জনবিতর্ক

মুরাদ কিবরিয়া

অন্তবর্তীকালীন ভয়সমূহ

October 13, 2024   1 comments   12:53 pm

একটা বিপ্লব নিজের চোখে দেখা আর তার সাথে নিজের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জড়িত থাকার ফলে যে ধরনের জটিল এক সাইকোলজিক্যাল জার্নির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটাকে পাশ কাটিয়ে নির্মোহ আর বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো আলাপ শুরু করা দুরূহ হয়ে পড়ে, ফলে কোন ইন্টেলেকচুয়াল বয়ান নয়, বরঞ্চ আশা আর ভয়ের মানবিক গল্পকাতর অনুভূতির মধ্য দিয়েই যাই।

Share

১.

৫ আগস্ট বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের দিন দিয়ে তবে শুরু করা যাক, কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই। সেনাপ্রধানের ভাষনের ঘন্টা দুয়েক আগেই আমরা রাস্তায় নেমে পড়ি, বহু অনুনয় করে একটা রিক্সা ম্যানেজ করি। রিক্সা যখন রামপুরায় মূল সড়কে আসে তখন আমি এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের মুখোমুখি হই, ঢাকা শহরের সব গলি থেকে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে এসে মিশছে মূল সড়কে, রিক্সায় উঠে দাঁড়িয়ে আমি পেছনে তাকাই, যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। সামনে যতদূর দেখা যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। শ্রেনী-পেশা-ধর্ম-লিংগ নির্বিশেষে! সবার মুখে উত্তেজনা। খুশি উপচে পড়ছে রাজপথে। আমার সাথে আমার স্ত্রী আরেকজন বান্ধবী কাম কলিগ, লোকে লোকারণ্য রাজপথ, তবু আমাদের কোনো ভয় নেই। কারো কোনো ভয় নেই। মগবাজার মোড়ে ট্রাফিকে দাঁড়ানো মাত্র কেউ একজন জনতার উপর প্যাকেট করা রুটি ছুড়ে মারতে লাগল, হইহই, রইরই। সবার মুখে হাসি। আর শ্লোগান, নানান ধরনের।

শাহবাগে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, তখন মেট্রোরেলের ফ্লাইওভারে উপর তরুণ কিছু ছেলে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, তাদের চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের চেয়ে মুগ্ধতা বেশি। তাদের দিকে তাকিয়ে জনতা হাত নাড়ছে, তারা হাসছে। পাশ থেকে এক লোক বিদেশে কল দিয়ে চিৎকার করে কথা বলছে, চিৎকার-চেঁচামেচি-শ্লোগান-হাসি আনন্দ-এতকিছুর মধ্যে তার কথা শুনতে পাচ্ছে না ওপাশে, সেই লোক চিৎকার করে বলছে, আর কোনো ভয় নাই, তুই আইসা পড় দেশে।

হুনোস না? আর ভয় নাই, আর ভয় নাই!

২.

একটা বিপ্লব নিজের চোখে দেখা আর তার সাথে নিজের অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জড়িত থাকার ফলে যে ধরনের জটিল এক সাইকোলজিক্যাল জার্নির মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটাকে পাশ কাটিয়ে নির্মোহ আর বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো আলাপ শুরু করা দুরূহ হয়ে পড়ে, ফলে কোন ইন্টেলেকচুয়াল বয়ান নয়, বরঞ্চ আশা আর ভয়ের মানবিক গল্পকাতর অনুভূতির মধ্য দিয়েই যাই। আর আশা যেহতু পূরণ হয়েছে মোটাদাগে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে তাও হয়ত নিজের চোখেই দেখতে পাব, ফলে, এই অন্তর্বতীকালীন সময়ের ভয়সমূহের প্রাক্কলন নিয়ে শুরু করা যাক।

৩.

এক নতুন আন্দোলন! এক বিরল অভ্যুত্থান। এই আন্দোলনের কয়েকটি বিষয়-আশয় অবশ্যই নজরকাড়া দিক আছে যেগুলো একই সাথে আশা আর ভয়ের যৌথ পথে আমাদেরকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। এর আগের ব্যর্থ অভ্যুত্থানগুলি (!) কিংবা অভ্যুত্থানের পর জনগনের প্রতারিত হবার ইতিহাস এই দেশের মানুষের মানসপটে এক দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলে রেখেছে, ফলে গনভবনের বসে থাকা অত্যাচারী কাউকে সমূলে উৎপাটন করার প্রশ্নে সে ‘প্রতারিত জনতা’ পাল্টা প্রশ্ন রেখেছে, তারপর কী?

         ইতিহাস বড় নির্মম। চিহ্নিত রাজনৈতিক খুন, গুম, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভোটাধিকার হরণ, মামলা, হামলা, দেশত্যাগ-কোনোকিছুই জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারেনি পনের বছর। এই পরিস্থিতি কীভাবে হলো তার ঐতিহাসিক সিলসিলা ধরে এগোলে দেখা যায় এদেশে অভ্যুত্থানের পর অভ্যুথথা ঘটেছে আর ঘটেছে নির্মম বিশ্বাসঘাতকতা। ফলে পুরনো কেউ আর জনগন, বিশেষত যাদের রক্ত বাংলাদেশের মুক্তির প্রশ্নে ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য, সেই তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে কোনো আবেদন তৈয়ার করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে দফায় দফায় ‘ব্যর্থ’ আন্দোলনের ভারি বোঝা কাঁধে নিয়ে ‘রাজনৈতিক’ বিরোধী দলগুলো দলে দলে ‘গাট্টি গোল করে’ জেলখানায় গিয়েই থিতু হতে বাধ্য হয়েছে।

         তবে প্রশ্ন যখন উদিত, সুরাহার বাহানাও তো থাকে। সেই বাহানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত কয়েক বছর ধরে নীরবে ছাত্রদের মধ্যকার নানান আলাপ, গবেষনা আর তার সাথে নানান প্রচেষ্টা, সেসমস্ত প্রচেষ্টার নানান উত্থান আর পতনের পর যখন জানুয়ারিতে আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের নাটক সমাপ্ত, তখন ছাত্রদের একাংশ পুরোপুরি প্রস্তুত। কেবল সময় আর উপযুক্ত ক্ষেত্রের অপেক্ষা।

সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত অহংকারি সরকার যখন পনের বছরের তাদের একমাত্র পরাজয়, কোটাকে ফের কবর থেকে তুলে আনে, তখন ছাত্ররা হাত আর পা নিয়ে মাঠে নামারা আগেই, তাদের মস্তিষ্ক ছিলো প্রস্তুত, ন্যারেটিভ ছিলো ক্লিয়ার, আর স্ট্রাটেজি ক্ষুরধার। তাদের সিদ্ধান্ত ছিলো মোটা দাগে এই, ঐতিহাসিক কোনো রাজনৈতিক সিলসিলা আর থাকবে না, না নামে, না ভাষায়, না কাজে।

কোটা আন্দোলনে তরুণরা জানালো নতুন কর্মসূচী, ‘বাংলা ব্লকেড’। তারপর বলল, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বা বলা যায় ছুঁড়ে ফেলে আহবান করা হলো সকল শ্রেনীর মানুষের নারী-পুরুষকে। বারবার বলা হলো কোন দলীয় প্লাটফর্ম এখানে নেই, নেই কোন দলীয় এজেন্ডা বিশেষত দলীয় নেতৃত্ব। অভূতপূর্ব সাড়া মিলল সেখানে। শেখ হাসিনার পতনের আগেই কবর রচনা হলো চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির, সাথে নেতৃত্বের । সেই কবরের উপর দাঁড়িয়ে উড়লো নতুন পতাকা, পতাকায় লেখা, ফ্যাসিবাদের পতন চাই। পতাকায় লেখা সবাই পড়তে পারলেও, তার আগের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যপূর্ণ ‘ভাষা আর আকাঙ্ক্ষা’ অনেকেই পড়তে পারেনি। আমার প্রথম অন্তর্বতীকালীন ভয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো বিপ্লবের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হবে, একসময় তারা অস্বীকার করবে, গতানুগতিক রাজনৈতিক আন্দোলন (বা দল) মাঠে নেই, আছে দলমতহীন, নেতাহীন, ব্যানারহীন ছাত্রসমাজ। এটা দেখেই শ্রমিক-জনতা কাতারে কাতারে রাজপথ দখল করেছিলো। যদি তাই হয়, তবে যে ভবিষ্যত হলো এই, ফ্যাসিবাদী কিছু ব্যক্তির অপসারন হয়েছে, কিন্তু ফ্যাসিবাদ অপসারিত হবে না। নির্বাচনের মোড়কে হয়ত গনতন্ত্র আসবে কিন্তু সেই নির্বাচন নামক গনতন্ত্র আর ছায়া-ফ্যাসিবাদ হাত ধরাধরি করে চলবে। বর্তমান বৈশ্বিক- আঞ্চলিক রাজনীতির যেই গতিপথ, তাতে এর পরিনতি হবে ভয়াবহ। দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সংঘাত আর পুনঃপুনঃ বিদেশী হস্তক্ষেপ। ফাইনালি হয় আরো নির্মম ফ্যাসিস্টের উত্থান কিংবা নিষ্ঠুরতম মিলিটারি শাসন। জটিল বিষয় হলো, রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার কেউ আইন করে করতে পারে না, এর জন্য দরকার জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য। আর প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব। বাংলাদেশে সেটা হবে না হয়ত,  এই ভয় নিয়ে শুরু হলো আমার অন্তর্বতীকালীন ভয়সমূহের যাত্রা।

৪.

মানুশ কেন বিপ্লব করে?

কেন সে জীবন দেয়? কেন সে রাজপথে নেমে এসে বুক পেতে দিয়ে সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তৈরি করে? কী চায় তারা? কে দেবে এই প্রশ্নের উওর?

শহীদদের রক্ত আমাদেরকে জাতীয় ঐক্যে এনে ফেলেছিলো যে, ফ্যাসিবাদী ও ফ্যাসিবাদী সমস্ত ব্যবস্থা অবিলম্বে অবসান ঘটানো দরকার, দখল করা দরকার গণভবন। তাদের সে ঐক্যের সামনে না দাঁড়াতে পেরেছে অস্ত্র, না দাঁড়াতে পেরেছে অস্ত্রের মালিক, অস্ত্র আর অস্ত্রের মালিক দুই-ই ভেসে গেছে আর ৫ আগস্ট এক রোদেলা বিকালে জনতা গনভবনে প্রবেশ করে দেখে দোর্দন্ড প্রতাপশালী ফ্যাসিস্ট দুপুরের খাবারটাও খেয়ে যেতে পারেনি। এই হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের শক্তি।

         সমস্যা হলো ফ্যাসিস্ট যখন আসে তখন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাসমূহকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে, তাদেরকে প্রতিষ্ঠা করে। আর যখন সে বিদায় নেয়, তখন কেবল সে একাই বিদায় নেয়, রয়ে যায় তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা।

         এর বাইরে আরেক প্রশ্ন রয়েই যায়, আবু সাইদের রক্ত বিপ্লব তৈরি করে। ফ্যাসিস্ট তৈরি করে কে? বহুদিন পর এইবার সেই ফ্যাসিস্টের কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে, সবাই জেনে গেছে কেন তৈরি হয় ফ্যাসিস্ট? সেই কারখানার ব্লু-বুকের নাম সংবিধান। সেখানে বহাল তবিয়তে ইংরাজ ভুতের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে বুরোক্রেসি আর পুলিশি ব্যবস্থা, আছে লুটেরা ক্রনিক ক্যাপিটালিস্ট, রাজনৈতিক দুর্ব্রিত্ত। আর তাদেরকে আঁচলের নিচে মাতৃস্নেহে লালন করবার জন্য আছে উকিলি বিচার ব্যবস্থা।  

         সংবিধান নিয়ে আলাপ হচ্ছে জোরেসোরে, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা নানান মধ্যবিত্ত প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মুখরোচক নানান টার্মিনোলজির ফুলকি ছুটিয়ে নানান কথা বলছেন। নতুন সংবিধান রচনার প্রস্তাব ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। আছে কেবল সংস্কার প্রস্তাব। প্রশ্ন হলো এই সংবিধান কেবল সংস্কার করে কি জন আকাঙ্ক্ষার মঞ্জিলে পৌঁছানো সম্ভব? আমার মতে সম্ভব না। এখনো সংবিধান সংস্কার কমিটি খেটে খাওয়া মানুষ যারা শহুরে বাতাসে নেই, তাদেরকে অংশীজন করে নি।

         পুরনো আমলা দিয়ে আমলাতন্ত্রের সংস্কার, ফ্যাসিবাদের সমর্থক/সুবিধাবাদী ক্যাপিটালিস্ট দিয়ে অর্থনীতি সংস্কার করার চেষ্টা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। এইসমস্ত ব্যবস্থার বিলোপ চেয়েছে জনগন, অথচ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেবল কিছু পুরনো মাছ শাক দিয়ে ঢেকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

         বিপ্লবের মাধ্যমে যেই ব্যবস্থাগুলোকে বিলোপের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, সেগুলো যখন কিছু মাত্রায় সংস্কার হয়ে ফিরে আসে, তখন সেটা দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে নৈরাজ্যই হয়ে ওঠে নিয়তি। ভয় হচ্ছে, বিপ্লবের মাধ্যমে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া ব্যবস্থাসমূহকে কোনোরকমে সেলাই করে পূর্বের চেয়ে দূর্বল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হবে হয়ত। এর পরিনাম হবে ভয়াবহ। এছাড়াও, বিপ্লব মাত্রেই বৈপ্লবিক কিছু দাবি করে, ‘ছোট ছোট দাবীসম সংস্কার’ দিয়ে কিছু হয় না।

         আমলাতন্ত্র, পুলিশ প্রশাসন আর বিচার ব্যবস্থা, অন্ততপক্ষে এই তিনটি ব্যবস্থাকে একেবারে বিলোপ করে যদি নতুনভাবে গঠন করা না যায় তবে সংবিধান সংস্কার করেও কতটুকু লাভ হবে, সেই ভয় জারি রেখে আশংকা করি, জুলুম কায়েম ছিলো, জুলুম থাকবে।

৫.

         খোদা আলিমূল গায়েব, ভবিষ্যত কেবল খোদাই জানে। কিন্তু ইতিহাসের পাঠ জানা থাকলে ভবিষ্যতের ধূলোমাখা রাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা কিছু দেখার ফুসরত অন্তত মেলে। তবে তাকাই আরব বসন্তের দিকে। জুলুমে জর্জরিত এক তিউনিসিয়ান হকারের আত্নাহুতির কারনে সমগ্র আরবে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়া বিদ্রোহের আজ প্রায় পনের বছর। পেছনে ফিরলে দেখা যায়, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়া আর সিরিয়াতে জালিমের শাসন রি-নিউ হয়েছে মাত্র। কিছুকিছু ক্ষেত্রে সাথে যোগ হয়েছে যুদ্ধ।

         তিউনিসিয়াতেই কেবল গনতান্ত্রিক পদ্ধতি চলছে, আছে বাক-স্বাধীনতা আর ভোটাধিকার। তাদের ‘তিউনিসিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টার’ ২০১৫ সালে নোবেল পায় তিউনিসিয়াকে একটি বিপ্লব পরবর্তী গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিনত করতে তাদের ভূমিকার কারনে। অর্থাৎ পুনর্গঠন সহজ নয়। এখনো প্রায়ই উত্তাল হয়ে ওঠে তিউনিসিয়া। কতদিন থাকবে তাদের এই অর্জন সেটা সন্দেহজনক।

         মিশরকে ধবংস করে দিয়েছে রাজপথ। বিরোধীরা মুরসিকে মানবেই না, কোনো বিষয়েই তারা একমত নয়। বিরোধীতা আর বিরোধীতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আর্মি চায় তবু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মানতে চায় না। আবার বিজয়ী মুরসি বিপ্লবের স্পিরিটের বাইরে গিয়ে কেবল নিজের ধ্যান-ধারনার একটি দেশ চান। বিপ্লবের শুরুতেই ভোটের জন্য ব্যকুলতা ছিলো তাদের কেননা সেখানে ভোটে তাদেরকে পরাজিত করার মত কেউ ছিলো না। রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব আর দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কেবল রাজপথ দখলকেই একমাত্র রাজনৈতিক এক্ট মনে করার কারনে মাত্র দুই বছরে পাঁচটি ইলেকশন/রেফারেন্ডাম আর কয়েকটি প্রতিবিপ্লবী আন্দোলনের ফল হিসাবে ক্ষমতায় আসেন ফাত্তাহ আল সিসি, মিশরের নতুন ডিক্টেটর। ভুলে গেলে চলবে না, মিশর শেষ পর্যন্ত একটি নতুন সংবিধান লেখা এবং পাশ করাতে পারেনি। আর ফাত্তাহ যখন আসে তখন বহু মানুষ বুঝে বা না বুঝে তাকে সমর্থন দিয়েছিলো।

         বাকি দেশগুলোর কথা আর না বলাই ভালো, গনতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে যুদ্ধের দিকে তাদের যাত্রা। কে না জানে যুদ্ধের দিকে যাত্রা মানেই তো পতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছানো। কেননা আধুনিক যুগে যুদ্ধ হচ্ছে এক হাবিয়া দোজখের নাম, যুদ্ধ শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না।

         বাংলাদেশের সাথে এইসমস্ত দেশের মিল কতটা? খুব বেশি নয় হয়ত, কিন্ত অমিলই বা কী? মুসলিম দেশ, বাংলাদেশেও ইসলামপন্থী এবং তাদের বিরোধীদের মধ্যে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব আছে।

         এই সমস্ত সবকিছুকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে একটা জিনিস, জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্যই হতে পারে একটি চুড়ান্ত ফয়সালা। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু কী হবে? কাকে ঘিরে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে?

মূল বিষয়গুলোতে কনসেনসাস না প্রতিষ্ঠিত হলে, সবসময় রাজপথের রঙ্গীন আহবানে কারনে-অকারনে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সাড়া দিলে, সরকারের পর সরকার আসবে আর আসবে বিপদের পর বিপদ। সে পুর্বাভাস কি এখনই দেখা যাচ্ছে না? রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশ একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আর ছাত্রদেরকেও আকাঙ্ক্ষাসমেত দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে, কেবল একটি ভোটের জন্য কেউ বিপ্লব করেনি, কিন্তু ভোটের মাঠের রমরমা ভবিষ্যতের দিকে অধিকাংশের নজর। কিন্তু আমি ভয় পেয়েই বলি, ভালো করে নজর করে সেখানে কি মিশরকে দেখতে পাওয়া যায় না? যদি পাওয়া যায়, জাতীয় ঐক্যের আগে কোনো নির্বাচন দেয়া হবে একটি কুঠারাঘাত।

আরেকটা বিষয় হলো, ক্ষমতাসীনের পতনের মাধ্যমে বিপ্লব শেষ হয় না, শুরু হয় মাত্র। এটিই বিপজ্জনক সত্য একারনে যে মানুষ আশা করে বিপ্লব শেষ এখন আসমানী উপায়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, আসলে তা হয় না। একটি পুরনো ব্যবস্থাকে সমূলের উৎপাটিত করে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করে সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সময়ের প্রয়োজন, এই সময়টা জনগন দেবে কি দেবে না তা ঠিক হবে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার উপর। এই বোঝাপড়া যত কম হবে, অস্থিরতা তত বেশি হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার ওয়ান এলেভেন এর সরকার বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে যে সর্বনাশা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলো, তারই ধারাবাহিকতায় এই ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

৬.

ভাতের প্লেটে টান না পড়লে কখনো বিপ্লব হয় না। এই কথা বলি আমি। বিপ্লব কিংবা অভ্যুত্থান যতটা রাজনৈতিক, ততটাই অর্থনৈতিক। ব্রিটিশ শাসনের পর দুইশ বছরে সবচেয়ে বেশি সম্পদ পাচার হয়েছে গত পনের বছরে। এর ফলে মানুষের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত চুরি হয়ে গেছে। এই অর্থনৈতিক ক্ষতি রাজনীতি দিয়ে কতটা পুষিয়ে দেয়া যায়? আসলে কি যায়? আমার ভয়ের মত হচ্ছে, না যায় না।

অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ত সংস্কার হয় কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ কি ফিরে আসে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসে না। এই ক্ষেত্রে একটি সমাধান হলো, আর্থিক টানাটানি হলেও ব্যবস্থাপনার টানাটানি না হোক। অর্থাৎ দুর্নীতি আর চাঁদাবাজী না থাকুক। অন্তত জনগন বুঝুক ব্যবস্থা ঠিক আছে, আস্থা রাখা যায়। আর যদি এই ফোকলা দেশটা ফের দুর্নীতি, ঘুষ আর চাঁদাবাজীর মচ্ছবে পরিনত হয় তবে তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ মুইজ্জু যে কিনা অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্থ একজন মানুষ পুলিশি দুর্নীতি আর হয়রানির প্রতিবাদে নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো আর সারা আরব বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলো উন্মাতাল বিদ্রোহ, সে এই দেশেও ফের ফিরে আসবে। ইতিহাস পাঠ থেকে জানি মুইজ্জুদের দেশ বলে কিছু নেই, আছে কেবল শ্রেনী।

         মূ বিষয় হলো, বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর দীর্ঘমেয়াদে হয়ত সমাধানের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে কিন্তু এই ভাঙ্গাচোরা অর্থনীতি ঠিক করার খুব সহজ কোন পদ্ধতি নেই, সয়ে নেয়াটাই সমাধান। কিন্তু মানুষের প্লেটে ভাত টান থাকলে, আর যদি থাকে অর্থনৈতিক অত্যাচার, সে বারবার ফিরে আসবে রাজপথে, কিন্তু কে না জানে, রাজপথ সবসময় দেয় না, ছিনিয়েও নেয়।

৭.

মানুষ শেষ পর্যন্ত আশাবাদী প্রানী, আমিও তাই। তবু বিদ্যমান ভয়সমূহের দোহাই দেয়া রইলো নিজের কাছে, পাঠকের কাছে। কিছু বিষয় হয়ত দ্রুতই সূর্যালোকের স্পষ্ট হবে, তবে দীর্ঘমেয়াদে ভাবলে ভবিষ্যত যে ধোঁয়াশা এবং সেই ধোঁয়াশা ভবিষ্যতকে ঘিরে যে রাজনৈতিক মেঘ ক্রমশঃই জমে উঠছে চারিদিকে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না।

মাত্র বিশ দিনে দেড় হাজার মানুষ হত্যা করে পালিয়ে গেছে এক ফ্যাসিস্ট-সেই অবস্থা আর এই দেশে ফিরে আসবে না বলেই ধারনা করি কেননা এই দেশের মানুষের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস অনেক পুরনো। ভয়সমূহকে জারি রেখেই বলি, প্রতিটি অভ্যুত্থান এই জাতিকে কিছু না কিছু দিয়েছে এবং পরবর্তী অভ্যুত্থান পুরাতন অভ্যুত্থানেরই একটি উন্নততর মডেল ছিলো বলে ধারনা করি। একাত্তরে দেশ পেয়েছে, নব্বইতে গনতন্ত্র। আর এইবার পেয়েছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, ফলে সব ব্যবস্থা, যার কিছু কিছু একাত্তর থেকে চলে আসছে, সেগুলোকে বিলোপ করে একটি লিবারাল গনতান্ত্রিক ধারার দিকে দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপূর্ণ যাত্রার আকাঙ্ক্ষা শুরু হলো। ভয় এবং আশংকা দুই হাতে ঠেলে সরিয়ে আশা করি, এই অভ্যুত্থানই হবে শেষ অভ্যুত্থান। এখন থেকে কেবল দেখতে পাব কেবল উত্থান।  

1 comment

  • Muhammad Shibli Shaid

    ৫ই আগস্ট খুব অদ্ভুত একটা দিন ছিলো। আরো অনেক আলোচনা-লেখা-বিশ্লেষণ হওয়া চাই। যেনো এই দিনটা কখনো “১৬ই ডিসেম্বর” এর মতো “পণ্য” না হয়ে যায়।

Leave your comment