এই প্রবন্ধে বাংলাদেশে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংগঠনের উদ্দেশ্যে মানুষের সকল সক্রিয়তাকে ‘আর্ট’ বা কলা হিসেবে পাঠ করেছি এবং সে সূত্র ধরেই সক্রিয়তার সকল উপকরণের কার্যকারিতার প্রক্রিয়া প্রশ্নে ‘এস্থেটিকস’ বা নন্দনত্বত্তকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশে মোটাদাগে যে কয়টা বিত্তশ্রেণী অর্থাৎ উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত; ও সামাজিক রাজনৈতিক শ্রেণী অর্থাৎ মধ্যপন্থী, বাম, ডান, উগ্র বাম, উগ্র ডান; এবং প্রজন্ম ভিত্তিক শ্রেণী অর্থাৎ জেনারেশন বুমার, মিলেনিয়াল, জেনেরেশন জেড ইত্যাদি সকল শ্রেণীর মানুষের অভূতপূর্ব মিথস্ক্রিয়ার ফলে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয়েছে। আমরা দেখেছি, পুরো দেশ অগ্নিগর্ভ ধারণ করেছিলো পুরো জুলাই মাসে (৩৬ জুলাই পর্যন্ত)। এই মানুষগুলোকে এক করার অনেকগুলো অনুসঙ্গ থাকার কারণেই নানান মেরুর মানুষ একটা বিন্দুতে আসতে পেরেছেন।
সেই বিন্দুটা কী? অবধারিতভাবেই শেখ হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সক্রিয়তা। এমন সক্রিয়তায় যুক্ত থাকার জন্য আন্দোলনের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ যে ভঙ্গিতে বা ঢংয়ে উপরোল্লিখিত সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলোর নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সম্মতি উৎপাদন করতে পেরেছে, সেটাই গণসক্রিয়তার এস্থেটিকস।
এই ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ এর উপকরণগুলো ছিলো মিছিলের স্লোগান, অনলাইনের নানান পোস্টার, কিছু কবিতা, রাস্তা ও অনলাইনে সক্রিয়তার সময়ের নানান গান, মিম, দেয়াল লিখন, ও পুরোনো সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য। এই উপকরণগুলো প্রতিনিধিত্ব করে তাদের অর্থের দ্বারা সংগঠিত কাজের।
আবার বিপরীতে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ তার কাজকে ছাপিয়ে সেঁটে যেতে পারে প্রতীক হিসেবে। প্রতিকীকরণের মধ্যে দিয়ে ঘটে যায় ‘ল্যাঙ্গুয়েজের’ অর্থের মৃত্যু, অর্থাৎ সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগের মৃত্যু। তার মানে শুধুমাত্র জীবিত এবং নতুন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ই গণসম্পৃক্ততার এস্থেটিকস ধারণ করতে পারে।
অর্থের নির্দিষ্টকরণ ঘটার মধ্যে দিয়ে প্রতীক একটা নির্দিষ্ট অর্থকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রচলিত কর্ম-সমৃদ্ধ শব্দকে প্রতীকে পরিণত করতে পারলে কর্মকে গোপন করে প্রতীক দেখিয়ে পূর্ণ করা যায় নানান স্বার্থসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মৃত ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ ফ্যাসিস্টের ভাষা। তার মানে যে ধরণের রাজনৈতিক প্রতীকি সক্রিয়তা নিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্র নতুন ল্যাঙ্গুয়েজকে মোকাবিলা করতে আসে, তার মৃতজীবিতার জন্যই ফ্যাসিস্ট শক্তি পরাভূত হয়। মোটাদাগে ঠিক যেই মুহূর্তে নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ আবির্ভূত হয়, ফ্যাসিস্ট শক্তি পরাজিত হয়।
অডিও ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে ‘ভিজ্যুয়াল কিউ’ [visual cue] নামের একটি টার্ম আছে, এর কাজ হলো, কাহিনীর (narrative) চূড়ান্ত পরিণতির (climax) যৌক্তিকতা তৈরীর জন্য কাহিনী চলার সময়ে বিভিন্ন জায়গায় উপকরণ (element) ছড়িয়ে রাখা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই উপকরণগুলোই ক্লাইম্যাক্সকে বোধগম্য করে তোলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্লাইমেক্সকে পরিপূর্ণতা দেয়।
একইভাবে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের জীবনের সব ধরণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিজ্ঞতা (পড়ালেখা থেকে শুরু করে বিনোদনের উদ্দেশ্যে কনজিউম করা সব সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট) অনাগত ক্লাইমেক্সের (ফ্যাসিবাদের পতনে চূড়ান্ত সক্রিয়তার) কিউ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ফলে জুলাই গণআন্দোলনের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ই পূর্বাপর নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসা মানুষের সাথে গণঅভ্যুত্থানের সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।
‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’; ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
যেকোনো আন্দোলন যখন শুরু হয়, আন্দোলনের কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কিংবা সক্রিয়তা অনেকাংশে কর্মসূচীগুলোর গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচী হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসা ‘হরতাল’ এর প্রায়োগিক অর্থ হারিয়ে অপাংক্তেয় হয়ে উঠা এক্ষেত্রে উদাহরণযোগ্য। একইভাবে ‘অবরোধ’ কর্মসূচীটিও রাজনৈতিক সক্রিয়তা হিসেবে নানান কারণে গণসম্পৃক্ততা হারিয়েছে আগেই। ‘মানবন্ধন’ নামের অহিংস সক্রিয়তার রূপটি এখনও চলমান থাকলেও এর লক্ষ্য শুধুমাত্র ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। ‘মিছিল’ সক্রিয়তাটি অনেকাংশে তৎক্ষণাৎ, অর্থাৎ হাঁটার রাস্তা শেষ হয়ে গেলেই মিছিলও শেষ। তার মানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সক্রিয়তাগুলো ছিলো কার্যত প্রতীকি অর্থাৎ মৃত।
একযোগে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ‘বাংলা ব্লকেড’ দিয়েই দেশের নানান জায়গায় শিক্ষার্থীরা পুনরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে অমিত সক্রিয়তার সম্ভাবনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। ঢাকার শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গেলে পুলিশ পথ রোধ করে। শিক্ষার্থীরাও সংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে পুলিশের বাঁধা ছিন্ন করে শাহবাগ ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যান। এই ঘটনার যে ভিজ্যুয়াল ইমেজ তৈরী হয়, সেই ইমেজরই রিপিটেশন ঘটতে দেখি পুলিশি আক্রমণের মুখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পলায়নপর শিক্ষার্থীদের ঘুরে দাঁড়ানোয়। এই রিপিটেশন পুরো জুলাই জুড়েই চলতে থাকে পুরো দেশে। (বলে রাখা ভালো, অডিও ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে অন্য অনেক অনুসঙ্গের সাথে রিপিটেশনও ন্যারেটিভকে মিনিং দেয় অর্থাৎ সফল হতে সহায়তা করে।)
এক্ষেত্রে একটি উলেখযোগ্য বিষয়, বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত বামপন্থী লেখকদের জয়জয়কার ছিলো। তারা বামপন্থী সক্রিয়তাকে রোমাঞ্চকর হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কলকাতার ‘ব্লকেড’ শব্দটা বাংলাদেশের উচ্চ এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের মধ্যে রোমাঞ্চকর বাম রাজনীতির দিক থেকে পরিচিত।
তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম দেশব্যাপী সক্রিয়তা যখন ‘বাংলা ব্লকেড’ রূপে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর সামনে হাজির হয়, তখন শুধুমাত্র মাঠের সক্রিয়তার বাইরেও এই শ্রেণীর মনোযোগ আকর্ষিত হয় সহজেই। তারা একে ফলো করতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলন আরেকটি নতুন কর্মসূচী পায়, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। এভাবে আগস্ট আসে, কিন্তু জুলাই গিয়ে ঠেকে ‘৩৬’ তারিখে। নতুন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ ফ্যাসিবাদকে দেয় মরণ কামড়।
‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার’; আবাসন সংকট জারি রেখে ক্ষমতা স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যবহারকে চূড়ান্ত বিদ্রূপ বা আইরনির এস্থেটিকস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কারা থাকে? এক্ষেত্রে নারী আর পুরুষ শিক্ষার্থীদের হলে থাকার রাজনৈতিক অর্থনীতি এক নয়। সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র রাজনীতির ছায়াতলে যারা থাকে, এবং শহুরে বাম রাজনীতিতে সক্রিয় কিংবা কালচারাল উচ্চবিত্ত (অর্থনৈতিক উচ্চবিত্ত নয়) পরিবারের সন্তানরা ছাড়া বাকী প্রায় সাধারণ ছাত্ররা নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত এবং ক্ষেত্রবিশেষে সবচেয়ে প্রান্তিক কৃষক পরিবারের সন্তান।
ছাত্রীদের হলে থাকার কারণ আবার শুধুমাত্র পরিবারের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের আবাসনের জায়গাগুলোর নিরাপত্তা সংকটও বটে। একইসঙ্গে ঢাকার রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরের ‘স্বাধীন’ জীবনও ঢাকায় বেড়ে ওঠা ছাত্রীদের হলে থাকার কারণ।
নিরাপত্তা কবুল করে মোটাদাগে চলাচলের স্বাধীনতা হারানো এই ছাত্রীরা এর আগে দুই হাজার আঠারো সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে হলের গেটের তালা ভেঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু চব্বিশের উদ্ভুত মুহূর্তে উপস্থিত ছাত্রীদের বেশীরভাগই সেই স্মৃতি বহন না করলেও কালেক্টিভ একটা মেমোরি বহন করে চলা অস্বাভাবিক নয়।
আবার নিম্নবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত ছাত্রদের মধ্যে সচেতন বা অসচেতনভাবে গড়ে উঠে অধরা একটা স্বপ্ন। লেজুড়বৃত্তীয় ছাত্র রাজনীতির হাত থেকে স্রেফ ঘুমানোর জায়গার অধিকার উদ্ধার। ছাত্ররা এ কথা অনেক আগেই বুঝেছে যে, যতোদিন ক্ষমতাশীন দলের ছাত্ররাজনীতি আছে, ততোদিন পর্যন্ত ক্ষমতার স্বার্থেই কখনও আবাসন সংকট সমাধান করা হবে না। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ‘পাওয়ার হাউজ’ হিসেবে এক একটা হলে শক্ত অবস্থান উদাহরণযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা রাজাকার বলার পর শিক্ষার্থীরা আইরনি দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেন না। প্রথমে ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার রাজাকার’ এবং এরই ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের দ্বারা পরিমার্জিত ‘কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন।
আওয়ামীলীগের ন্যারেটিভের ভেতরকার ‘রাজাকার’ প্রতীক এই আইরনিতে ভেঙ্গে পড়ে (এখানে বোধহয় উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই যে, রাজাকার শব্দটি আসল অর্থ হারিয়ে প্রতীকে পরিণত হয়েছিলো বহু আগেই)। এই প্রতীকের ভেঙ্গে পড়াতেই ক্ষমতার স্বার্থসিদ্ধির ‘মৃত ল্যাঙ্গুয়েজ’ তার যোগাযোগ ক্ষমতা হারায়। এমন সক্রিয়তার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়নের মাধ্যমে। ছাত্রলীগের এই বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা তাই স্বয়ং ছাত্রলীগকেই ‘পাওয়ার হাউজ’ অবিধার একটি মৃত প্রতীকে পরিণত করে।
‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’; নিম্নবিত্তের আত্মমর্যাদা রক্ষার অতি পুরাতন সেলফ ডিফেন্স ‘অভিমান’
শেখ হাসিনা রেজিমে যখনই দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা হয়েছে, শেখ হাসিনা খাবারের বিভিন্ন বিকল্প হাজির করে নিম্নবিত্তের মানুষকে উপহাস করেছেন। তবে অন্যের খাবার বাতলে দেয়ার এই অসভ্যতা উচ্চবিত্তের সাথে তিনি করতে পারেননি। আত্মমর্যাদা হানির এই স্মৃতি নিম্নবিত্ত বহন করেছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হিসেবে অভিমান ছাড়া তেমন কোনো কিছুই করতে পারেননি তারা।
অভিমান আশ্রয়ী সেলফ ডিফেন্স এই অঞ্চলে নতুন নয়। যার কিছু নেই তার এক টুকরো ইজ্জত আছে। এই ইজ্জতের জোরেই কিছু করতে না পারার ক্ষত নিম্নবিত্ত পুষিয়ে নেয়। কিন্তু এই অভিমানের প্রপঞ্চের আড়ালে তীব্র ক্রোধ এবং ঘৃণা জন্ম নেয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীদের ঘরে বাইরের সক্রিয়তায়। পূর্ব থেকে তৈরী হয়ে থাকা অভিমানী মন খুঁজে পায় আরও একটি অভিমান প্রকাশের সুর।
রুচির উচ্চাশ্রয়ী শ্রেণীর কাছে এই স্লোগান নিম্ন রুচির পপুলার কালচার হিসেবে যেমন ধরা দেয়, তেমনি রুচির বিভিন্নতায় বিশ্বাসীদের কাছে এই স্লোগানের মর্মার্থ আর শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের তৈরী করা স্লোগান হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না। অর্থাৎ যে মনস্তত্বের ভেতর দিয়েই এই স্লোগানের জন্ম হোক না কেন, স্লোগানটি ঠিকই পেয়ে যায় টার্গেট অডিয়েন্স।
দেবাশিস চক্রবর্তীর মুক্তিযুদ্ধ আশ্রয়ী উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত একত্রিত করার এস্থেটিক প্রকল্প
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নিতুন কুন্ডু, দেবদাস চক্রবর্তী, আর প্রণেশ কুমার মন্ডলের করা লাল কালো সাদার ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’ কিংবা ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’ কিংবা ‘বাংলার হিন্দু বংলার খৃষ্টান বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মোসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী’ খচিত পোস্টার এদেশের মুক্তিযুদ্ধের গণপ্রতিরক্ষার ইমেজ আকারে প্রতিষ্ঠিত।
দেবাশীষ চক্রবর্তী একই ফর্মটাকে মিডিয়াম হিসেবে নিয়ে ফ্যাসিবাদ/স্বৈরাচার আর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে শত শত পোস্টার বানিয়ে নাগরিক সক্রিয়তার উপকরণ হাজির করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এমন পোস্টারগুলো নিয়ে কাজ করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পোস্টারের ফর্মের রিপিটেশনের কারণে এই পোস্টারগুলো ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হওয়ার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠা উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গণপ্রতিরক্ষার বাসনা নিয়ে হাজির হয়।
এখানে দেবাশিস চক্রবর্তীর পোস্টারগুলোকে পুনর্পাঠের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। কারণ, ‘বাঁশের লাঠি তৈরী করো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এই পোস্টারকে যদি ধরি ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তের পোস্টার, তাহলে কখনও ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট বাতিল চেয়ে, কখনও ফিলিস্তিনে ইজরাইলী হামলার প্রতিবাদে, কখনও ভোটাধিকার হরণের বিরূদ্ধে পোস্টার বানিয়ে খোদ ফ্যাসিবাদ ধারণাটাকেও দেবাশীষ পরিচিত করেছেন এই ফর্মের ভেতর দিয়ে। ঠিক যেভাবে ইয়াহিয়া খানের রক্তচক্ষুর এক ছবি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বৈরাচারের রূপ হিসেবে মানুষের মানসপটে জাগরুক থাকে।
‘আওয়াজ উডা’, ‘কথা ক’; র্যাপার হান্নানের আওয়াজ আর রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
র্যাপার কারা? হাসিনা রেজিমের কাছে র্যাপার আর তথাকথিত কিশোর গ্যাং এর মধ্যে গুণগত তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো কি? নগরকেন্দ্রিক পাড়ায় মহল্লায় গত রেজিমের অন্যতম আক্রমণ হয়েছে কিশোর গ্যাং এর উপরে। রাষ্ট্র মূলত একটা শ্যাডো সোশ্যাল যুদ্ধ শুরু করেছিলো কিশোর গ্যাং এর বিরূদ্ধে। দুই হাজার আঠারোয় ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরূদ্ধে’ ধরণের স্লোগান তৈরি করে বিচার বহির্ভূত হত্যার নজির আমরা দেখেছি।
গত হাসিনা রেজিমের সময় যুদ্ধের স্বাভাবিকীকরণ করার জন্য মুখে মুখে অলি গলি পোস্টার ব্যানারে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরূদ্ধে’ স্লোগানে ভরে দেয়া হয়েছিলো। যুদ্ধের আসল অর্থ ‘নানান পক্ষের হত্যাকান্ড সংগঠন’ থেকে যুদ্ধের অর্থ দাঁড়ালো মাদক থেকে জাতিকে ‘উদ্ধার’। এই উদ্ধারের দোহাই দেখিয়ে খুনকে করা হয়েছিলো স্বাভাবিক, প্রতীক দিয়ে। যুদ্ধের অর্থ থেকে বিভৎসতাকে সরিয়ে দিয়ে মাদক উদ্ধার অভিযানের গণসম্মতি উৎপাদন করেছিলো রাষ্টযন্ত্র।
তাই র্যাপার হান্নান যখন ‘আওয়াজ উডা’ বা ‘কথা ক’ নিয়ে সামনে আসেন, তখন অবধারিতভাবেই রাষ্ট্রের বুঝের ভেতরের কিশোর গ্যাং এর কালচারাল রিপ্রেজেন্টেশন যার যার মধ্যে আছে, অর্থাৎ র্যাপার হান্নান বা এমন যে কাউকে গান গাইবার কারণে গ্রেপ্তার করা যায় বলে ধরে নেয় রাষ্ট্রযন্ত্র।
কিন্তু হান্নানকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে নতুন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’কে দমানো যায়না। হান্নানের মুক্তির দাবীতে শহীদ মিনারে দাড়িয়ে যায় স্বয়ং হান্নানের গান, ‘কথা ক’ কিংবা ‘আওয়াজ উডা’।
এখানে কিশোর গ্যাং এর সাথে র্যাপ গানের সম্পর্ককে বুঝতে কিশোর গ্যাং এর সাথে পাংক কালচারের ওতপ্রোততা আর পাংক কালচারের আদি কালচারাল এলিমেন্ট হিপ-হপ গান এবং বাংলাদেশে হিপ-হপের প্রবাহিত ধারা হিসেবে র্যাপ গানের সক্রিয়তা আকারে পাঠ করতে হবে।
মুক্তির মন্দির সোপান তলে; বাম হেজিমনির প্রণের গান যখন মানুষের মুখে মুখে
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে রচিত মোহিনী চৌধুরীর এই গান বিপ্লবীদের যেমন সাহস যুগিয়েছে, তেমনি ভারত ভাগের পরের দুই বাংলার বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতির মানুষকে এখনও বিপ্লবী প্রেরণা দেয়। আবার এই গান ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গান হলেও বামপন্থী রাজনীতিতে চর্চিত বলে অন্যান্য অনেক পার্টিজান শিল্পের মতোই গণমানুষের হয়ে উঠতে পারেনি।
জুলাইয়ের সক্রিয়তার সময়ে যখন দেশে শত শত মানুষ প্রাণ দিচ্ছিলো, তখন রাস্তায়, অনলাইনে, ঘরে, নানান জায়গায় আবার শোনা যায় ‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা/ বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙ্গা/ তাঁরা কি ফিরিবে আজ/ তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে/ যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গান আবার ফেরত আসলো ইতিহাসকে নির্মোহভাবে পাঠ করতে চাওয়া জনগোষ্ঠীর ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে। এবার ফেরত তো আসলোই, বাম ঘরানার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সকল সামাজিক রাজনৈতিক শ্রেণীর মানুষের মুখে মুখে ফিরলো এই গান, পুরো স্যাকুলারভাবেই।
‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’ গুম প্রতিরোধের সম্মিলিত স্বর; ‘বৈষম্যই’ যখন পাহাড়ের অপর নাম
ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে অবধারিতভাবেই ছাত্রনেতারা গুমের হুমকির মধ্যে ছিলেন। কিন্তু তারা জাতির কাছে মারাত্মক রকমের ‘এক্সপোজড’ হয়ে থাকার কারণে গুমের দিকে যেতে পারছিলোনা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু একেবারে প্রকাশ্যেই ছাত্রনেতাদের ধরে আনা হলো পুলিশের ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চে। যথারীতি সকল আইন অমান্য করে তথাকথিত ‘হেফাজতে’ রাখা হলো তাঁদের। ফ্যাসিবাদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তার ঘটানো ইনসিডেন্টকে লেজিটিমিসি দেয় তার করা জনবিমুখ আইনের মাধ্যমে; আবার ফ্যাসিবাদ নিজের সুবিধার জন্য কখনও কখনও তার বানানো ফ্যাসিবাদী আইনও মানতে চায় না। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী স্বত্তার চর্চিত ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হয় সবসময় উর্ধ্বমুখী; ফলত ফ্যাসিবাদের কখনোই গণতন্ত্রে ফেরত আসার উপায় নেই।
ছাত্রনেতাদের এই ‘হেফাজতে অন্তরীন’ সময়ে রাস্তায় নেমে আসেন ‘কল্পনা চাকমা’। ‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’ এমন পোস্টারে ছবিতে স্লোগানে স্বয়ং কল্পনা চাকমাই তাবত বাংলাদেশীর গুম প্রতিরোধের স্বর হয়ে উঠেন। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-নাগরিক সমাজের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় ছাত্র নেতাদের ‘বেহেফাজত’ করতে বাধ্য হয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র।
নানান ঘটনা পরিক্রমায় যখন দেশে কারফিউ জারি করা হয়, অর্থাৎ সমতলের মানুষেরা সেনা বাস্তবতায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয়, তখন পাহাড়ের সেনা শাসনের দীর্ঘ পরিক্রমা সমতলের মানুষের সামনে এসে উপস্থিত হয়। খোদ যে আন্দোলনের নামই ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, সেখানে পাহাড়ে চলে আসা অর্ধ শতাব্দীর ‘বৈষম্য’ নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে।
এই প্রাসঙ্গিকতা অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্বর হয়ে উঠার সম্পর্কের মধ্যে জীবিত ‘ল্যাঙ্গুয়েজের’ একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত হয়। কল্পনা চাকমাকে অপহরণ পরবর্তী পাহাড়ী সক্রিয়তা জারি রাখার মাধ্যমে পাহাড়ের আত্মপরিচয়ের অমিমাংসিত সাংবিধানিক বাস্তবতা শুধুমাত্র পাহাড়ের নিজস্ব রাজনৈতিক বাস্তবতা আকারে হাজির থাকে না, বরং যে কোনো সময়ে যে কোনো সভ্যতার মধ্যেই রাষ্ট্রে জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও প্রকাশ কেমন হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতার যৌক্তিকতাও প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ, জীবিত ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বিরাজ করতে পারার অন্যতম কারণও রাজনৈতিক উপকরণগুলোর চলমানতা বা প্রতীকে পরিণত না হওয়া। মোদ্দকথা, যেকোনো জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চাহিদা রাষ্ট্রে যতোদিন স্বীকৃত না হবে, ততোদিন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ জীবিত আকারে হাজির থাকা স্বয়ং জীবিত ল্যাঙ্গুয়েজেরই বৈশিষ্ট।
শেখ হাসিনা কেন্দ্রীক গালি; পুরুষতান্ত্রিক রেজিম পতনে পুরুষতান্ত্রিক চূড়ান্ত সম্মতির প্রকাশ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তার দিনগুলোতে প্রথম আক্রান্ত কারা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। রাস্তায় সক্রিয়তার সময় অন্য অনেক ভূমিকার পাশপাশি নারী শিক্ষার্থীদের একটা বড় ভূমিকা থাকে ‘নারী শারিরিকভাবে অনাক্রমনযোগ্য’ এই প্রপঞ্চকে পুঁজি করে পুরুষ সতীর্থকে রক্ষা। তাই ছাত্রলীগ যখন নারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে, তারা স্রেফ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে হামলা করে না, তারা পুরুষতান্ত্রিক রেজিম নিয়ে হাজির হয়।
একদিকে ফ্যাসিবাদী আদর্শ পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যের আদর্শ, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক রেজিমে বেড়ে ওঠা মানুষের পুরুষতান্ত্রিক বাসনার সংস্থান করে দেয় রেজিম নিজেই। করায়ত্ত মানুষ হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সকল আচারে অংশ নেয় রেজিমের ভেতরের মানুষেরা। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ বা বাতিল করার সময়ও তাই অবধারিতভাবে পুরুষতান্ত্রিক গালি বা অপভ্রংশ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে বেড়ে ওঠা সক্রিয় মানুষের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করতে ছাড়ে না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাই শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে নানান গালি পুরুষতান্ত্রিক সম্মতির প্রকাশ হিসেবে গণসক্রিয়তায় হাজির থাকে এবং অনাগত রেজিমেরও পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে। এর প্রকাশ দেখা যায় বিজয় মিছিলের ভীড়ে, ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির দিনেও গোপনে নারীর শরীরে হাত দেয়ার সুযোগ নষ্ট করে না পুরুষতন্ত্র।
ইসলামের সবচে বড় রাজনৈতিক শব্দতান্ত্রিক হাতিয়ার ‘শহীদ’ অভিধা; পিপলস এক্টিভিস্ট কোয়ালিশনের লাশের মিছিল
আন্দোলনের মাঝমাঝি সময়ে ফ্যাসিবাদী হাসিনার রাষ্ট্রযন্ত্র যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে আর কারফিউ দিয়ে আন্দোলন প্রায় দমিয়ে ফেলেছে, তখন জাতির সামনে মজলুমের যাতনা সহ হাজির হয় মহররম। মহররমের কালো শাড়ি গায়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে আসেন শেখ হাসিনা। তিনি ভুলে যান ইয়াজিদী বাহিনীর নৃশংসতার পর শোকের প্রতীকিকরণই হলো কালো রঙ। কিন্তু তার রাষ্ট্রযন্ত্র যখন খুনে উন্মত্ত, তাজা রক্তকে প্রতীক দিয়ে আর ঢাকা যায় না। রক্তের অর্থ থাকে রক্তই। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা পর্যবসিত হয় রাষ্ট্রীয় তামাশায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছেয়ে যায় লাল রঙে। স্পষ্টত রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে (সরকার নয়) দাঁড়িয়ে যায় ছাত্র-জনতা।
ফ্যাসিবাদী হাসিনা রেজিমের পতনে লং মার্চের ডাক যখন আসে, ইতিমধ্যে হাজার মানুষ প্রাণ দিয়ে ফেলেছে। রক্ত দেখা, মানুষ মরতে দেখা হয়ে উঠছিলো আন্দোলনে সক্রিয় মানুষের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে এক দফা ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পর ৪ আগস্ট তাই ছাত্র-জনতার জন্য যেমন সবচে বিপ্লবী দিন, রাষ্ট্রযন্ত্র ও মাঠের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের জন্যও চূড়ান্ত হত্যাকান্ডের দিন। এদিনই মূলত আওয়ামীলীগ মাঠে হেরে যায়, ছাত্র-জনতা দেয় চরম মূল্য।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক সক্রিয়তার নজির কয়েকবছর ধরে আমরা দেখি ‘পিপলস একটিভিস্ট কোয়ালিশন (প্যাক)’ এর কর্মসূচীতে। কয়েক বছর ধরে শাহবাগে অভিনব বিভিন্ন কায়দায় নানান ফ্যাসিবাদ বিরোধী সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে মূলত মুসলমানের ‘শহীদি’ বাসনাকেই ফ্যাসিবাদের বিরূদ্ধে সক্রিয় করার কাজ করে প্যাক। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় গুম খুনের প্রতিবাদে শাহবাগে খাটিয়া মিছিল এমন সক্রিয়তার উদাহরণ।
৪ তারিখের (৩৫ জুলাই) সবচে মৃত্যুময় দিনে তাই শাহবাগে দেখা যায় সত্যিকারের ‘লাশের মিছিল’। এই মিছিলের পর প্যাকের প্রধান সমন্বয়ক রাতুল মোহাম্মদ লিখেন, ‘জীবনের প্রথম আজকে রক্ত মাখা লাশ নিয়ে মিছিল করতে হলো…. ঢাকা মেডিক্যাল থেকে লাশ নিয়ে আসার পর একের পর এক লাশ আসতে শুরু করলো। শতাব্দী শ্রেষ্ঠ জালিমের বিরুদ্ধে এটা আল্লাহর দেয়া একটা ঐতিহাসিক ঘটনা।’
অর্থাৎ ‘প্রতীকী’ লাশের মিছিল করতে করতে এবং গায়েবানা জানাজা পড়তে পড়তে যখন সত্যিকারের লাশ এসে উপস্থিত হয়, তখন ইসলামের ‘শহীদ’ অবিধাই শহীদি তত্ত্বে বিশ্বাসী মুসলমানদের কাছে একটি জীবন্ত ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে ধরা দেয়।
নতুন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ তৈরী হওয়ার সূচনা বিন্দু: সাধারণ মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয় সংকট থেকে বাংলাদেশের ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’?
২০০৭-০৮ সেশন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও আরও কিছু বিভাগে ২০০ নম্বরের বাধ্যবাধকতা প্রয়োগ করে ২০১৬-১৭ সেশন পর্যন্ত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ ছিলো। ২০১৭-১৮ সেশন থেকে এই নিয়ম অকার্যকর হয়ে যায় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড দাখিল ও আলিমে ২০০ নম্বরের ইংরেজি চালু করার পর (লক্ষ্য করুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি)।
মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের সূচনা হয় এই ঘটনার মাধ্যমে। এর আগ পর্যন্ত প্রশ্নটা ছিলো চয়েজের। যার ইচ্ছে সে পড়াশোনা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজ পছন্দের শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এমন বৈষম্যে অধিকার সচেতনতার বীজ তৈরী হয় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
অপরদিকে ২০০১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসাগুলোর শিশু-কিশোরদের ব্যাপক হারে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়ানো হয়। ছাত্র শিবিরের এই এবিউজিভ রাজনীতির স্বীকার হয় সাধারণ মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। এই সূত্র ধরেই মাদরাসা শিক্ষার্থী মানেই শিবির এফিলিয়েশনের ধোঁয়া তোলার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। সাধারণ মাদরাসা শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করে।
এই বিষয়দুটি যুগপৎভাবে সাধারণ মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয় প্রশ্নে নতুন করে ভাবনা চিন্তার দোয়ার খুলে দেয়। যার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তৈরী হয় একদল মাদরাসা এফিলিয়েটেড শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয়ের নতুন রাজনীতি। যেখানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভ্যানগার্ড ছাত্রলীগের জুলুমের বিরূদ্ধে শিক্ষার্থীদের দাঁড়ানোর ইচ্ছা এবং মাদরাসায় থাকাকালীন ছাত্রশিবিরের আইডেন্টিটি লুটের স্মৃতি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাথমিক নেতৃত্ব, অর্থাৎ ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র প্রতিষ্ঠা হয় মাদরাসা শিক্ষার সাথে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর হাতে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতন যদি গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিন্দু হয় (শেষ বিন্দু হলো ‘সকল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ’), তাহলে এর সূচনা বিন্দু হলো ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র অভ্যুদয়। অর্থাৎ, ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানের মূলে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মাদরাসা শিক্ষার্থীদের (এবং পারিবারিকভাবে মাদরাসা সংস্পর্শে থাকা শিক্ষার্থীদের) অধিকার সচেতনতা তৈরীর মাধ্যমে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা। ফলে, এই মাদরাসা সংযুক্ত শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে দরকার পড়ে এমন এক নতুন স্যাকুলার ‘ল্যাঙ্গুয়েজের’, যে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ ধারণ করতে পারবে বাংলাদেশের সবগুলো শ্রেণীর মানুষকে।