জনবিতর্ক, ভারত প্রশ্ন

সাদ রহমান

ভারতের ‘হিন্দু প্রশ্ন’ ও আমাদের নতুন ভারত প্রশ্ন

November 30, 2024   0 comments   12:03 pm

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হইলো—এই হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের রাজনীতিটা আসলে একান্তই বিজেপির, এবং আগাগোড়া একটা ভারতীয় বস্তু। বাংলাদেশের মানুষ এই রাজনীতিতে অভ্যস্ত না। বাংলাদেশের ইসলামভাবাপন্ন মানুষ রাষ্ট্র ও সরকারে তাদের অংশিদারত্ব চায়, কিন্তু তারা হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের উপর দাঁড়াইয়া জীবন নির্বাহ করে না।

Share

আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যেই আশঙ্কা দেখা দিছিলো, তা ভুল প্রমাণিত হইছে। এইজন্য, বাংলাদেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ্য মুসলিম সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমের তারিফ করতেই হয়। বিশেষ কইরা, দেশের ইসলামি দলগুলা, বা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলা—হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি—ইনারা সকলেই দায়িত্ব ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিছেন। এইটা আমাদের আলাদাভাবে স্বীকার করা উচিত।

আমার তরফ থেকে তাদেরকে সালাম ও ভালোবাসা জানাই।

দুই.

আমার মতে, দুইটা কারণে ভারতের এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্র কাজ করে নাই। প্রথম কারণ, প্রফেসর ইউনূসের সরকার এখন পর্যন্ত এমন কোন ভাবমূর্তি তৈরি করে নাই যার ফলে দেশের ইসলামভাবাপন্ন নাগরিকদের মনে হইতে পারে—এই সরকার তাদের নয়।

এই উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সাধারণ মুসলমান, কড়া মুসলমান, মধ্যপন্থী মুসলামান—এই সবগুলা বর্গই মনে করে প্রফেসর ইউনূসের সরকারে তাদের অংশিদারত্ব আছে। এই সরকারকে তারা নিজেদের সরকার মনে করে। ফলশ্রুতিতে, ভারতের ষড়যন্ত্রকে তারা সরকারের মতোই দায়িত্ব নিয়া হ্যান্ডল করলো।

আমি মসজিদে গিয়া হুজুরদের ওয়াজ ইত্যাদি শুনি না। বাট যারা শুনেন তারা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, আমাদের হুজুররাও এখন প্রচার করতেছেন ‘হিন্দু’ আর ‘আরএসএস’ এক নয়। এই দেশে হিন্দুত্ববাদের জায়গা হবে না, বাট হিন্দুরা আমাদের ভাই-বোন। এইটা প্রফেসর ইউনূসের হাত দিয়া হওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি। পরবর্তী সরকারগুলা এইটাকে ভঙ্গুর না করলে তাদের জন্য অনেক কাজই সহজ হইয়া যাবে।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হইলো—এই হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের রাজনীতিটা আসলে একান্তই বিজেপির, এবং আগাগোড়া একটা ভারতীয় বস্তু। বাংলাদেশের মানুষ এই রাজনীতিতে অভ্যস্ত না। বাংলাদেশের ইসলামভাবাপন্ন মানুষ রাষ্ট্র ও সরকারে তাদের অংশিদারত্ব চায়, কিন্তু তারা হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের উপর দাঁড়াইয়া জীবন নির্বাহ করে না।

এইদিক থেকে বাংলাদেশ বৈশিষ্ট্যগতভাবে একটা সেকুলার রাষ্ট্রই। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম যতোই ইসলাম থাকুক, সেটা তার অংশিদারত্বের প্রশ্ন। কিন্তু কোনভাবেই এই ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ মানুষের প্রধান কনসার্নের জায়গা না। ফলত, এক হিন্দু নেতার গ্রেফতারকে কেন্দ্র কইরা যেভাবে সারা আদালত প্রাঙ্গন রক্তারক্তি হইয়া গেলো, এবং একপর্যায়ে বিরোধী পক্ষের আইনজীবীকেও কোপাইয়া মাইরা ফেলা হইলো—এইসব দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই আজনবি বা অপরিচিতি লাগছে।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক চরিত্র এইরকম নয়। এই ‘অসাধারণত্ব’টা টের পাওয়ার পর মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারছিলো, এইখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ইনভলবেমন্ট আছে। এবং বিজেপির হাত আছে।

ফলে মানুষ নিজেই ভারতের গোয়েন্দাদেরকে আলু পোড়া খাওয়াইয়া দিছে।

তিন.

আপনাদের মনে থাকার কথা, আসামে ‘নাগরিকপঞ্জি’ তৈরির নামে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’দেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাইয়া দেওয়ার ক্যাম্পেইন চালাইছিলো বিজেপি। এইটা সম্ভবত মোদীর প্রথম মেয়াদের কথা। ক্যাম্পেইনটা ‍বাস্তবেই বড় আর ভয়াবহ ছিলো।

কিন্তু এর বিপরীতে দেখেন, বাংলাদেশে ‘ভারত’কে কেন্দ্র কইরা এইরকম কোন রাজনীতির নজির বা সম্ভাবনা কোনটাই কি আছে? যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন নিশ্চয়ই, আসামে ‘নাগরিকপঞ্জি’ কইরা যাদেরকে বাদ দেওয়া হইছিলো তারা কোন নতুন মাইগ্রেন্ট ছিলেন না। বরং পুরাতন ও একাত্তর-পূর্ব অভিবাসীরাই এই রাজনীতির শিকার হইছিলেন। এর অর্থ, বিজেপির এই পুরা ক্যাম্পেইনটাই ছিলো কমপ্লিটলি অবাস্তব।

তার কিছুদিন পরে, ‘হিন্দু ভারত’কে আরো জোরদার করার লক্ষ্যে বিজেপি ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন’ পাশ করাইলো। যেই আইনে মুসলমান বাদে অন্য সব ধর্মের অভিবাসীদেরকে সহজে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইলো।

একটু হিসাব করলেই বুঝবেন, বাংলাদেশে আগামি তিরিশ-পঞ্চাশ বছরেও হিন্দুদেরকে ‘সেকেন্ড ক্লাস’ কইরা দেওয়ার জন্য এইরকম কোন আইন পাশ করার ঘটনা হটবে না। ‘নাগরিকপঞ্জি’ তৈরি কইরা, ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইন’ কইরা দেশ থেকে নিজ মানুষকে বিতারিত কইরা দেওয়া যায়—এই জিনিসটাই বাংলাদেশের মানুষ ও রাজনীতিবিদরা এখনো ভাইবা উঠতে পারে নাই। ভবিষ্যতেও পারবে না।

উদাহরণ দুইটা আমি সামনে আনলাম, তার উদ্দেশ্য এটাই যে—হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি নষ্টের এই রাজনীতিটা যে আগাগোড়াই একটা ‘ভারতীয় বস্তু’ তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এই সহজ সত্যাটা সবারই মনে রাখা জরুরি। এইটা ভুইলা গেলে আমরা মুসলমান সম্প্রদায়কে দড়ি দিয়া বান দিতে গিয়া তাদেরকে এনিমি কোর্টে চালান কইরা দিতে পারি।

ভারতে মুসলমানদেরকে নিয়া রাজনীতি হয়, এবং বিজেপি চায় বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে রাজনীতির বিষয় কইরা তুলতে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক প্রশ্নে—আলাদা কোন ‘হিন্দু প্রশ্ন’ নাই। আমরা আলাদা কইরা ‘হিন্দু প্রশ্ন’ তুলতে চাই না।

চার.

আমার ব্যক্তিগত বিবেচনা বলে, ভারত এই মুহূর্তে যেই ষড়যন্ত্র চালাইতেছে, তার প্রধান উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে ফিরাইয়া আনা না। কারণ হাসিনাকে ফিরাইয়া আনা কোন যৌক্তিক চিন্তা না। ভারতের নিরাপত্তাবিদরা গাধা হইতে পারেন, কিন্তু এতোও গাধা না। বরং ভারতের জন্য যৌক্তিক চিন্তা হইলো, হাসিনা-পরবর্তী বাস্তবতায় কীভাবে ভারত তার চাওয়া-পাওয়াগুলা বাংলাদেশ থেকে উদ্ধার কইরা নিতে পারে তার বন্দোবস্ত করা। আমার মতে, ভারত এইসবের মধ্য দিয়া সেই রাস্তাই সুগম করতেছে। হাসিনাকে ফিরাইতে না, বরং হাসিনাকে কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার কইরা ভারত তার চাওয়া-পাওয়াগুলা নিশ্চিত করতে চাইতেছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা অভাবনীয় রকমের সাকসেসফুল হইলেই কেবল শেখ হাসিনার আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরা আসার সম্ভাবনা তৈরি হইতে পারে। আদারওয়াইজ না।

বাংলাদেশে হিন্দু কার্ড খেইলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পিছনে ভারতের অবজেক্ট তিনটা।

এক, হিন্দু-মুসলমান সংঘাতকে কেন্দ্র কইরা ইন্টারনাল ভারতে বিজেপির অবস্থান শক্তিশালী করা এবং তার ভোটব্যাংক সচল রাখা। যেই কাজ বিজেপি অনেক বছর ধইরাই কইরা আসতেছে। দুই, অস্থিতিশীল বাংলাদেশকে ব্যবহার কইরা আমেরিকার সঙ্গে ভারতের আলাপ-আলোচনার টেবিলে কিছু নতুন বিষয় উৎপাদন করা। তিন, বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারতের যেইসব চাহিদা আছে, সেইগুলা উঠাইয়া আনার ক্ষেত্রে একটা শক্তিশালি বারগেইন পয়েন্ট তৈরি করা। মোটকথা, বাংলাদেশ যেনো ভারতকে দিতে বাধ্য হয় এইটা নিশ্চিত করা।

প্রথম দুইটা পয়েন্ট নিয়া আমার আপাতত খুব বেশি কিছু বলার নাই। ভারতের মানুষ যতোদিন না নিজ দায়িত্বে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি থেকে মুখ ফিরাইয়া নিবে ততোদিন এই রাজনীতির বিষাক্ত বাতাস আমাদেরকেও কমবেশি খাইতে হবে।

অন্যদিকে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের মোটিফ কী হবে, বা ট্রাম্প আসলে ভারতের কাছে কী চাইবেন—এই বিষয়ে যেহেতু বাকিদের মতো আমিও পরিষ্কার না তাই এই ব্যাপারেও আপাতত মুখ না খোলাই সমীচিন। হইতেও তো পারে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দুই হাজার বিশ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ‘কাশ্মির সমস্যা’ সমাধানের যেই প্রতিশ্রুতি দিছিলেন, সেইটা তিনি এই মেয়াদে বাস্তবায়ন করার লাইনে যাবেন। সেক্ষেত্রে, নরেন্দ্র মোদীর কপালে একটু দুঃখই আছে। দেখা যাক, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক কোনদিকে।

আমার এই লেখায় আমি মূলত বাংলাদেশের কাছ ভারত কী কী চায়, তার বারগেইনের জায়গাটা মোটাদাগে কী—সেদিকে একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না। কিন্তু আমার মনে হইতেছে, এইদিকে কেউই তেমন নজর দিতেছেন না। তার ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রচলিত ধারণা অনেকটা এমন—আমরা ভারতের আলু-পেঁয়াজ খাই, ফলে চাইলে ভারত আমাদেরকে ভাতে মাইরা দিতে পারে।

বিষয়টা যে তেমন নয় তা আমাদের মনে রাখা দরকার।

পাঁচ.

দুই হাজার চৌদ্দ সালে কাঠমুণ্ডুতে হওয়া সার্ক সম্মেলনে ভারতের নব্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটা স্পষ্ট ঘোষণা দিছিলেন। তিনি বলছিলেন, সার্ককে পাশ কাটাইয়া হইলেও আন্তঃবাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য একটা সাব রিজিওনাল কিছু গইড়া তুলতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায়, দুই হাজার পনেরো সালে বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপালের মধ্যকার সংযুক্তি-চুক্তি পুনরায় অ্যাক্টিভ করা হইছিলো। যা BBIN নামে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকারের তৈরি করা খসড়াতেই ২০১৫ সালের জুন মাসে BBIN-এর আন্ডারে ‘মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট’ অনুমোদিত হইলো। বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপালের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের পথ সহজ-সচল করা হবে এই লক্ষ্যে।

মহাপণ্ডিত না হইয়াও বোঝা যায় এই চুক্তিতে একান্ত ভারতের লাভ ছাড়া অন্য তিনটা দেশের কোনটারই লাভালাভির কিছু ছিলো না। অনেককেই বলতে শুনি, নেপাল বা ভুটানের ব্যাপারে ভারত এতো সিরিয়াস না হইলেও বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে ভারত এমন সিরিয়াস ক্যানো? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। কারণ ভারতকে দেওয়ার মতো নেপাল বা ভুটানের কাছে তেমন কিছু নাই, যা বাংলাদেশের কাছে আছে। নেপাল ও ভুটান দুইটাই ল্যান্ডলক কান্ট্রি। ফলে তারা ভারতের আজ্ঞাবাহী থাকতে বাধ্য, কিন্তু ভারত যা চায় তা তারা ভারতকে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না।

ফলে চুক্তির নাম যতোই BBIN হোক, এই চুক্তিতে নেপাল ও ভুটান ছিলো দুধভাত মাত্রই। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশের বন্দর ও রাস্তাঘাট ব্যবহার কইরা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে পণ্য পৌঁছানোর সু-বন্দোবস্ত করা।

গত বছরে অনুমোদিত নতুন রুটগুলা মিলাইয়া—এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বন্দর-বর্ডার ব্যবহার কইরা উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পৌঁছানোর জন্য পথঘাটের অভাব নাই। মংলা বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল বর্ডার ইত্যাদি সব জায়গা দিয়াই এখন আরামে ভারতের পণ্য ঢুকে ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে যায়। ভারত এই ধরনের কোন সুবিধা নেপাল বা ভুটানের কাছে পাবে না।

শিলিগুড়ি করিডোরকে বাইপাস করার জন্য ভারতকে সবরকম সহযোগিতাই করছিলেন শেখ হাসিনা। পয়েন্টটা হইলো—হাসিনার পতনের পর ভারতের এই মহাসুবিধা নড়বড় হইয়া গেছে। সরকার এইসব চুক্তি এখন রিভিজিট করতেই পারে।

মাথায় রাখবেন, শুভেন্দু অধিকারী যখন বেনাপোল বর্ডারে আলু-পেঁয়াজ বন্ধ কইরা দেওয়ার কথা বলে, তখন সেইটা নিজের দেশের পণ্যই নিজে বন্ধ করার কথা বলে। হা হা। ভারত কখনোই বাংলাদেশে আলু-পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করতে পারবে না। এই কাম করতে গেলে অটোমেটিক বাংলাদেশে ভারতের ট্রানজিট রুটগুলা বন্ধ হইয়া যাবে। ফলে যেই লোড তাদেরকে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের উপরে নিতে হবে, সেইটা তার জন্য হবে মরার উপর খাড়ার ঘা। তাতে এমনিতেই সেভেন সিস্টার্স দুইশো বছর অতীতে চইলা যাবে।

ফলে, ক্যানো তারা ভারতের সঙ্গে থাকবে?

ছয়.

ট্রানজিটের সুবিধা নড়বড় হওয়া ছাড়াও প্রফসের ইউনূসের সরকার আসার পর ভারত আরো কয়েকটা বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে। সেইটা তার নদীর পানি নিয়া মাতবরিমূলক ভঙ্গি থেকে শুরু কইরা বিদ্যুৎ বিক্রির শয়তানি পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই। ভারতকে প্রফেসর ইউনূস বোঝাইয়া দিছেন, কিছুই আর আগের ধারায় চলবে না।

যেমন, রিপাবলিক টিভি যে বলে, প্রফেসর ইউনূসই নাকি সম্প্রতি গৌতম আদানির ঘুষকাণ্ড প্রকাশ করার পেছনের হোতা—হাঃ হাঃ—এই কথা আমার খুব একটা অবিশ্বাসও হয় না। এমনটা হইতেই পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ যদিও এখনো রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার কথা বলে নাই, কিন্তু সরকার পরিবেশ ইত্যাদি নিয়া যেভাবে আগাইতেছে, তাতে ভারতের শয়তানি বাড়লে বাংলাদেশ যেকোন সময় এইটা বন্ধ করার প্রস্তাব করবে। রামপাল কইরা ভারতের উদ্দেশ্য ছিলো সুন্দরবনটা কব্জায় নেওয়া। আজ হোক আর কাল হোক, রামপাল কিন্তু বন্ধ হবে। এইটা ভারত টের পাইয়া গেছে। গতকালকেও দেখলাম প্রথম আলো এই বিষয়ে কলাম ছাপছে।

সবকিছু মিলাইয়া, বাংলাদেশের উপরে ভারতের নিরঙ্কুষ মাতব্বরি ধইরা রাখার যতো কৌশল-বুদ্ধি—সবই আস্তে আস্তে আলগা হইয়া আসতেছে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল কইরা রাখতে পারলেই কেবল ভারত এইসব বিষয়ে বারগেইন চালাইয়া যাইতে পারবে।

বাংলাদেশের কাছে ভারতের আরেকটা প্রধান চাওয়া হইলো, বাংলাদেশকে ব্যবহার কইরা এই অঞ্চলে তার কাউন্টার-চায়না প্রজেক্ট বড় কইরা তোলা। বাণিজ্যিক বিচারে। মনে রাখবেন, ভারত সার্ককে অজ্ঞান কইরা রাখছে তার পিছনে পাকিস্তানই একমাত্র ইস্যু না। বাট সার্ক জীবন্ত থাকলে থ্রু পাকিস্তান এইখানে চায়নাই জীবন্ত থাকে। এইটাই ভারতের ভয়ের জায়গা।

চায়নার ‘বেল্ট এন্ড রোডে’র পয়সায় পায়রা বন্দর ও সোনাদিয়া বন্দর বানাইয়া স্বয়ং হাসিনাও তো ভারতের কম বকা-ঝারি খায় নাই। মোটকথা, বাংলাদেশে চায়নার বিনিয়োগ ঠ্যাকানোটাও ভারতের আরেকটা ওয়ান অফ মেইন কনসার্নের জায়গা। পতনের ঠিক আগমুহূর্তে হাসিনা চায়নায় গিয়া লাত্থি খাইয়া আসছিলো—তা আমাদের মনে আছে। একইভাবে হাসিনার পতনেও চায়না খুশিই হইছে।

চায়না বাংলাদেশে ক্যামন বিনিয়োগ করবে, সেই আলাপ হয়তো বিএনপির জন্য আপাতত তোলা আছে। বা আমি জানি না। তবে ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি আনন্দদায়ক নয়। না আজকের পরিস্থিতি। না আজকের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের পরিস্থিতি।

ভারত ‘বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ’ বা BIMSTEC দিয়া তার রিজিওনাল আধিপত্য বজাইয়া করতে চায়। তার কারণ, BIMSTEC-এ পাকিস্তান নাই। আর এইখানেই বাংলাদেশের হাতিয়ার হইলো BIMSTEC থেকে আস্তে আস্তে সইরা আইসা SAARC নিয়া আলাপ-আলোচনা বাড়ানো। কারণ, SAARC-এ পাকিস্তান আছে।

পাকিস্তান থেকে জাহাজে কইরা মুলা আসলেও সেগুলা ভারতের জন্য ‍মুলা না। ভারতের কাছে এইগুলা মিসাইল-ই। ফলে ভারত যে মুলারে মিসাইল বলতেছে, সত্য কথাই বলতেছে। বাংলাদেশ অন দ্য রাইট ট্র্যাক। শুধু আমাদের বোঝা দরকার—আমাদের কাছ থেকে ভারতের চাওয়াগুলা কী কী। আমরা ভারতের আলু-পেঁয়াজ খাইয়া বাঁচি, ভারত আমাদেরকে চাইর হাজার মাইল ঘের দিয়া রাখছে—এইসব রেটোরিক্যাল ভয় থেকে আমাদের বাইর হওয়ার এখনই সময়।

সাত.

পরিশেষে আবারও জোর দিয়া বলবো, ভারত এই হিন্দু-মুসলমান সংঘাত তৈরি করতে চাইতেছে আমাদের সঙ্গে তার বারগেইনের সুবিধার জন্য। দিনরাত মিথ্যা খবর দিয়া টিভি-ইউটিউব অন্ধকার কইরা ফেলতেছে এই কারণেই। যেহেতু এইখানে ভারতের স্বার্থের প্রশ্ন, ফলে মাথায় রাখবেন, ভারতের ‘ভালো’ মিডিয়াগুলাও এইখানে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে না।

যেমন কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব আছে এমন মিডিয়া বা ইউটিউবগুলা এইখানে আলাদা কোন পজিশন নিবে না। যা গতকালকে ইউটিউবার ‘দ্য দেশভক্তে’র ভিডিওতে ইতিমধ্যে স্পষ্টও হইছে। জানেন নিশ্চয়ই, হাসিনারে গ্রুমিং কইরা বাংলাদেশে তার স্বার্থ উদ্ধার করার কূটবুদ্ধি বিজেপির মাথা থেকে বাইর হয় নাই। এইটা কংগ্রেসের বুদ্ধি।

কাজেই আমাদের এখন দায়িত্ব হইলো, ভারত যেনো এই বারগেইন-পয়েন্টটা না পায় সেইটা নিশ্চিত করা। আমাদের দরকার হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। এযাবৎকাল পর্যন্ত যেই ঐক্য ছিলো, তার চাইতে দ্বিগুন ঐক্য। তাহলে এই যুদ্ধে আমরা ভারতকে হারাইয়া দিতে পারবো। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মেজোরিটি মুসলিম সম্প্রদায় যেই প্রজ্ঞা ও দায়িত্বের পরিচয় দিচ্ছেন, সেজন্য তাদের প্রতি আমার সালাম ও সাধুবাদ।

একই সঙ্গে বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবকেও বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই। বিএনপির তরফে তিনি এইক্ষেত্রে গ্রেট ভূমিকা পালন করতেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদোয়ের পর সম্ভবত প্রথমবারের মতো মনে হইতেছে, বাংলাদেশ অন দ্য রাইট ট্র্যাক। বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে চায়।

Leave the first comment