১.
জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জনপরিসরে (বাস্তব ও অপরবাস্তব/ভারচুয়াল) অসংখ্য আলাপ ও স্বরের মধ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রগড়ার বাসনা উচ্চারিত হচ্ছে প্রবলভাবেই। আমি এই বহুস্বরের উচ্চারণের প্রতি অনুরাগ ও সহমত ব্যক্ত করি। গণঅভূত্থানের একজন অনুসারী ও সমর্থক হিসেবে। জনপরিসরে বহু শব্দ/প্রত্যয় এখন অনেক জোরেশোরে উচ্চারিত ও ব্যক্ত হচ্ছে (আবার বহু শব্দ/প্রত্যয় ব্যক্ত হচ্ছেও না)। যেকোনো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বদলের আকাঙ্খা ব্যক্ত করায় বিভিন্ন পক্ষ যখন তৎপর থাকে, তখন সকল উচ্চারণ-স্বর-অভিব্যক্তি সমান ভাবে ব্যক্ত ও শ্রুত হয় না। বলা ও শোনার মিথষ্ক্রিয়ার সঙ্গে অসমতা (অথবা বৈষম্যের) ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকে। ক্ষমতার সম্পর্ক (যা সকল ক্ষেত্রে ও সকল পরিসরেই অসম) এই মিথষ্ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অপরবাস্তব পরিসর আমার অভিব্যক্তি-উচ্চারণ-ভাষা-অনুভূতিকে যেভাবে প্রবলভাবে গঠন করে চলেছে সেখানে এই মিথষ্ক্রিয়ার জটিলতা আরো বেড়েছে।
ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শব্দদুটোকে যদি আমি ঐতিহাসিক ও জেনেরিকভাবে পাঠ না করি তাহলে স্পষ্টতই এই অভ্যূত্থানের সঙ্গে একটি বৈষম্যমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ব নিশ্চিতকারী রাষ্ট্রব্যবস্থার বাসনা লেপেটে রয়েছে। বৈষম্য যেমন নানাবিধ পরিসরে ক্রিয়াশীল, তেমনিই বহুত্বকেও বহুবিধভাবে উপলব্ধি করার বিষয় থাকে। বিংশ শতকে নাৎসী মতবাদের পাশাপাশি ফ্যাসিজম যেভাবে ইটালিতে বিকশিত হয়েছিল, সেই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য, প্রয়োগ আর সহিংসতার সঙ্গে অবশ্যই হালে ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট শব্দের ব্যঞ্জনার সম্পর্ক থাকলেও ফারাকও রয়েছে। থাকা স্বাভাবিকও। তবে বুনিয়াদীভাবে একটি কতৃত্ববাদী, বলপ্রয়োগবাদী, সহিংস, অলিগার্কিকাল, স্বৈরাচারী, স্বাধীনতাবিদ্বেষী এবং প্রকট অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামজিক, সাংস্কৃতিক অসমতা একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিরাজমান রয়েছে। মানুষ ও না-মানুষের হক্ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধউত্তরকালে তৈরি হওয়া বহু বাহাছ, ও নতুন নীতি ও কনভেনশন তৈরি হওয়া, তারও পরে কোল্ড ওয়ার পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা, নতুন নতুন সংঘাত ও সহিংসতার দিগন্ত বিস্তৃত হওয়া, ৯/১১ পরবর্তীকালে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের নামে বৈশ্বিক মার্কিন-ইউরোপীয় আগ্রাসনসহ অন্যান্য বহুবিধ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শাসনের প্রকল্প ও তৎপরতার মধ্যে ফ্যাসিজমের প্রকাশ ও বৈশিষ্ট্যাবলি বিস্তৃত হয়েছে। তবে আমার আলাপ ফ্যাসিবাদের নানাবিধ প্রকাশ, বিবিধতা আর রূপান্তর নিয়ে নয়। এই ছোট লেখায় আমি বরং আমাদের জনপরিসরে বহুল উচ্চারিত কয়েকটি শব্দ ও বাসনাকে বিবেচনা করতে আগ্রহী।
ফ্যাসিবাদী ইতিহাস চিন্তা ও চর্চার প্রসঙ্গ দিয়ে আমি শুরু করতে চাই। আপাত দৃষ্টিতে ফ্যাসিবাদ ও ইতিহাস চর্চার অন্তরঙ্গতা নিয়ে আলাপচারিতা হালের বাংলাদেশের জনপরিসরের উত্তুঙ্গ ও বিস্ফোরিত আলাপচারিতায় অত্যন্ত গৌণ একটি বিষয়। তবে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে অন্যদিকে আমার জিজ্ঞাসার একটি অন্যতম প্রসঙ্গ এই অন্তরঙ্গতা। কেবল আমার আগ্রহের বা মনোযোগের প্রসঙ্গ বলেই না। বাংলাদেশে প্রবল ইতিহাস ও অতীত বোঝাপড়ার ধরন এবং সেসম্পর্কিত পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বিভিন্ন বয়ানে যেভাবে ইতিহাস ও অতীতের প্রসঙ্গ অবিচ্ছেদ্য হিসেবে হাজির থাকে, সেখানে এসব বয়ানের ধারণা ও পদ্ধতিগত দুর্বলতা, ভ্রান্তি ও যার যার প্রয়োজনমাফিক উপাত্ত বাছাই করে, পরিবর্তন করে আর রাষ্ট্র-রাজনৈতিক-ক্ষমতাগত স্বার্থ অনুসারে ব্যাখ্যা করাকে বুঝতে গেলেও এই আলাপ অত্যন্ত জরুরি। আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় ফ্যাসিবাদী চৈতণ্য, চর্চা ও ধারণার অন্যতম বুনিয়াদ হলো জাতীয়তাবাদ এবং পরিচয়বাদ। উল্টোটাও সত্যি। জাতীয়তাবাদ ও পরিচয়বাদী ধারণা, বাসনা, সংবেদন অতীতের ব্যাখ্যা, উৎপাদন আর পরিবেশনের মাধ্যমে কেবল ডিসকার্সিভ পরিসরেই নয়, পাশাপাশি সংবেদন ও চৈতণ্যের গভীরে ফ্যাসীবাদী অভ্যাস-আকাঙ্খা-আবেগ-অনুভূতি-মনোভঙ্গির ক্রমাগত পরিবর্তনশীল গঠনে তৎপর ভূমিকা রাখতে থাকে। ডিসকার্সিভ পরিসরে আমরা ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের মতন শাস্ত্রগুলোর নিজেদের মতন বাছাই করা, সেন্সর করা, অতিরঞ্জিত করা, বাসনাতাড়িত কল্পনাজারিত আলাপ করতেই আরাম পাই। এই আলাপের বিভ্রান্তি, সঙ্কট, সমস্যাগুলো নিয়ে কথাবার্তা ও বাহাস একদমই লঘু ও অনুচ্চারিত। আর হালের জনপরিসরে বাংলাদেশের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব এবং জনসংস্কৃতি সম্পর্কিত জনপ্রিয় বয়ানগুলোতে ডিসকার্সিভ দশার বাইরের অথচ ওই দশার সঙ্গে সম্পর্কিত সংবেদ ও চৈতন্যগত প্রসঙ্গগুলো পুরোপুরিই অগ্রাহ্য করা হয়।
আমার প্রস্তাব হলো, ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যক্তির অতীতের আখ্যান উৎপাদন ও সঞ্চালনের প্রবল ঐতিহ্য ও তৎপরতা ( যেমন: ডিসকোর্স খাড়া করা, খারিজ করা, সরল করা, রদ করা, অতিরঞ্জিত করা, আড়াল করা, সহজবোধ্য করার নামে জটিলতা ও একই সময়ে চলমান ভিন্নতা-দ্বিমত-বিতর্ক-সংঘাতকে লুকানো, বিভিন্ন ঘটনা কেন ও কীভাবে একই সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ও কুশীলবদের সক্রিয়তায় ঘটেছে সেই জিজ্ঞাসা, এবং সর্বোপরি, প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতা, সত্তাশ্রয়ীতা, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ঐতিহ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা) ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। কেবল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্নে সরল সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে অতীতের বয়ানগুলো কেন ও কীভাবে তৈরি হয়েছে, বা হচ্ছে, কোন বয়ান কেন ও কীভাবে প্রবল হয়ে উঠছে বা দুর্বল ও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে সেই প্রশ্ন একেবারেই অনুচ্চারিত। মোটিভ বা অতীত বিষয়ক জ্ঞান উৎপাদনের কুশীলবদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার একটা তৎপরতা হিসেবে অতীতের জ্ঞান বর্তমানে পরিবেশন ও সঞ্চালনের প্রক্রিয়াকে সংকীর্ন করে তোলারও বহুবিধ বিপদ রয়েছে। এক্ষেত্রে কুশীলবদের ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিতগত বিবিধ ও পরিবর্তনশীল শর্তগুলোর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হিসেবে ধরে-নেয়া হয়। অনুমান করা হয় যে, যারা অতীত নিয়ে বয়ান নির্মাণের চর্চা করছেন, কোনো বয়ানকে সত্য বা কোনো বয়ানকে বিকৃত বা মিথ্যা হিসেব তকমা দিচ্ছেন, তারা (কুশীলব ও সক্রিয়তা বলতে এখানে আমি কেবল মানুষ ও মানবীয়কে বোঝাচ্ছি না। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, ঐতিহ্যকেও বোঝাচ্ছি) বিচ্ছিন্নভাবে, স্বয়ংশাসিত হয়ে, সার্বভৌম সত্তা হিসেকে কাজ করার সামর্থ্য ও ক্ষমতা রাখেন।
পরিচয়বাদী শর্ত, প্রভাব, সক্রিয়তা এবং ঐতিহ্যবোধ নিয়েই আমি যদি আলাপ করি, তাহলেও বোঝা যাবে যে, পরিচয়বাদ আর অতীত বিষয়ক জ্ঞান ও জ্ঞান উৎপাদনের বিচিত্র প্রক্রিয়কা ও কারণ একে অপরকে গঠন করে, প্রভাবিত করে, এবং শর্তাধীন হবে। জাতীয়তাবাদ যেমন ইতিহাসের বা প্রত্নতত্ত্বের চর্চা ও বয়ানকে আর চৈতণ্যকে ফ্যাসিস্ট, একমুখী, সমসত্ত্ব, একমাত্র, বিকল্পহীন, কর্তৃত্ববাদী হিসেবে জাহির করতে ভূমিকা রাখে ঠিক তেমনই ওই চর্চা ও বয়ান এবং বিশেষভাবে গঠনরত চৈতণ্যও বিশেষ, একমুখী ও চিরন্তন একটি বা একাধিক পরিচয়কে বা আত্মসত্তার রূপকে ( এবং জাতির ধারণা, বৈশিষ্ট, মানদণ্ড, ও অভিব্যক্তিকে) তৈরি করতে, সঞ্চলিত হতে, প্রবল হয়ে উঠতে, একমাত্র বৈধ পরিচয় হয়ে উঠতে ভূমিকা রাখতে থাকে। ১৯৬০-৭০ এর দশকে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অধিকারবাদী আন্দোলনে পরিচয়ের রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের স্থানিক ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে। এই সক্রিয়তার মাধ্যমে উপনিবেশ পরবর্তী স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন জাতিগত, অঞ্চলগত, ধর্মীয় পরিচয়গত, নরবর্ণ/রেইস ভিত্তিক, জাতিবর্ণ ভিত্তিক, লিঙ্গীয়, ভাষিকসহ বহুবিধ ও একে অন্যের সঙ্গে লেপ্টে থাকা পরিচয় কেন্দ্রীক আধিপত্যবাদ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে নানামুখী চিন্তা- বোঝাপড়া-আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে, বৈপ্লবিক আকাঙখার অবিসংবাদিত অভিব্যক্তিতে পরিনত হয়। কিন্তু সময়ের কালক্রমে এই অবিসংবাদিত দশা প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য হয় যখন এই পরিচয়ের রাজনীতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিভিন্ন বাস্তব লক্ষণা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। উপনিবেশ বিরোধী, বর্ণবাদবিরোধী, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী চেতনাই নিজেকে টিকিয়ে রাখা ও জায়েজ করার জন্য আবার কর্তৃত্ববাদী ও আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে। উপনিবেশ, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তনের আতঙ্ক তৈরি করে, মুক্তির যুদ্ধ, বিপ্লবের সক্রিয়তার গৌরব, বীরত্ব, মহত্ত্বর বয়ানের পৌনপুনিক ব্যবহারের মাধ্যমে। এসময়েই দেখা গেল যে, দুনিয়ায় নানা জায়গায় প্রবল ও প্রান্তিক পরিচয়ের পরস্পর সংঘাতে আগেকার ফয়সালা চূড়ান্ত বা শেষ হিসেবে দাবি করা হতে থাকলেও, সেই ফয়সালার কল্পনা ও বাসনা ভ্রান্তিবিলাস ও ক্ষমতাতাড়িত হিসেবে অচিরেই ব্যক্ত হতে থাকে। দেখা গেল যেভাবে দাবি করা হয়েছিল সেভাবে আসালে ইতিহাসের পরিসমান্তি ঘটে নাই। যে পরিচয়কে মুক্ত করার জন্য লড়াই করা হয়েছিল, সেই পরিচয়ই মুক্তির একটি পর্যায়ে অপরাপর পরিচয়গুলোকে অবৈধ ও ম্লান করে তোলার তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।
গত এক দশকে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচয়বাদী সংঘাতের প্রকট উত্থান ঘটেছে। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরের অন্তরঙ্গ পরিচয়ের গোষ্ঠীগুলোও প্রকৃত অর্থে পরস্পরের সঙ্গে সহিংস ও অহিংস পরিচয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। আরো দেখা যাচ্ছে, প্রবল ও অধিপতিশীল পরিচয়বাদীরাও পরিচয়বাদী ও উত্তর-উপনেবিশক বিভিন্ন চিন্তা-তত্ত্ব-তৎপরতা দিয়ে নিজেদের বয়ানের ন্যায্যতা প্রতিপাদনের প্রকল্প নিয়ে মাঠে নেমেছে। উত্তর-উপনিবেশবাদী এবং বিউপনিবেশিকীকরণের যেসব চিন্তা একটা সময় নতুন স্বপ্ন-চেতনা-সম্ভাবনার রাস্তা তৈরি করেছিল সেসব চিন্তাই স্বৈরাচারীরা ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কর্পোরেটগণ আত্মসাৎ করে নিচ্ছে। যে কারণেই পরিচয়ের রাজনীতি একটা সময়ে যেভাবে ইতিবাচক বা সদর্থক হিসেবে পরিগণিত হতো জনপরিসরে ও রাষ্ট্রনৈতিক বিভিন্ন আলাপে বা বিধিবিধানে, এখনকার দুনিয়ায়ে ইতিবাচকতার সেই একক, মঙ্গলময় ও মুক্তিদায়ী রূপটা ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। পরিচয়ের সংঘাত ও সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক বিবাদ নতুনতর বিদ্বেষ-বিচ্ছিন্নতা-ঈর্ষা-প্রতিযোগিতা-বাসনার এক জটিল বাস্তবতা তৈরি করছে।
আমাদের দেশে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে প্রভাবশালী একটি চিন্তাধারা যেমন উত্তর-উপনিবেশবাদী ও উত্তর-আধুনিকতাবাদী চিন্তার প্রভাবে, স্থানীক পরিপ্রেক্ষিত আমল করার দাবি করে, ক্রিটিকাল চিন্তাচর্চার তৎপরতায় চিন্তা ও চর্চায় (বা পরিচয়বাদী নানা বয়ানে) বাইনারি বা যুগ্মবৈপরীত্যর ভিত্তিতে গড়ে ওঠার প্রতিষ্ঠিত বয়ানগুলোর সমালোচনা করেন। উপনিবেশিক আধুনিকতা এবং পশ্চিমকেন্দ্রীক জ্ঞানকাণ্ডের বুনিয়াদী বিভিন্ন বাইনারিগুলো ( যেমন : প্রগতিশীল/প্রতিক্রিয়াশীল, সেক্যুলার/নন-সেক্যুলার, যুক্তি/ধর্ম, সভ্য/অসভ্য, প্রগতিশীল/মৌলবাদী ইত্যাদি) ভেঙ্গে বাইনারির বাইরে সীমানাভাঙ্গা চিন্তা করার আহ্বান রাখেন। এই আহ্বান অত্যন্ত জরুরী এবং বাইনারির গণ্ডিগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার জরুরত অস্বীকার করার উপায়ও নাই। তবে, সমস্যা তখনই হয় যখন চিন্তার দুনিয়ার বা আকাঙ্খিত এই বাইনারি ভাঙ্গা বয়ান বাস্তব-যাপিত-নৈমিত্তিক জীবনে সতত উপস্থিত হিসেবে ধরে-নেয়া হয়। অতীতের জ্ঞান ও বয়ানগুলোকে বদলে দেবার বাসনা আমাদের অনেকেরই তৎপরতার অবিচ্ছেদ্য দশা। কিন্তু সেই দশা নৈমিত্তিক যাপিত জীবন ও জগতে, প্রবল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত ও সমঝোতার প্রক্রিয়া ও শর্তগুলোতে এখনও অত্যন্ত দুর্বল, অস্থিতিশীল এবং নড়বড়ে। আমাদের নিত্যকার যাপন, ভাষা ও সংবেদনে এখনো অব্দি বহুবিধ বাইনারি বা যুগ্মবৈপরীত্যকেন্দ্রীকা প্রবলভাবেই জীবন্ত-সক্রিয়-বেগবান। যাপিত নৈমিত্তিক বাস্তবতা যেমন সত্যি, তেমনই বাইনারি ভাঙ্গার তাগিদ-আকাঙ্খা-সক্রিয়তাও সত্যি। ইতিহাসের বয়ান নির্মাণে তাই নৈমিত্তিক এই বাস্তবতা ও জীবন্ত বিরোধাভাস ও বৈপরীত্যগুলোকে খারিজ করে দিলে ফ্যাসিস্ট অতীত চেতনাকে মোকবিলা করা, স্থানচ্যূত করা, আর নড়বড়ে করে দেয়া সম্ভব না। এক্ষেত্রে, প্রবল বাইনারির উপস্থিতিসমেত কোনো অভিব্যক্তি-ভাষাব্যবস্থা-তৎপরতা-চিন্তাভাবনাকেও বাইনারি-অতিক্রমী বলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ও চেতনার অস্তিত্ব ও অভ্যাস, অভিব্যক্তি ও কাঠামোকেও বদলে যাওয়া, নন-বাইনারির প্রকাশ হিসেবে মনে হতে পারে। প্রবল পরিচয়বাদী অতীত বয়ানগুলোকে বা নিপীড়ক ও কর্তৃত্ববাদী অতীত সম্পর্কিত বয়ান গঠিত হওয়ার একই পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে বিকশিত আপাত পাল্টা বা কাউন্টার বয়ানগুলোর অন্তর্নিহিত ও গুঢ় বাইনারিগুলো শনাক্ত করায় আমাদের ভুল হতে পারে। বর্তমানের ফ্যাসিস্ট-উত্তর দশা আবার ভিন্ন পরিসরে, যাপিত জীবনে আর চৈতণ্যের দৈনন্দিন অভিব্যক্তি ও নীতিতে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও উপাদানগুলোকেই বহালতবিয়তে অস্তিত্বশীল করে রাখতে পারে। ইতিহাসের উৎপাদনে, পর্যালোচনায় ও পুনর্পাঠে তাই বাইনারি বিকাশী ও বাইনারি বিনাশী বয়ান ও নৈমিত্তিকার মধ্যকার জটিল মিথষ্ক্রিয়াকে আমাদের মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। নতুবা সভা, সেমিনার, পাঠচক্র, লিখিত নানা ভাষ্যে বা কোনো বিদ্যায়তনিক পরিসরে যখন আমরা বাইনারির অনুপস্থিতি ঠাহর করতে থাকবো, বাইনারি ভেঙ্গে দেয়ার সাফল্য উচ্চারণ করতে থাকবো, তখন নৈমিত্তিক জীবনে ভিন্নতাকে খারিজকারী, আর বৈচিত্র্যকে নাকচকারী বাইনারিগুলো অন্যরূপে ও উদ্ভাসে প্রবল ও আধিপত্যশীল হয়ে উঠবে। আমরা বাইনারিগুলো নস্যাৎ ও অকার্যকর করে দেয়ার বিভ্রমের মধ্যেই যাপন করতে থাকবো। ইতিহাস ও ফ্যাসিবাদী চৈতন্যের অপর এক প্রকাশ ঘটবে আরো নৃশংসভাবে, আরো সহিংসভাবে, আরো বিপজ্জনকভাবে।
৩.
জাতীয়তাবাদ যেভাবে একসময় শাসন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির চিন্তা হিসেবে বিবেচিত হতো, পরবর্তীতে সেই বিবেচনা অবিসংবাদিত ছিল না। জাতীয়তাবাদের বিভিন্নধরনের কর্তৃত্ববাদী ও অধিপতিশীলতা আগে দৃশ্যমান ও আলোচিত হলেও, ভালো জাতীয়তাবাদ ও মন্দ জাতীয়তাবাদের মধ্যে অনেকে ফারাক করতেন। তবে এখন আর নিখুঁত ও বিশুদ্ধ ভালো জাতীয়তাবাদ যে সোনার পাথরবাটি সেবিষয়ে বহু চিন্তকই একমত। একটি জনগোষ্ঠীর জন্য যা ভালো, একই স্থানিক পরিসরে বা ভূখণ্ডে বসবাসকারী আরেকটি জনগোষ্ঠীর জন্য তাই মন্দ হতে পারে। আমাকে যে জিজ্ঞাসাটা ভীষন ভোগায় সেটা হলো: জাতীয়তাবাদী হয়ে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায় কী? কোনো রাষ্ট্রের বা একটি ভূখণ্ডে বসবাসরত বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষজনকে একটা কালে অতীতে কোনো মুহূর্তে কোনো প্রবল ও অধিপতিশীল রাষ্ট্র বা সত্তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতীয়তাবাদ ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেও সেই ঐক্য চিরন্তন কী? কোনো পরিচয়বাদ বা পরিচয় কি সার্বক্ষণিক প্রবল ও নিপীড়ক? আর কোনো পরিচয় কি সার্বক্ষণিক প্রান্তিক ও নিপীড়িত?
ইতিহাসের ধারণা ও পদ্ধতিগত বিবেচনা কিন্তু এই চিরন্তনতা বা সার্বক্ষণিকতাকে ভ্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করে। ইতিহাস পাঠ ও বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ছয়টি সি (C) – কে বিবেচনা করাকে জরুরি বিবেচনা করা হয়। এক. সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন/চেইঞ্জ ওভার টাইম; দুই. পরিপ্রেক্ষিত/কনটেক্সট; তিন. কারণবাচকতা বা কার্যকারণসম্বন্ধ [ কেন বা কোন কোন কারণে ইতিহাসে কোন কোন পরিবর্তন ঘটছে বা ঘটছে না? কারণ কি আকষ্মিক, নাকি পরিকল্পিত? কারণ কি এক নাকি বহু? বহু কারণের প্রভাব ইতিহাসের ঘটনা ঘটায় কি একই মাত্রায় নির্ধারক হয়ে ওঠে? পরিনতি বা ফলাফলের ভিত্তিতে কারণকে মূল্যায়ন করা কি যৌক্তিক? উদ্দীষ্ট কারণ বা কজ কি আকাঙ্খিত ফল নিয়ে এসেছে নাকি অন্য কোনো ফলাফল (যা আবার পরবর্তী ঘটনা/পরিনতি/ফলাফলের কারণ হয়ে ওঠে) তৈরি করেছে? ব্যক্তির বা সমষ্টির সক্রিয়তা নাকি বিভিন্ন শর্ত নাতি উভয়ই কারণ গঠনে ভূমিকা রেখেছিল? – ইত্যাদি অসংখ্য প্রসঙ্গ কজালিটি ও কজেশনের দর্শন চিন্তায় আলোচিত হয়েছে। কজালিটি সেক্ষেত্রে কেবল ইতিহাসের একটি বুনিয়াদি জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রসঙ্গ না। বৃহদার্থে চিন্তার প্রণালি ও জ্ঞানে প্রকৃতি সম্পর্কিত, ধর্মতাত্ত্বিক প্রসঙ্গও]। চার. অনিশ্চিত ব্যত্যয় বা পূর্বনির্ধারণ-অযোগ্যতা/কনটিনজেন্সি (অর্থাৎ কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটার কারণ হিসেবে আগে থেকেই কিছু প্রভাবক বা শর্ত বিবেচনা করার প্রসঙ্গ। এসব প্রভাবক বা শর্ত কোনোটি ওই ঘটনা বা ফলাফলকে প্রভাবিত করতেও পারে, নাও পারে। প্রভাবিত করলেও নানা মাত্রায় করে। দেশ ও কালভেদে। আবার কোনো ঘটনা বা ঘটনাবলির সংঘঠনে বা কোনো ফলাফলের পিছনের প্রভাবকগুলো আবার তারও আগের বিভিন্ন প্রভাবক বা শর্ত বা দশার প্রভাবের ফলাফল হিসেবে কাজ করতে পারে। পরমকারণবাদী/সরলরৈখিক ভাবে ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনা, প্রভাবক ও শর্তকে বোঝাপড়া করার প্রবল প্রবণতার পরিবর্তে কনটিনজেনসিকে আমলে নেয়া বেশ কঠিন কাজ। পাঁচ. জটিলতা/কমপ্লেক্সিটি। ইতিহাসের বিভিন্ন উৎস, উপাদান চিহ্নিত করা, সেগুলোর পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করা, বর্তমানে বসে অতীত ব্যাখ্যা করার জটিল প্রণালি নিরিখ করে করে লিখন ও কথন, ক্রিয়া হিসেবে ইতিহাসের নিরিখে চিন্তা করার জটিলতা হিসেবে নেয়া। ছয়. ধারাবাহিকতা/কনটিনিউটি [ইতিহাসের ঘটনা, শর্ত আর বিভিন্ন দশার বদল বিবেচনার পাশাপাশি ধারবাহিকতা বিবেচনা করা]।
উপর্যুক্ত ছয়টি সি- এর বিবেচনায় আমাদের অঞ্চল/ভূখণ্ড/রাষ্ট্র/সমাজ/সংস্কৃতি/রাজনীতির যে ইতিহাস আমরা লিখতে, বলতে ও পড়তে অভ্যস্ত সেই ইতিহাসগুলো কেমন? আমার বিবেচনায় এই ছয়টি সি কে বিবেচনায় নিয়ে যদি ইতিহাস বোঝাপড়ার দিকে আমরা মনোযোগী হই তাহলে সেই ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে ফ্যাসিবাদ-উত্তর ইতিহাস। ফ্যাসিবাদ-উত্তর বা পোস্ট-ফ্যাসিস্ট শব্দটিই একদিকে কালনির্দেশক (ফ্যাসিবাদের সময়ের পরের), একই সঙ্গে সেই শব্দটি বিশেষ একধরনের কর্তৃত্ববাদী ও অধিপতিশীল ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার স্মারকও)।
কোনো ধরনের পরিচয়বাদী এবং জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বা অন্যভাবে বললে, কোনো পরিচয়কে (জাতিগত, সভ্যতাগত, অঞ্চলগত, রাষ্ট্রগত ইত্যাদি) কেন্দ্র করে বা কোনো পরিচয়ের প্রকট বা প্রচ্ছন্ন প্রভাবে উৎপাদিত ইতিহাস (লিখিত বা কথ্য বয়ান হিসেবে) ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠবেই।
৪.
যদি আমরা বহুল উচ্চারিত অন্তর্ভুক্তির ধারণা বা বয়ানকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বা ইতিহাস চিন্তার উপর্যুক্ত বুনিয়াদি শর্তগুলোর সাপেক্ষে পর্যালোচনা করি তাহলে কয়েকটি নোকতা এখানে উল্লেখ করাই যায়। আমাদের ইতিহাসের বয়ানে সমন্বয়বাদ/সিনক্রেটিজম একটি জনপ্রিয় ধারণা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মত, ধর্মমত, ধর্মাচার, চর্চার সংমিশ্রণ, সংশ্লেষ, সম্মিলনকে সিনক্রেটিক বা সমন্বয়বাদী হিসেবে পরিবেশন করতে ভালোবাসেন সেক্যুলার বা নন-সেক্যুলার চিন্তার চিন্তকগণ। জনপরিসরেও এই ধারণাটি বহুল আলাপিত ও জনপ্রিয় উচ্চারণের অনুষঙ্গও বটে।
সমন্বয় এক ধরনের ঐক্যের দশা যেখানে কমপক্ষে দুই বা ততোধিক সাবজেক্ট বা বিষয়বস্তু থাকবে। সেটা দৈনন্দিন ও নৈমিত্তিক খাবারাদাওয়ার খাওয়ার একাধিক ধরন হতে পারে, দুই বা ততোধিক ধর্মাচারের সংশ্লেষ বা সম্মিলন হতে পারে, দুই বা ততোধিত আচার ও রীতি ও ঐতিহ্যের সম্মিলনও হতে পারে। সমস্যা হলো, সমন্বিত হওয়া, বা সমন্বিত হতে চাওয়া একটি বিষয়বস্তু বা আচার বা চিন্তা বা চর্চার সঙ্গে অন্যটি বা অন্য অনেকগুলো একই পরিপ্রেক্ষিত ও ক্ষমতাগত দশায় অবস্থান করে না। একটি আচার বা চিন্তার সঙ্গে অন্য আরেকটির বা অন্যগুলোর সমন্বয় প্রক্রিয়া হিসেবে সবসময়েই পারস্পরিক সংলাপ-আদানপ্রদান-টানাপড়েনের মাধ্যমে সংঘঠিত হয়। সমন্বিত হতে চাওয়া না না-চাওয়াও এখানে ক্ষমতাধর বা প্রবল বিষয়বস্তুটির কর্তৃত্বাধীন থাকে। বিবাদমান বা সংঘাতময় বা সংলাপমুখর বিভিন্ন প্রপঞ্চগুলোর মধ্যে যোগাযোগ-যুক্ততা-সমন্বয় যে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিলে পরিচালিত হয় সেই প্রক্রিয়ায় একটি পক্ষ সবসময়ই অন্য পক্ষ, একটি প্রপঞ্চের বর্গ অপর প্রপঞ্চগুলোর চেয়ে প্রবল কিংবা দুর্বল হবে। পরিনতিতে, সমন্বয় বা সম্মিলন অর্জনের পরে নতুন যে বর্গ বা আচার বা পরিচয় তৈরি হয় সেখানে প্রবলটিও প্রকট থাকে। দুটো বা ততোধিক ঐতিহ্য বা চিন্তাধারা বা পরিচয় বা মতামত যখন ঐক্যমত্যে পৌঁছায় তখন কাউকে বেশি ছাড় দিতে হয়, কাউকে কম। যখনই এমন অসমতা একটি প্রক্রিয়া ও তার ফলাফলে ঘটে বা ঘটতে থাকে তখন সেই প্রক্রিয়াটি ফ্যাসিবাদী একটি প্রক্রিয়ায় পর্যবশিত হয়। ফলাফলটিও ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার উৎপাদ হয়ে ওঠে।
অন্তভুক্তিতা/ইনক্লুসিবনেসের শর্ত ও প্রক্রিয়াকে উপরিল্লিখিত সমন্বয়ের শর্ত ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন বা বহু মত-পথ-চিন্তা-পরিচয়কে ইনক্লুড বা অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রকল্প হিসেবে, বাসনা হিসেবে, অভীষ্ঠ দশা হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। এখানে সাম্যাবস্থা বা বিভিন্ন মত-পথ-পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতগত, পরিস্পরের সঙ্গে নেগোশিয়েট করার, যুক্ত হওয়ার, শুদ্ধ বা খাটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার (বা ভেজাল বা বিকৃত হিসেবে খারিজ হওয়ার) তৎপরতায় বিভিন্ন পক্ষ বা প্রপঞ্চের মধ্যে ক্ষমতাগত সম্পর্ক কেমন? অন্তর্ভুক্তি ও সংহতিকে যদি পরস্পরের পরিপুরক দুটো দশা হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে চাই তাহলে অসম ক্ষমতা সম্পর্কের পাটাতনে বিভিন্ন কুশীলব/কারকের তৎপরতা অসম ও বিষম হয়ে উঠবে। সেই সংহতির শর্ত ও প্রক্রিয়া নির্ধারিত হবে প্রবল ও অধিপতিশীল পক্ষ, কুশীলব বা দশার মাধ্যমে। এই পক্ষ বা দশা বা শর্ত বাছাই করবে, নির্বাচন করবে, কোনটা অনুর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য, কোনটা অন্তভুক্ত হওয়ার যোগ্য না সেই নির্ধারণের অধিকার কেবল এই পক্ষের বা চিন্তাধারার বা কুশীলবদেরই থাকবে।
অন্তর্ভুক্তির আলাপ সুতরাং ক্ষমতা সম্পর্কের আলাপ, পরিপ্রেক্ষিত ও কনটিনজেনসির আলাপ, বহুবিধ দশার আলাপ, পরিচয়বাদকে নাকচ করতে করতে তৎপর থাকা ছাড়া সম্ভব কীনা সে বিষয়ে আমার সংশয় রয়েছে। প্রবল ও প্রান্তিক -সকল পরিচয়বাদী (ও জাতীয়তাবাদী) বয়ান ও ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে করতে, দুর্বল করতে করতে, নাকচ করতে করতেই কেবল অন্তর্ভুক্তিতামুখী তৎপরতা জারি রাখা সম্ভব। তবে সেই তৎপরতার ফলাফল চিরন্তন ও স্থির না। অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া ধারাবাহিক। কোনো চূড়ান্ত দশা নাই। ফ্যাসিবাদী ইতিহাস ও বোঝাপড়ার সঙ্গে যুযুধান থাকাটাই ফ্যাসিবাদ-উত্তর যাপনের ও নৈমিত্তিক তৎপরতার দশা এবং শর্ত।
….
০২ অক্টোবর, ২০২৪ অরুণাপল্লী, সাভার।