সংবিধান কার জন্যে আইন? সংবিধান সরকারের জন্যে আইন। সংবিধান ব্যাখ্যা করে কীভাবে সরকার তৈরি হবে, সরকার কী করতে পারবে এবং কী করতে পারবে না। জুডিশিয়াল রিভিউ-এর মাধ্যমে সাংবিধানিক আদালত আইনসভার বিভিন্ন আইনের উপরে সংবিধানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নাগরিকরা যখন উচ্চ আদালতে যান, তখনো সংবিধানের কর্তৃত্বের দোহাই দিয়েই আদালতকে নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বলেন।
সংবিধানের ক্ষমতা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার মত না। সংবিধানের ক্ষমতা কিছুটা এবস্ট্রাক্ট। সংবিধানের ক্ষমতা কতোটুকু আসল, আর কতোটুকু নির্বাহী, আইন ও বিচারবিভাগের ক্ষমতাচর্চার ঢাল এটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের জনগণ এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাস এবং ক্ষমতার সম্পর্কের উপড়ে। সবচেয়ে বড় নির্যাতনকারীরাও সংবিধানকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে কেন্দ্রে রেখে আমরা এই আলোচনাতে ঢুকতে চাইব, ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিক ব্যত্যয় গুলোকেও দেখা উচিত প্রথমে। গৃহযুদ্ধের আগে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের ১৩ টি রাজ্যে স্লেভারি বৈধ ছিল। রাজ্য আইনের মাধ্যমে মানুষকে সম্পত্তি হিসেবে দেখার সুযোগ ছিল। আমেরিকার ফেডারেল সংবিধান রাজ্য আইনের ব্যাপারে চতুর্দশ সংশোধনী পর্যন্ত চুপ চাপ থাকত। এই ১৩ টি রাজ্যের মধ্যে ১১টি আমেরিকার ইউনিয়ন থেকে বেড়িয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় ১৮৬১ সালে, স্লেভারি বিরোধী আব্রাহাম লিংকনের নির্বাচন জয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তাদের এই নতুন রাষ্ট্র, কনফেডারেট স্টেইটস অফ এমেরিকাতে স্লেভারিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। গৃহযুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমেই কেবল এই দাস রাজনীতিকে পরাজিত করা গেছে। গৃহযুদ্ধের ফলাফল হিসেবে আমেরিকার সংবিধানের ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে স্লেভারির সাংবিধানিক সুযোগ শেষ করে দেয়া হয়। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নাগরিকদের জন্যে বৈষম্যের শেষ কিন্তু এর মাধ্যমে হয়নি। দাস ব্যবস্থা বন্ধ হলেও দক্ষিণের রাজনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের ক্ষতি সামলিয়ে ফিরে আসে।
নাগরিকদের মধ্যেও আফ্রিকান আমেরিকানদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখার বন্দবস্ত করা হয়, গড়ে উঠে কু ক্লুক্স ক্ল্যানের মত ভিজিলান্টি সংগঠন, যারা কালোদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা এবং টেরর ক্যাম্পেইন চালাতে থাকে। সমাজে থাকা এই চিন্তাগুলো আইনী রূপ পায় যখন দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ১৮৮০ এর পরে বিভিন্নধরনের বৈষম্যমূলক আইন পাশ হয়। এই আইনগুলো মূলত দুই ধরনের। একধরনের আইন ছিল দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটাধিকার সংকুচিত এবগ্ন কঠিন করে তোলার জন্যে। কিছু রাজ্যে পোল ট্যাক্স আরোপ করা হয়, অর্থাৎ ভোট দিতে গিলে টাকা দিতে হত। যদিও আইনে আফ্রিকান আমেরিকানদের কথা বলা ছিল না, তারপরেও আফ্রিকান আমেরিকানদের দারিদ্র্যের কারণে এই আইনের ভুক্তভোগী তারাই ছিল। কোথাও করা হয়, পরীক্ষা দিয়ে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তুলনামূলক অল্পশিক্ষিত আফ্রিকান আমেরিকানরা এই আইনের লক্ষ্য ছিল। এছাড়া ছিল আলাদা স্কুল, আলাদা পানি, খাবার ট্যাপ, ট্রেনে আলাদা বগী। ট্রেনের আলাদা বগী নিয়ে করা একটি মামলা ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায়। প্লেসই ভিএস ফার্গুসন নামের এই বিখ্যাত মামলায় ৭-২ ভোটে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট দক্ষিণের এই আইনগুলোকে, যাদেরকে একত্রে “Jim Crow regime” বলা হত, সংবিধান সম্মত হিসেবে রায় দেয়। তাদের যুক্তি ছিল দক্ষিণের রাজ্য সরকার আলাদা অবকাঠামোগুলোকে যদি একই গুনগত মানে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে চতুর্দশ সংশোধনীর ‘ইকুয়াল প্রোটেকশন আন্ডার ল’ ভায়োলেট হবে না। তাদের এই হাস্যকর ডক্ট্রিনকে বলা হত ‘সেপারেট বাট ইকুয়াল’। ১৯৫৪ সালে ব্রাউন বনাম বোর্ড অফ এডুকেশন মামলায় শেষ পর্যন্ত ১৮৯৮ সালের রায় বাতিল হয়, এবং অফিশিয়ালি জিম ক্রো রেজিমের বিদায়ঘন্টা বাজে। রাজনৈতিক এবং সামজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালে ভোটিং রাইটস এক্ট এবং সিভিল রাইটস এক্ট পাশ হয়।
ইতিহাসে তাই সংবিধান এবং আইনী বন্দোবস্ত কখনই গনিতের উপপাদ্যের মত কাজ করে না। সমাজে যদি কোন প্রবণতা জনপ্রিয় হয়, এবং সেই প্রবণতাগুলোর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে, তাহলে সংবিধানের লুপহোল ব্যবহার করে একটি গোত্র অন্য গোত্রের উপরে অত্যাচার করতে পারে, সেই অত্যাচারকে আইনসিদ্ধ বলে সাফাই গাওয়ার লোকজনও পাওয়া অসম্ভব না। আমরা দেখেছি পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কীভাবে সুবিধামত সংবিধানের দোহাই ব্যবহার করত।
সুতরাং সংবিধান কী হওয়া উচিত সেই আলোচনার চেয়ে সংবিধান কেমন হলে রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার, রাজনৈতিক এক্সপ্রেশন ইত্যাদি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, সেই আলোচনা আমার মতে বেশী ফলপ্রসূ হবে।
সংবিধানের হওয়া উচিত নির্মেদ এবং মিনিমালিস্ট। সংবিধান এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের নিদান দিবে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান বিভিন্ন মাত্রার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে করা যাবে। সংজ্ঞা অনুসারেই সংবিধান লিখিত হয় দীর্ঘ সময় টিকে থাকার জন্যে। সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়াও থাকে অনেক দুরূহ। তাই সংবিধানকে সংক্ষিপ্ত হওয়া জরুরী, স্থান-কাল্প-পাত্র ভেদে বিভিন্ন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাধান সংবিধানে খোজা কাম্য নয়। সংবিধানের স্কোপ যত বড় হবে, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের নাগরিকদের হাত থেকে সেলফ গভর্নমেন্টের অধিকার ততটাই কেড়ে নেয়া হবে।
সংবিধানের এই বৈশিষ্ট্য যদি স্বীকার করে নেই, তাহলে প্রশ্ন আসে কী কী বিষয় সংবিধানের বেইজলাইন হতে পারে? ইতিহাস ঘেঁটে সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্যগুলো টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশী সেগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।
প্রথমত, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে তৈরি হবে, কীভাবে ক্ষমতার বিন্যাস হবে, নাগরিকরা এই ব্যবস্থায় কীভাবে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করবে, কী কী প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের ক্ষমতা প্রয়োগের প্রক্সি হবে ইত্যাদি হচ্ছে সংবিধানের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। সংবিধানের ফ্রেইমওয়ার্ক অনুসারেই রাষ্ট্রের আইন, বিচার এবং নির্বাহী ক্ষমতা বিন্যাসিত হবে, এবং এই ক্ষমতার আভ্যন্তরিন সম্পর্কগুলো নির্দিষ্ট হবে।
দ্বিতীয়ত প্রথম অংশে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা সংবিধানে দেয়া থাকবে তাদের ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে সংবিধান সুনির্দিষ্টভাবে মন্তব্য করবে। থাকবে নাগরিকদের সিভিল এবং পলিটিক্যাল রাইটসের বিবরণ, রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেই অধিকারগুলোকে মানতে বাধ্য থাকবে।
এই পর্যন্ত আমরা সংবিধানের খুবই এবস্ট্রাক্ট একটা বর্ণনা পেলাম। সংবিধান তার এই এবস্ট্রাক্ট শরীরকে কীভাবে এনফোর্স করবে? অন্য কথায় কী ধরনের স্ট্রাকচার থাকলে সংবিধানের এনফোর্সমেন্ট সহজ হয়? সংবিধান যেহেতু মানুষের জন্যেই, সুতরাং মানব চরিত্রের বিভিন্ন পজিটিভ এবং নেগেটিভ বৈশিষ্ট্যকে যদি আমলে নেয়া না হয়, তাহলে সংবিধান শুধু একটা সুন্দর কাগজ থেকে যাবে, সংবিধান শুধু ব্যবহৃত হবে শক্তিমানের ঢাল হিসেবে।
আলোচনার এই জায়গায় এসে আমরা সংবিধানের একটা সাফল্যের সূচক চিন্তা করতে পারি। সংবিধানকে আমরা সফল বলব তখনই যখন সংবিধান থেকে তৈরি হওয়া রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সফল হবে, রাজনৈতিক বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান দিতে পারবে এবং ক্ষমতার পরম্পরাকে সংঘাতমুক্ত করতে পারবে।
আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনেক সিলসিলা গ্রীক নগররাষ্ট্র হয়ে রোমান রিপাবলিক ইত্যাদি থেকে টানা সম্ভব হলেও সাংবিধানিক রিপাবলিকের শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যায্য করারোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন ১৭৭৬ সালে এসে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৩ টি কলোনি এই সংগ্রামে যোগ দেয় এবং প্রায় সাত বছর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ রাজকীয় সেনাবাহিনী পিঠটান দিলে শুরু হয় স্বাধীন আমেরিকার যাত্রা। যুদ্ধের সময় বিদ্রোহী কলোনিগুলো কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস নামের আইনসভা তৈরি করেছিল। যুদ্ধের পরে নতুন আমেরিকার সরকার কেমন হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়। প্রাথমিকভাবে ভাবা হচ্ছিল যেহেতু প্রতিটি রাজ্যেই নিজেদের আইনসভা এবং নির্বাহী বিভাগ ছিল, সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারে বেশী কিছু থাকার দরকার নেই। সেই ভাবনার ফলাফল আমেরিকার প্রথম সংবিধান ‘আর্টিকেলস অফ কনফেডারেশন’। এই সংবিধান অত্যন্ত দুর্বল ফেডারেল গভার্ন্মেন্ট তৈরি করে যেখানে রাজ্যগুলোর কনসেন্ট ছাড়া প্রায় কিছুই করা যেত না। নতুন সংবিধান কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই দেখা গেল যে অনুমানগুলো করা হয়েছিল তার কিছুই খাটছে না। রাজ্যগুলো একে অপরের সাথে বিভেদে জড়াচ্ছে, একজন অন্যজনের পণ্যের উপর ট্যারিফ বসাচ্ছে। কিছু আঞ্চলিক বিদ্রোহ মোকাবেলার সময় দেখা গেল রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সময়েও রাজ্যগুলো সংকীর্ণ স্বার্থের বাইরে চিন্তা করতে পারছে না। পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে আমেরিকা অনেক ভাগ হয়ে যাবে এই সম্ভাবনাও তৈরি হইল।
আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা বুঝতে পারলেন, আর্টিকেল অফ কনফেডারেশন দিয়ে কাজ হবে না। বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিকরা ফিলাডেলফেলিয়াতে মিলিত হইলেন, উদ্দেশ্য নতুন সংবিধান লেখা। এই সংবিধান লেখার সময় তারা আর্টিকেল অফ কনফেডারেশন কেন ব্যর্থ হয়েছিল তার চুলচেড়া বিশ্লেষণ করলেন। গ্রীক নগররাষ্ট্র থেকে রোমান রিপাবলিক, জনগণের অংশগ্রহনমূলক সকল ব্যবস্থা কেন ব্যর্থ হয় তা নিয়ে আলাপ করলেন। সাংবিধানিক সভা শেষে যেই ড্রাফট তৈরি হইল তাকে প্রত্যেকটা রাজ্য নিজদের রাজ্যের আইনসভায় র্যাটিফাই করলেই নতুন সংবিধান কার্যকর হবে। নতুন সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বেশী হয়ে গিয়েছে এরকম দাবি করে এই সংবিধানের বিরোধীরা প্রচারণা চালাতে লাগলেন। সংবিধান বিরোধীরা প্রভাবশালী এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ রাজ্য নিউ ইয়র্কে বেশ ভালো সমর্থন পেলেন। এমন সম্ভাবনা তৈরি হইল নিউইয়র্ক সংবিধানের বিপক্ষে চলে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে সংবিধান কনভেনশনের তিনজন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, জেমস ম্যাডিসন এবং জন জে নিউইয়র্কের পত্রিকায় এই সংবিধানের বিভিন্ন দিকের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে লেখালিখি করেছিলেন। এই আর্টিকেলগুলোতে শুধু আমেরিকার সংবিধানই নয়, সেই সাথে আমেরিকার সংবিধান লেখকদের রাষ্ট্র সম্পর্কে দর্শন, রাজনৈতিক বাস্তবতার ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিস্তর আলোচনা থাকায়, এই আর্টিকেলগুলো একাডেমিয়ায় এবং সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে পঠিত হয়। এই আর্টিকেলগুলো একত্রে “ফেডারেলিস্ট পেপার্স” নামে পরিচিত।
ফেডারেলিস্ট পেপার্সের একটি অনবদ্য বিষয় হচ্ছে এর প্র্যাগমেটিজম। এটি কোন বিপ্লবী ডকুমেন্ট না। বরং মানব চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকে কীভাবে ইফেক্টিভ আইনী পথে পৌঁছানো যায় সেই আলোচনা বারবার এসেছে। ক্ষমতাকে বেনেভোলেন্ট ধরে না নিয়ে, কীভাবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে আরেকটি ক্ষমতা তৈরি করে ব্যালেনস করা যায় সেই আলাপ আছে।
ফেডারেলিস্ট এর ১০ নম্বর পেপারটি লিখেছিলেন জেমস ম্যাডিসন, যেখানে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘ফ্যাকশন’ নিয়ে। ম্যাডিসিন শুরু করেছেন এই প্রশ্ন দিয়ে ‘কাদের জন্যে এই সংবিধানের বিপক্ষে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত?’। তিনি উত্তর দিয়েছেন নতুন সংবিধানের ফলে যাদের পদ/পদবী/প্রিভিলেজ ইত্যাদি কমার সম্ভাবনা আছে তারা যৌক্তিকভাবেই এর বিরুদ্ধে থাকবে। এই গ্রুপটিকে তিনি পারসুয়েড করতে আগ্রহী নন। বরং সরাসরি কায়েমি স্বার্থ বাদেও যারা তাদের নিজেদের বায়াস এবং যুক্তির মাধ্যমে এই সংবিধানের বিরুদ্ধে যেতে পারেন, তাদের উদ্দেশ্যেই তিনি লিখছেন।এরপর আলোচনা গড়িয়েছে ফ্যাকশন নিয়ে। ফ্যাকশনের যে সংজ্ঞা তিনি দিয়েছেন তা হচ্ছে এমন একটি গ্রুপ যারা এমন কোন স্বার্থ বা ইডিওলজি/মতবাদের কারনে ঐক্যবদ্ধ হয়, যেই স্বার্থ-ইডিওলজি-মতবাদ রিপাবলিকের কমন ইন্টারেস্টের বিপক্ষে যায় অথবা অন্য নাগরিকের অধিকার হরণ করতে চায়। ফ্যাকশন হয় রিপাবলিকের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে অথবা অন্য নাগরিকের অধিকার কেড়ে নিতে পারে। এর থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও ম্যাডিসন আলোচনা করেছেন।
ম্যাডিসনের মতে মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে ফ্যাকশনের উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী। মানুষের নিজের স্বার্থ কে ন্যায় মনে করা, নিজের ইডিওলজিকে সঠিক মনে করা স্বাভাবিক। গ্রুপ তৈরি হলে মানুষ আরো ভ্যালিডেশন পায় এবং নিজের মতে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মেজরিটি ফ্যাকশন তৈরি হওয়ার অর্থ হচ্ছে রিপাবলিকে যে মত/পথের ডাইভার্সিটি আছে সেটিকে রাজনৈতিকভাবেই ধ্বংস করার প্রবণতা তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়।
ফ্যাকশন রিপাবলিকের জন্যে যেই সমস্যা তৈরি করে তার থেকে উত্তরণের উপায় কী। ম্যাডিসনের মতে ফ্যাকশন তৈরি যেহেতু স্বাভাবিক ঘটনা, মানুষের অধিকার কেড়ে না নিয়ে ফ্যাকশন তৈরি থামানো যাবে না। সুতরাং চিন্তা করতে হবে কীভাবে ফ্যাকশনের প্রভাব নিউট্রালাইজ করা যায়।ম্যাডিসনের মতে সমাধান হচ্ছে দুই ধরনের। প্রথমত, রিপাবলিকের আকৃতি বড় হতে হবে, যাতে অনেক ধরনের ভ্যারিয়েশন থাকে জনগণের মধ্যে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাকশন তৈরি হবে, এবং কোন ফ্যাকশন ডমিনেনট হতে পারবে না। এইটাকে আমরা বলতে পারি হরিজন্টাল সমাধান। ম্যাডিসন একটা ভার্টিক্যাল সমাধানও দিয়েছেন। সেপারেশন অফ পাওয়ার যদি ক্ষমতার প্রতিটা স্তরেই থাকে তাহলে ফ্যাকশনগুলোও তাদের ন্যাচারাল দখলদাড়ি মানসিকতা ক্ষমতার বিভিন্ন পকেটে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। ফ্যাকশন যেহেতু ‘ওয়ান ডাইমেনশনাল’, (ফ্যাকশন কিন্তু রাজনৈতিক দল না, রাজনৈতিক দল এইরকম ওয়ান ইস্যু গ্রুপ না) সেহেতু যে ক্ষমতার পকেটে তাদের ইস্যুর সাথে সামঞ্জস্য আছে, তারা সেখানেই মনোযোগ দেয়। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সমকালীন বিতর্ক থেকে এই ব্যাপারটাকে ভালো বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে কোন কেন্দ্রীয় পাঠ্যপুস্তক লেখা/নির্বাচনের বোর্ড নেই। ফেডারেল গভার্নমেন্টের ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন কোন শিক্ষা বোর্ড না। এটি মূলত রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, টেস্টিং স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে। পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন হচ্ছে স্থানীয় স্কুল ডিস্ট্রিক্ট এর এক্তিয়ার। প্রতিটি স্কুল ডিসট্রিক্ট গুলো একটি এলাকার অনেকগুলো সরকারী স্কুলকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের দায়িত্বে থাকে এই বোর্ডগুলো। স্কুল বোর্ড যেহেতু ভোটে নির্বাচিত হয়, তাই বই নিয়ে এক্টিভিজম করা সামাজিক গ্রুপগুলো সাধারণত স্কুল বোর্ডের নির্বাচনে জয়, কিংবা তাদের নীতি নির্ধারনী সভাগুলোতে তাদের দাবি পেশ করা, এইসব কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। এই প্রবণতাগুলো তাই স্থানীয়ভাবেই সমাধান হয়ে যায়। দেশজুড়ে মেজরিটি ফ্যাকশন বানিয়ে পুরো গভার্নমেন্টকে চাপে ফেলার দরকার হয় না। অন্যদিকে যেই অঞ্চলের মানুষ যে ধরনের বিশ্বাস রাখে তাদের স্কুল বোর্ড সেই ধরনের পাঠ্যবই নির্বাচন করে। আবার প্রতিটি স্কুল বোর্ডের স্বাতন্ত্র্য থাকায় ডিসট্রিক্টগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকে। কোন বোর্ডের সিদ্ধান্তের ফলে যদি ঐ বোর্ডের অধিনস্ত স্কুলগুলো খারাপ ফলাফল করে, পরবর্তী নির্বাচনে স্কুল বোর্ডের মেম্বাররা হেরে যেতে পারেন। বইপত্র নিয়ে এক্টিভিজম তাই পুরো দেশ জুড়ে একটা যুদ্ধংদেহী মেজরিটারিয়ান শক্তি হিসেবে আবিভূর্ত হতে পারে না। অন্যদিকে যেহেতু ফেডারেল ডিপার্টপেন্ট অফ এডুকেশন স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট এর ব্যবস্থা করে সকল শিক্ষার্থীর এবং এই টেস্টের ফলাফল দ্বারা বিভিন্ন স্কুল বোর্ডকে একাউন্টেবল করা হয়, তাই স্কুলবোর্ড গুলো শুধু কালচার ওয়ার এর মত আনপ্রোডাক্টিভ বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে পারে না সবসময়।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের স্ট্রাকচারের পেছনে যেই চিন্তাভাবনা কাজ করেছে তার পুরোটাই হচ্ছে কীভাবে গভার্নমেন্টকে বেঁধে ফেলা যায়, গভার্নমেন্ট যাতে অর্গানিক রাজনৈতিক যেই প্রক্রিয়া, সেখানে কোন ইউনিল্যাটারাল শক্তি ব্যবহার না করতে পারে কোন একটি পক্ষের হয়ে। ফেডারেলিস্ট পেপারে তাই কোন জাতীয় ঐক্য বা জাতীয় সরকার এই ধরনের চিন্তাভাবনা খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সমাজের সাধারণ সত্য। সংবিধানের কাজ এই প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নয়, বরং এই প্রতিযোগিতা সরকারের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে দেয়া, এবং কোন পক্ষ যাতে অপর পক্ষের রাজনৈতিক অধিকার সীমিত না করতে পারে সেই বন্দবস্তের নিদান দেয়া। একারণেই ফেডারেলিস্ট পেপার্সে চেকস এন্ড ব্যালেন্সেজ এর কথা এত বেশী এসেছে।
ম্যাডিসন ৫১ নং পেপারে সেপারেশন অফ পাওয়ার নিয়ে আলোচনা করেছেন। ক্ষমতাকে তিনি ভাগ করতে চেয়েছেন এবং প্রতিটি ক্ষমতাকে ভিন্ন একটি ক্ষমতার কাছে মুখাপেক্ষী রাখার কথা বলেছেন। ম্যাডিসন মনে করেন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ শুধু মাত্র আরেক পক্ষের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দিয়েই চেক করা সম্ভব। আমেরিকান সংবিধান আইন/বিচার/নির্বাহী বিভাগের কিছু স্বতন্ত্র ক্ষমতা দিয়েছে। এই বিভাগগুলোর নির্বাচন/মনোনয়ন যেহেতু আলাদা সেহেতু প্রতিটি বিভাগের নিজের বিভাগের ক্ষমতার ব্যাপারে উচ্চাভিলাষ তৈরি হয়, কিন্তু তার ক্ষমতা প্রয়োগের জন্যে যেহেতু অন্য বিভাগের উপরে নির্ভর করতে হয়, সেহেতু ইউনিল্যাটারাল ক্ষমতা প্রয়োগ কঠিন হয়ে উঠে। প্রতিটি বিভাগের কিছু ক্ষমতা সংরক্ষিত থাকায় অন্য বিভাগ যদি ঐ ক্ষমতায় ভাগ বসাতে আসে, তাহলে প্রতিটি বিভাগ নিজের ক্ষমতাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে।
সরকারের প্রতিটি বিভাগকে অন্য বিভাগের উপরে নির্ভরশীল রাখার, এবং একটি বিভাগ যদি অন্য বিভাগের ক্ষমতায় ভাগ বসায় তাহলে ঐ বিভাগের বিরুদ্ধে রিটালিয়েট করার টুলস যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান দেয়। কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সুতরাং ম্যাডিসন বলছেন, সংবিধান অনুসারে সরকার গঠন মাত্রই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শেষ নয়। বরং সরকারের ভেতরেও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যাতে চলতে পারে, সরকার যাতে একটি ইউনিট হিসেবে আচরণ না করতে পারে। এধরনের স্ট্রাকচার এফিশিয়েন্সি বিরোধী। আমেরিকার সরকার খুবই বিখ্যাত অচলাবস্থার জন্যে। যেহেতু সরকারের সকল অংশেই তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চলে, সেহেতু ড্রেডলক খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেহেতু ভুলভাবে প্রয়োগে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী, তাই এই কলহপ্রবণ এবং অচলাবস্থাকে ইন্সেন্টিভাইজ করাটা আসলে বাই ডিজাইন করা হয়েছে। ম্যাডিসন এই এই প্রসঙ্গে বলেছেন প্রতিযোগিতা, একে অন্যকে থামানোর ক্ষমতা ইত্যাদির মাধ্যমে আসলে সংবিধান যেকোন ধরনের একাট্টা রাজনৈতিক ফ্যাকশন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ম্যাডিসন ফেডেরেলিস্ট ৫১ এর উপসংহারে বলেন রিপাবলিকান রাষ্ট্রের সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে টিরেনি অর্থাৎ অত্যাচারী শাসন বাধা দেয়া। সরকারের বিভাগগুলোর মাধ্যমে যেভাবে টিরেনি তৈরি হতে পারে, তেমনি ম্যাডিসন উল্লেখ করেছেন ‘টিরেনি অফ মেজরিটি’ রিপাবলিকান রাষ্ট্রের জন্যে হুমকি। মেজরিটি যদি রাষ্ট্রের সকল অংশ দখল করতে সক্ষম হয়, এবং তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন মাইনরিটিদের জন্যে অধিকার রক্ষা অসম্ভব হয়ে পরে। মাইনরিটি রাইটস এর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের এই আলাদা অনুভূতিশীলতা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ফসল। যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিগুলোতে প্রথম দিকে যারা বসতি করেছিলেন এরা অধিকাংশই ছিলেন ধর্মীয় কারনে ইংল্যান্ডে অত্যাচারিত প্রোটেস্টানদের পিউরিটান মাজহাবের সদস্য। ম্যাডিসন চেকস এন্ড ব্যালেন্সের মাধ্যমে মেজরিটি যাতে সহজে মাইনরিটির উপর কিছু চাপিয়ে না দিতে পারে সেই ব্যবস্থা সংবিধানে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের কিছু উদাহরণ দেখতে পারি কীভাবে চেকস এন্ড ব্যালেন্সেজকে ইমপ্লিমেন্ট করা হয়েছে।
আইনসভায় পাশ হওয়া আইন প্রেসিডেন্ট ভেটো দিতে পারে। অন্যদিকে আইনসভা দুই তৃতীয়াংশ মেজরিটি ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের ভেটো ওভাররাইড করতে পারে। ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তার একটি ভেটো কংগ্রেস ওভারাইড করেছিল। এই রিটালিয়েশনের সুযোগ থাকার ফলে প্রেসিডেন্ট চাপে থাকে অজনপ্রিয় ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে যেহেতু ফ্লোর ক্রসিং এর কোন বাধা নাই সেহেতু কোন ইস্যুতে প্রেসিডেন্টের দলের কিছু সংখ্যক রিপ্রেজেন্টেটিভ বা সিনেটরকে দলে টানতে পারলে প্রেসিডেন্টের ভেটো ওভাররাইড করতে পারে। অন্যদিকে আইন সভার আইন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট জুডিশিয়াল রিভিউ এর মাধ্যমে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারে। যদি কোন সুপ্রিম কোন সুপ্রিম কোর্ট জুডিশিয়াল এক্টিভিজমের মাধ্যমে আইন বিভাগের করা আইন অন্যায্য বা রাজনৈতিক কারনে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে থাকে তাহলে? যুক্তরাষ্ট্রে আইনসভা এবং নির্বাহী বিভাগের নির্বাচন আলাদা, টেনেউড় আলাদা। প্রেসিডেন্ট ৪ বছরের জন্যে নির্বাচিত হন। অন্যদিকে নিম্নকক্ষে ২ বছর এবং উচ্চকক্ষে ৬ বছরের মেয়াদ থাকে। এর ফলে যেকোন মুহুর্তে সরকারের নির্বাহী এবং আইন বিভাগের মানুষরা ভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্যও তাই বিভিন্ন হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের কোন মেয়াদ নেই। তারা অবসর না নেয়া পর্যন্ত কাজ করে যেতে পারেন। তবে তাদের মনোনীত হতে হলে সিনেইটে ভোটে পাশ করে আসতে হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র নিয়োগের সময় ছাড়া তাদের উপরে নির্বাহী বিভাগের কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না। কিন্তু আইন বিভাগের দুইটি বিশেষ ক্ষমতা আছে যার মাধ্যমে জুডিশিয়াল এবিউজ থামানো যায়। প্রথমটি গুরুতর অপরাধ বা দুর্নীতির ঘটনার ক্ষেত্রে আইন বিভাগ বিচারকদের অভিশংসন করতে পারে। অন্যদিকে দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ এর আকার সংবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট না, বরং কংগ্রেস আইন করে নির্ধারন করতে পারে। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এর সময়ে ঐসময়ের সুপ্রিম কোর্ট মন্দা মোকাবেলায় করা অনেকগুলো আইন আটকে দিয়েছিল। তখন কংগ্রেস হুমকি দেয় সুপ্রিম কোর্টের আকৃতি ৯ থেকে ১৩ নিয়ে যাওয়া হবে। তখন সুপ্রিম কোর্ট পিছিয়ে যায়। অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগের আইনে ভেটো দিতে পারে, আইন বিভাগকে পাশ কাটিয়ে সাময়িক ‘আইন’ বা ‘এক্সেকিউটিভ একশন’ নিতে পারে। এই এক্সেকিউটিভ একশনগুলো আবার জুডিশিয়াল রিভিউ পার করতে হয়, এবং ইতিহাসে দেখা যায় এক্সেকিউটিভ একশন সবচেয়ে বেশী জুডিশিয়াল রিভিউ এর মুখে পরে।
সংবিধানের অক্ষর শেষ পর্যন্ত কাগজেই থাকে। সংবিধান কার্যকর হয় শেষ পর্যন্ত জনগণের কনশেনসাস এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে। মানুষের সাধারণ প্রকৃতি যদি হয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা, সেহেতু সংবিধানের মূল কাজ হবে কিছু বাধ্যবাধকতা বা লোয়েস্ট কমন ডিনমিনেটর উপস্থাপন করা। এই তালিকা যাতে ছোট এবং নির্দিষ্ট হয়, এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কাছে এই রুলস অফ দ্যা গেইমকে ফেয়ার এবং তাদের নিজ স্বার্থের জন্যে বড় বাধা হিসেবে না উপস্থিত হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা ১/১১ এর গনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ দেখতে পারি। যেইটা রাজনৈতিক দলগুলো মানার ভান করে, কিন্তু কেউই বেশী গুরুত্ব দেয় না কারন রাজনৈতিক দলগুলো জানে কাগুজে কমপ্লায়েন্স ছাড়া এই বিষয়গুলো এনফোর্স করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব না। সুতরাং সংবিধানের প্রথম গুরুতপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত ছোট এবং সুনির্দিষ্ট হওয়া।
সংবিধান যেন ভবিষ্যতের রাজনীতির স্পেস নষ্ট না করে। রাজনীতি সমকালীন বিষয়। শুধুরাং ভবিষ্যৎ নাগরিকরা কি নিয়ে রাজনীতি করবে তা নির্ধারন করে দেয়ার এক্তিয়ার সংবিধানের থাকা উচিত না। সংবিধান নিশ্চিত করবে অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত যাতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং সিদ্ধান্তের পক্ষের লোকজন যাতে সিদ্ধান্তের ফলাফলের ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে একাউন্টেবল থাকে।
সংবিধান এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করবে যার মূলনীতি হবে ধীরে চল। যেহেতু রাষ্ট্রের যেকোন সিদ্ধান্তের প্রভাব নাগরিকদের জন্যে অনেক গুরুতপূর্ণ হতে পারে, সেহেতু প্রতিটা বিষয় নিয়েই যাতে রাজনৈতিক বিতর্ক হতে পারে, ঐক্যমত্য তৈরি হওয়ার সুযোগ যেন থাকে। ফরেন পলিসি, প্রতিরক্ষা এই জাতীয় গুটিকয়েক বিষয় ছাড়া বাকি অধিকাংশ বিষয়েই রাষ্ট্রের ধীরে চলা উচিত এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলো যাতে এম্পাওয়ার্ড অনুভব করে যে তাদের বিরোধিতা বা সমর্থনের সুযোগ আছে।
সবশেষে সংবিধানের মৌলিক যায়গা হচ্ছে নাগরিকদের সিভিল এবং রাজনৈতিক লিবার্টিকে রক্ষা করা। এই ব্যাপারে বিশেষত বিচারভাগকে ক্ষমতা দিতে হবে বেশী যাতে নাগরিকরা নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। স্বাধীন কিন্তু ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারবিভাগ ছাড়া নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেমন সংরক্ষিত হয় না, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগও সংকুচিত হয় যদি না কোর্ট কন্ট্রাক্ট বা অন্যান্য ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় এনফোর্স না করতে পারে।