেঙ্গল রেনেসাঁর কলকাতায় বসে শেখা। সেই বয়ানের খেলা চলছে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছর ধরে।
ফলে জুলাই বিপ্লব থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একজন নেতা ও কর্মীর মাঝে অনুতাপের কোন চিহ্ন নেই। যে লোকটিকে দেখবেন সারাক্ষণ সত্য সুন্দর ও মঙ্গল নিয়ে আলাপ করছে; যার ফেসবুক জুড়ে এসথেটিকস উপচে পড়ছে; সেও জুলাই বিপ্লবীদের নিয়ে আলাপে নরভোজির মতো হিংস্র হয়ে ওঠে তরুণদের প্রতি। বংকিম ঠিক যেভাবে পূর্ব বঙ্গের মানুষকে নিম্নবর্গের মানুষ বলেছিলেন; আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং-টি একই ঢঙ্গে জুলাই তরুণদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির হয়ে আছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারির কালে; ভাঙ্গা রেকর্ড বেজে চলেছে ভগ্ন জমিদারের বিশীর্ণ গৃহে।
বিএনপি এইমুহূর্তে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল। কিন্তু বিএনপি ভারতের রুদ্র রোষে পড়ে ১৭ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে ক্ষমতায় যেতে অস্থির। ২০০৮ সাল থেকে সে দেখেছে ভারত কিভাবে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় রেখেছে। কিন্তু সে ভূ-রাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতা টের পায়নি বলে মনে হয়। টুইন টাওয়ার হামলার পরে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন মিত্র খুঁজেছিলো। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো সে ভারতের ওপর নির্ভর করেছিলো দক্ষিণ এশিয়ায় তার স্বার্থ দেখার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ইসলামোফোবিয়া ও ওয়ার অন টেররের বাতাবরণে ভারতের ইসলামোফোবিয়ায় সে আস্থা রেখেছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে ভারতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিপর্যয় ঘটে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি দিল্লি। উলটো লাদাখে চীনের সেনাবাহিনীর কাছে কিল খেয়ে কিল চুরি করেছে ভারতীয় সেনারা। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে চলছে ইন্ডিয়া আউট পলিসি। চীন সেখানে ঢুকে পড়ছে লোভনীয় বিনিয়োগ নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গেছে ভারত হচ্ছে কথার বাঘ। তাই সে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দিল্লির মাধ্যমে যোগাযোগ করার পরিবর্তে নিজে যোগাযোগের প্যারাডাইমে ফিরে গেছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূত পিটার হাসের সময় থেকে এই দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়েছে।
রাজনীতির গেম থিওরি ফুটবল মাঠের মতো সদা পরিবর্তনশীল। তাই ২০০৮ সালের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ২০২৫ সালে ভারতকে বাংলাদেশে একই রকম প্রভাবশালী মনে করা বড় রকমের চিন্তার ভ্রান্তি। ভারতে সংখ্যালঘুর মানবাধিকার এগারো বছর ধরে লংঘিত হলে, বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন নিপীড়ন বেড়ে গেলে আর দুর্নীতি আকাশচুম্বী হওয়ায়; পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে চলে যায়। কারণ অন্যান্য অনেক অভিযোগ থাকলেও পশ্চিমের গণতন্ত্র সূচকের পরিচর্যা সবসময় চলতে থাকে, একে তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করে।
বিএনপির ত্যাগী নেতা রুহুল কবীর রিজভী ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট মুক্তির আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন জুলাই বিপ্লবী তরুণদের প্রতি। বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান ১৭ বছর লন্ডনে বসবাস করায় পশ্চিমা গণতন্ত্রের মূল্যবোধ আত্মস্থ করেছেন; তার প্রতিটি বিবৃতিতে সেই সযত্ন শব্দ চয়ন লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অতিদ্রুত মন্ত্রীর চেয়ার ও গাড়িতে পতাকা পেতে শশব্যস্ত কিছু বিএনপি নেতাকে আমরা লক্ষ্য করেছি ড ইউনুসের বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা রক্ষার স্পর্শকাতর মুহূর্তগুলোতে পাওনাদারের ভঙ্গিতে গিয়ে বলছেন, নির্বাচন কখন দেবেন! এই যে সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট। বাংলাদেশ যেহেতু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালু উপন্যাসের মতো দুটি মাজারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত; সেইখানে এক রহমানের লীগ অগাস্টে উতখাত হয়ে ভারতে পালিয়ে গেলে গেলে; আরেক রহমানের দল স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন বাংলাদেশ শাসনের অধিকার পেয়ে যান। তাই ৫৪ বছর ধরে যে সংবিধান, আইনি ব্যবস্থা, নির্বাচনী বন্দোবস্ত ফ্যাসিজমের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে তা সংস্কারে একান্ত আপত্তি লক্ষ্য করা গেছে বিএনপির কিছু নেতার মাঝে। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত; তা আসলে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো ক্ষমতার কোলাবরেটরদের জমিদারি লাভের পদ্ধতি হয়ে আছে। একবিংশের নতুন প্রজন্ম সেই জমিদারি ব্যবস্থা ও ভি আই পি কালচারের অবসান চায়। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ লুন্ঠনের ম্যান্ডেট যে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেয়; তা মানবতাবিরোধী। তাই এর পরিবর্তন না করা গেলে ফ্যাসিজম রাক্ষস আবার গুম খুন ক্রসফায়ার ভিন্নমত নির্যাতনসহ মানবাধিকার লংঘনের পুনরাবৃত্তিতে ফিরে যাবে। সেই কুরুক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী কালচারাল উইং-এর ইসলামোফোবিক প্রোপাগান্ডার ছুঁতো ধরে আবার মনপছন্দ কাউকে মহীনের ঘোড়া উপহার দিয়ে ভারত উপনিবেশ ফিরে আসবে তার জমিদারি পুনরুদ্ধার প্রকল্পে। সার্বভৌমত্ব আবার দিল্লির খাঁচায় বন্দী হবে।
এই পুনরাবৃত্তিকর কুরুক্ষেত্র দেখতে রাজি নয় তরুণ প্রজন্ম । বাংলাদেশের তরুণের রক্ত এতো সস্তা নয় যে; বার বার ভারতের বলিখেলায় পাখির মতো শিকার হবে তারা। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আর তাদের অভিভাবকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। কালো টাকা ও পেশী শক্তির ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার চেয়ে জুলাই বিপ্লবের ম্যান্ডেট অনেক শক্তিশালী ও জেনুইন। কারণ তাতে দেশের জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সামষ্টিক অঙ্গীকার জমা হয়ে আছে। কাজেই রোজ রোজ পাওনাদারের মতো অশালীন রেটোরিক জন্ম না দিয়ে নিজ নিজ দলের শৃংখলা ফেরাতে কাজ করা উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর। ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী পেয়ে চাঁদাবাজি, দখল, কুঁড়ে ঘর থেকে রাজপ্রাসাদে ওঠা, গরুর গাড়ি থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার যে অশালীন ভ্যাড়ভেড়ে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি; তা থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক সভ্যতার উঠোনে হাজির হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। আজকের ইন্টারনেট সংযুক্ত বিশ্বরাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও শৃংখলা না থাকলে একদা মুক্তিযোদ্ধা রবার্ট মুগাবেকে যেমন ফ্যাসিস্ট ও আদিম দেখিয়েছিলো; ঠিক তেমনি দেখায় হামবড়া বিগমাউথ হুমকি ধামকি দেয়া ভিলেজ পলিটিশিয়ানদের। চলুন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, নিজেকে রবার্ট মুগাবের মতো দেখাচ্ছে কিনা।