একটি রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে আমি। দীর্ঘদিন ধরে আমার বাবা বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। গত পনেরো বছরে তাকে দশ/এগার বার আটক করা হয়, জেলে ছিলেন একবার প্রায় সাত মাস। এই সময়গুলোতে বাবাকে আটকের প্রতিটি ঘটনা আমাদের পরিবারে প্রচণ্ড দাগ কেটেছে । তবুও, আমরা এগিয়ে চলেছি, কারণ আমাদের যন্ত্রণা কিছুই নয়, আরও লক্ষাধিক পরিবারের অসহায়ত্বের কাছে। আরও অনেক পরিবার অকল্পনীয় মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। নিপীড়ন, ভয় এবং ট্র্যাজেডির মাঝে হাজারো পরিবারকে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে। হাসিনার নির্দেশে আমরা হত্যা, গুম ও নির্বিচারে আটক হতে দেখেছি। ভয় এবং অসহায়তার প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের নজরে এসেছে। আমাদের অভিজ্ঞতাগুলি কেবল সংখ্যা অনেকের কাছে, কিন্তু আমাদের জন্য, এটি এমন এক বাস্তবতা যা আমাদের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে।
তারপর জুলাই এলো— আমি আজও গোলাগুলির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই, হেলিকপ্টার দেখতে পাই । মুগ্ধের কণ্ঠস্বর, আঃ কি মিষ্টি। ইয়েমিনের স্মৃতি— শরীর তখনও উষ্ণ, আমি দেখেছি, যখন তার মাথাটা ওঠার চেষ্টা করছে, তাকে আবার তুলে নিয়ে একপাশে ফেলে দেওয়া হলো, জীবন কি আসলেই এতো সস্তা ? ছোট্ট মেয়েটি, ছাদে খেলছিল, গুলিতে তার ছোট্ট জীবনটা কোথায় হারিয়ে গেলো।
জুলাই-অগাস্ট ২০২৪, গণহত্যা। ১৫০০ প্লাস শহীদ। ১৫০০ নামের জায়গা হবে কি এই ছোট কলামে? আবু সায়ীদকে যে পুলিশ অফিসারটি নিশানা করে মেরে ফেললো, বলুক সে, কী চলছিল তার মাথার মধ্যে। সায়ীদ এর বাবার সামনেই বলুক। কী নির্দেশ ছিল তাদের সে দিন। কে দিয়েছিলো সেই নির্দেশ? জুলাই এ এক পুলিশের ছেলের বুক ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিলো পুলিশেরই গুলিতে। সে তার উর্ধতন কর্মকর্তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, ‘একটা ছেলেকে মারতে কত গুলি লাগে স্যার’? কে দিয়েছিলো ছেলেটাকে মারার আদেশ?
কেন ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছিল? যেই অফিসারটি তার উর্ধতন কর্মকতার আদেশে ইলিয়াসের গাড়ি থামিয়েছিলো, সে বলুক, কে নির্দেশ দিয়েছিলো, বলুক কী হয়েছিলো সে রাতে, তারপরে কী হলো? লুনার সামনে বলুক। অফিসারটি তার সারা জীবনের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাবে কিনা তা জানি না, তবে তাকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যাবো। তবে তার উর্ধতন কর্মকর্তার কথা শুনি, সে কার নির্দেশে এই কাজ করেছিল। এই যে সত্য বলা, আর শোনা, আর আমাদের সকলের মুক্তি। আমরা আরো শক্তিশালী হবো।
প্রতিদিন ছেলেগুলোকে দেখছি, হাত নেই, পা নেই, চোখ নেই, মাথার ভেতরকার যন্ত্রনাটা আরো বেড়ে যায়। কাজ করতে পারছি না. কিন্তু এভাবে কি চলে? ভিক্টিমদের কথা শুনতে হবে.. এদের rehabilitate করতে হবে। কীভাবে?
আমরা কীভাবে এই জাতিকে হিল করব? ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত এই ট্রমা থেকে বের হয়ে আসা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমি আশা করি যে, আমরা ন্যায়বিচার পাবো, সমগ্র জাতির জন্য। এবং শুধু এটাই আমাদের এই ট্রমা থেকে বের হতে হেল্প করতে পারবে।
আমাদের দরকার জাস্টিস, ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলাশন প্রসেস, এখনই শুরু করতে হবে।
বহু বছর লাগবে। কিন্তু শুরু করতেই হবে !
ন্যায়বিচার কিন্তু শুধু শাস্তি দেওয়া নয়; এটি একটি ভিত্তি যার উপর আমাদের ট্রমা হিলিঙ শুরু হবে । বহুদিন ধরে যেই সত্যগুলো চাপা পরে ছিল তাকে প্রকাশ করবে। এই রাস্তা আমাদের একসাথে চলতে হবে; ভিকটিম এবং অপরাধী, দুপক্ষেরই ।
ন্যায়বিচার কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়; এটি ভিকটিম, তাদের পরিবার এবং সমাজের হিলিং এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ । শীর্ষ অপরাধীদের কঠোর বিচারের প্রয়োজন, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখে। এই বিচারগুলি শুধুমাত্র অন্যায়ের শাস্তিই নয় বরং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং ভবিষ্যতের অপরাধমূলক আচরণকে রোধ করতেও কাজ করে।
পনের বছর ধরে, বিগত সরকার ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েছে— শান্তি, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য কৌশলগতভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে।
আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে— নাগরিক হিসেবে, জাতি হিসেবে— আমরা কেমন হতে চাই? আমরা একটি ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রের জন্য আকাঙ্ক্ষা করি, যে রাষ্ট্র হবে প্রতিটি নাগরিকের। দীর্ঘকালের ভয়, যন্ত্রনা, অপরাধ, মোকাবিলা না করে এটি অর্জন করা যায় না। প্রতিটি ঘটনার শুরু ও শেষ, অপরাধী বলবে, ভিকটিমের সামনে দাঁড়িয়ে। জাস্টিস, ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন প্রসেস এই প্রয়োজনীয় সংলাপকে সহজতর করতে পারে। যদি আমরা বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোকে মেরামত করতে চাই তবে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, আমাদের মানসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক হিলিং দরকার। এই হিলিং তা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত দুই স্তরেই একটি চলমান যাত্রা। রিকন্সিলিয়েশন পুরো জাতির দায়িত্ব। এর জন্য অতীতের অন্যায় এবং চলমান বৈষম্যগুলি স্বীকার করতে হবে।
প্রচন্ড অস্তিরতা চারপাশে। এক ধ্বংসযজ্ঞের উপরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নতুন কিছু সুন্দর সৃষ্টি করা যাবে না যতক্ষণ না পুরো জাতি অতীতে যা ঘটেছিল তার গল্পগুলি খোলা হৃদয় ও মন দিয়ে শোনে এবং বুঝে, এবং নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞা না করে।
তো আমি কেন জাস্টিস, ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন এর কথা বলছি? বলছি, কেননা একমাত্র সত্য বলার আর শোনার সাহস একটি জাতিকে সত্যিকার অর্থেই মুক্তি দিতে পারে।
কমিশনের উদ্দেশ্য কী হতে পারে?
১. মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত:
– ২০০৯ থেকে ২০২৪ আগস্টের মধ্যে ঘটে যাওয়া সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করা, অপরাধের মাত্রা, প্রকৃতি এবং প্রেক্ষাপট চিহ্নিত করা।
২. ভিক্টিম ও তাদের পরিবারের অভিজ্ঞতাবলীর নথিভুক্তকরণ ও বিশ্লেষণ করা
৩. জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠা:
– সুপ্রিম লিডারসহ অপরাধীদের পরিচয় নিশ্চিত করে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা।
– মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলি রাষ্ট্র-অনুমোদিত ছিল কিনা বা রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সিস্টেমিক ব্যর্থতার ফল ছিল কিনা তা মূল্যায়ন করা।
৪. রিকন্সিলিয়েশন:
– সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, সংলাপ, এবং বোঝাপড়ার পথ তৈরি করে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
– সামাজিক পুনঃএকত্রীকরণ ও নিরাময়ের জন্য ব্যবস্থা প্রস্তাব করা যা সম্মিলিত অভিযোগের সমাধানের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের মর্যাদাকে সম্মান করে। অপরদিকে, ট্রমা কাউসেলিং নিশ্চিত করা।
৫. ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব:
– ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি কাঠামোগত ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনা প্রস্তাব করা, যা তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দেবে।
৬. ভবিষ্যতে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ:
– প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতিগত প্রস্তাবনা তৈরি করা যা মানবাধিকার রক্ষা করবে, দায়মুক্তি প্রতিরোধ করবে এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনকে শক্তিশালী করবে।
এই উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখে কমিশন নিম্নলিখিত কাজগুলি করতে পারে:
১. মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত:
– গণহত্যা, গুম এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে গণশুনানি ও তদন্ত পরিচালনা করা।
– সাক্ষ্য, ডকুমেন্টেশন এবং রাজনৈতিক দল, এনজিও ও সুশীল সমাজের সহযোগিতায় প্রমাণ সংগ্রহ করা।
– যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের পটভূমি ও অভিজ্ঞতার তথ্য সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক বিবরণ সংকলন।
২. হাইব্রিড বিচার প্রক্রিয়া:
– গুরুতর অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ট্রাইব্যুনালের প্রতিষ্ঠা করা এবং আইনি জবাবদিহিতার নীতি তৈরি করা।
– উচ্চ স্তরের ও নিম্ন-স্তরের অপরাধীদের জন্য আইনি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করা।
– আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ট্রাইব্যুনালের সমন্বয় ঘটিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
– ন্যায় বিচারের জন্য কমিউনিটি বেসড রেস্টোরেটিভ বিচার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা।
– আইনি সুরক্ষার মাধ্যমে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা এবং সঠিক আইন কার্যকর করা নিশ্চিত করা।
৩. অ্যামনেস্টি ও ডিসক্লোজার:
– সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন তত্ত্বাবধান করে যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করা।
– ভিক্টিম ও অপরাধীদের সম্মানজনক যোগাযোগের উৎসাহ দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি সত্য বিবরণ তৈরি করা।
– ভিক্টিমদের প্রয়োজনের মূল্যায়ন করা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা।
৪. রিপোর্ট ও সুপারিশ সংকলন:
– একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাতে বিধানগুলির ব্যাখ্যা, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের সুপারিশ এবং ভবিষ্যতে মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
জাস্টিস, ট্রুথ এন্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের অতীতের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে। খোলাখুলিভাবে, সততার সাথে । জাস্টিস, ট্রুথ এন্ড রেকোনসিলেশন কমিশন বাংলাদেশেকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক দেশ হিসেবে সামনে নিয়ে আসবে। এটা শুধু আমাদের নিজেদের প্রয়োজন নয়; বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার জন্য জরুরি। অতীতকে স্বীকার, বর্তমানকে মোকাবিলা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করার সময় এসেছে। এটা শুরু করতে হবে আজি।
এই লেখাটি লেখার ক্ষেত্রে শামারুহ মির্জাকে সহায়তা করেছেন আশরাফুল হাসান।
1 comment
Jawad Ahmed
দরকারি লেখা।