জনবিতর্ক

সলিমুল চৌধুরী

নতুন বংলাদেশের ভারত প্রকল্প

October 4, 2024   0 comments   3:57 pm

মোটাদাগে বলা যায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, বিকশিত পুঁজির রাষ্ট্র ভারত তার সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ।  তাই নতুন বাংলাদেশে সেই আগ্রাসী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।  নতুন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আমাদের ভারত প্রকল্প কীভাবে হওয়া উচিত তা ভাবার শুরুতে, বড় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের যে ডমিনেন্স ও ক্ষমতার প্রভাব আমরা দেখতে পাই, তার একটি ব্যবচ্ছেদ করা জরুরি।

Share

ধ্রুপদী সংজ্ঞার আলোকে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ

তখন ইউরোপ জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলতেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বিশ্বের অনেক চিন্তাবিদ যুদ্ধের সাধারণ প্রকৃতি বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ছিলেন । কেউ কেউ এটারে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ হিসেবে দেখতেছিলেন, অন্যরা এইটারে পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করতেছিলেন । তখনই, বলশেভিক বিপ্লবের প্রাক্কালে, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদপুরুষ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যুদ্ধের প্রকৃতির অন্তঃসার অন্বেষণে ১৯১৬ সালে ‘Imperialism: The Highest Stage of Capitalism’ নামে একটি সুবিশাল প্রবন্ধ লেখেন। লেনিনের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধকে পুঁজিবাদী বিকাশের একটি অনিবার্য ফলাফল হিসাবে ব্যাখ্যা করা, এবং দেখানো যে সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়, যেইখানে বৈশ্বিক সংঘাত এবং বৈশ্বিক শোষণ স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হইয়া  দাড়ায় ।

লেনিন তাঁর প্রবন্ধে একটা রাষ্ট্রের পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষণগুলোর মধ্যে ‘কার্টেল এবং মনোপলি’ হিসাবে শিল্প ও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে, বৃহৎ ব্যবসাগুলোর মধ্যে আর্থিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া প্রবণতাকে চিহ্নিত করছিলেন । এইটাছাড়াও, পুঁজিতে সুবিকশিত রাষ্ট্র,  পুঁজিতে অবিকশিত বা বিকাশমান রাষ্ট্রে  ‘নতুন উপনিবেশ সৃষ্টি’ করার চেষ্টা করতে থাকে । উপনেবশিত রাষ্ট্রে  ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের নিজেদের সংস্কৃতি আর পণ্যের বাজার তৈরী সচেষ্ট হয়, স্থানীয় সম্পদ লুটপাটের ব্যাপারেও উৎসাহী হয়ে উঠে । এইসব লক্ষ অর্জনের জন্য উপনেবশিত রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন  নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠে ঔপনিবেশিক শক্তি । এই সমস্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হইলেই, বড় পুঁজির শক্তিগুলি ছোট বা অগ্রসরমান পুঁজির রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক সংঘাতের পথে যাওয়ার কথা চিন্তা করে । কারন তখন কার্টেলের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য হইয়া পড়ে।

বর্তমানে বাংলাদেশে একটা মত খুব জনপ্রিয় যে, আমাদের প্রতিবেশী, দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র ভারত, বাংলাদেশের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন দেখাইতেছে ।  আমি ভারত রাষ্ট্রের কিছু বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করার মাধ্যমে দেখাইতে চাই যে, লেনিনের প্রস্তাবনার সাপেক্ষে ভারতের পুঁজিবাদ তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রায় পৈছায়া গেছে, এবং তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা পুরোমাত্রায় উপস্থিত । আমি এখানে ভারতের দুইটা প্রবণতার বিষয়ে আলোচনা করতে চাই ।

প্রথমত, দেখা যাক মনোপলির মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিষযটা । ভারতের অর্থনৈতিক সম্পদ ও ক্ষমতার একটা সিগনিফিকেন্ট অংশ কয়েকটি বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর কব্জায় আছে । রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, টাটা গ্রুপ, আদানি গ্রুপের মতো কোম্পানিগুলা টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি, খুচরা, এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে রাখছে । এই কেন্দ্রীকরণের ফলে একচেটিয়া কার্যকলাপের আশঙ্কা দেখা দিতেছে, বিশেষ করে এমন বাজারে, যেখানে প্রতিযোগিতা সীমিত, বা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রবেশের বাধা খুব বেশি।  এবার আসা যাক নতুন উপনিবেশ সৃষ্টি ব্যাপারটায় । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের উপনিবেশবাদী মনোভাব প্রচণ্ড উগ্রভাবে প্রকাশিত হইছে  । এই যে আমাদের দেশে বছরের পর বছর ধরে রাতের ভোট   ও শেখ হাসিনার অবৈধ কুশাসন জারি ছিলো, সেটা দিল্লীর স্পষ্ট মদদ আর সাপোর্টের মাধ্যমেই হয়ে আসতেছিল । এই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হইল বাংলাদেশের গনতন্ত্রের বিলোপ, এবং হাসিনার পুতুল সরকারের ঘাড়ে পারা দিয়া  ভারতের সংস্কৃতি ও পণ্যের প্রায়-একচেটিয়া  বাজার সৃষ্টির বাস্তবতা ।  

সুতরাং, লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত ধ্রুপদী প্রস্তাবনার আলোকে, ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির মনোপলির মাধ্যমে গইড়া ওঠা কেন্দ্রীভূত পুঁজি,  আর সেই পুঁজির স্ফীতির তাড়নায়, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের উপনিবেশমূলক আচরণ তার সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতার লক্ষণ । এইটা ভারত বিষয়ে আমাদের একটা পরিস্কার থিসিস ।     

ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব

২০২৪ সালের এই অভূতপূর্ব ছাত্র নেতৃত্বাধীন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটছে। এইটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই না, বরং বিশ্ব ইতিহাসেও একটা বিরল আর অনন্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হইতে থাকবে । ভবিষ্যতে এই অভ্যুত্থানরে  উপনিবেশবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গণমানুষের বিজয়ের প্রতীক হিসাবে দেখা হবে, যেটা বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হইয়া উঠবে  ।

হাসিনার এই পুতুল সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে বলে আশা করতেছি । বাংলাদেশে একটা ইন্সাফভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে, এইটাই আশাবাদ । কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পুঁজিবাদের বিকাশের উচ্চ পর্যায়ে থাকা ভারত কি বাংলাদেশের প্রতি তার সাম্রাজ্যবাদী আচরণ থেকে পুরাপুরি বিরত থাকবে?

আমার মনে হয় ভারত হয়তো সাময়িকভাবে তার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে রাশ টাইনা ধরতে পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিরত থাকার সম্ভাবনা কম ।   সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বাদই দেন । ভারতের এক বিশেষ ভূগোলগত দুর্বলতা তার অখণ্ড অস্তিত্বের জন্য সিরিয়াস একটা হুমকি ।  নিদেনপক্ষে, ভারত তার অখণ্ড অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের উপর শক্ত প্রভাব জারী রাখতে চাবে । চলেন, সেই আলাপে যাই ।   

ভারতের মানচিত্রে দেখা যায় যে উত্তর ভারতের সাতটা প্রদেশ অরুণাচল, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরামমেঘালয়, যাদের সম্মিলিতভাবে Seven Sisters বলা হয়, তাদের সাথে মূল ভূখণ্ডের সংযোগের একমাত্র পথ হইলো শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক (ছবিতে চিহ্নিতনামে পরিচিত একটা ছোট ভূখণ্ড। শিলিগুড়ি করিডোরের দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৮ কিলোমিটার, আর  প্রস্থ ২২ কিলোমিটার। 

বিশেষত ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সাংস্কৃতিক ও মনোগত দিক থেকে একদমই আলদা Seven Sisters অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটা  আকাংখা বহুকাল ধরে লালন করতেছে । এই আকাংখা  বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়া আসতেছে ।  ভারত সরকার সেনা মোতায়নের মাধ্যমে সে অঞ্চলের গণদাবী জবরদস্তীভাবে  দমন করে রাখতেছে যুগের পর যুগ ।  যদি কোনো কারণে এই শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে সেইটা উত্তর ভারতের স্বাধীনতার গনদাবী আরো তীব্রতর করে তুলতে পারে ।  এইটা অখণ্ড ভারতের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হইয়া দাঁড়াবে।  ফলাফল হইতে পারে উত্তর ভারতের স্বাধীনতা, এবং খণ্ডিত ভারত । 

এই করিডোরের কৌশলগত গুরুত্ব ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতারে আরও প্রকট করে তোলে, কারণ এই করিডোর চীনের সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। যদি চিনের তৎপরতার কারনে    শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে উত্তর ভারতের থেকে মূল ভারতের সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে । তখন ভারতের একমাত্র বিকল্প হবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে উত্তর ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা।

এই কারণেই ভারতের জন্য বাংলাদেশের উপর আধিপত্য বজায় রাখা, যা গত ১৬ বছর ধরে পুতুল সরকারের প্রেক্ষাপটে সহজেই জারি ছিল, সেটা ভবিষ্যতেও নিজের অখণ্ড অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়ে যাবে ।

নতুন বংলাদেশের ভারত প্রকল্প       

মোটাদাগে বলা যায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, বিকশিত পুঁজির রাষ্ট্র ভারত তার সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ।  তাই নতুন বাংলাদেশে সেই আগ্রাসী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।  নতুন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আমাদের ভারত প্রকল্প কীভাবে হওয়া উচিত তা ভাবার শুরুতে, বড় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের যে ডমিনেন্স ও ক্ষমতার প্রভাব আমরা দেখতে পাই, তার একটি ব্যবচ্ছেদ করা জরুরি।

যদিও কাগজে-কলমে  ভারত একটি বৃহৎ রাষ্ট্র, প্রকৃতপক্ষে এটা বড়ত্বের একটা ভুয়া বয়ান । ভারত আসলে ভিন্নভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ভাষিক জনগোষ্ঠীর অধীনস্ত অনেকগুলো ছোট  রাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক সমাহার ।  এই বিষয়টা আহমদ ছফা তার রাজনৈতিক জটিলতা প্রবন্ধে বিষদ আলোচনা কইরা গেছেন । কাশ্মীর এবং খালিস্থানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছফার এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে । কাশ্মীরের আন্দোলন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়  বৈষম্যের প্রতিফলন । খালিস্থানের আন্দোলন একইরকমের অসন্তোষেরই প্রতিফলন । দিল্লীর দমনমূলক আচরণ এই দুই অঞ্চলের স্থানীয় জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর হামলা হিসেবে দেখা হয়, যা বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে বহুবছর ধরে উৎসাহিত করে আসতেছে । অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতও, ভারত স্বাধীন হবার পরপর দ্রাবিড় নাড়ু ধারণার অধীনে, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক এবং কেরালা নিয়ে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে রাখছিল । এই ধারনাটা দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনায় এখনো প্রাসঙ্গিক, এবং ঘটনা পরম্পরায় আবারো স্থানীয় জনগণের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিলাসের উৎস হয়ে উঠতে পারে ।

অবস্থা বিবেচনায় বলা যায়, ভারতের অনেক পরিধিভুক্ত প্রদেশ, দিল্লি ও মহারাষ্ট্রের কর্তৃত্বের যে কার্টেল তার অধীনে চাপা পড়ে এক দমনমূলক ও অত্যাচারী ব্যবস্থার আওতায় আছে । কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব না দিয়ে একক নীতির চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগণের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনকে লঙ্ঘন করে। এইরকম নীতির ফলে রাজ্যগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক সংঘাত এবং সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইতেছে ।  প্রকৃতপক্ষে, ভারতের বিশাল রাষ্ট্রের কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল, *বন্দে মাতরম* এর মত কৃত্রিম ও একধর্মীয় চেতনা দিয়া একটা অদ্ভুত জাতীয়তাবাদের বাহন তৈরি করা হইছে ।

নতুন বাংলাদেশের ভারত প্রকল্প তাই ভারতের অভ্যন্তরীণ জটিলতা মাথায় রেখেই ডিভাইস করতে হবে। আমার মতে, শত্রু ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক শত্রুতামূলক হওয়া উচিত হবে না। কারণ, ভারতের সাথে সম্পর্কের মধ্যে শত্রুতার মনোভাব আমাদের দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করে আমাদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং সামাজিক জটিলতা বিবেচনায় রেখে, আমাদের উচিত সঠিক কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা । আমার চিন্তায় কিছু পন্থা আছে । এগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমেই লেখাটা শেষ করতেছি ।
    
১/ মেকি ঐক্যের সুবিধা গ্রহণ: ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে পৃথক ভাষা, ধর্ম, ও সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও একদেশেই বসবাস করে, যা ভারতকে একটা মেকি ঐক্যের ভান করতে সাহায্য করে আসতেছে । এইটা আমাদের জন্য একটি কৌশলগত সুবিধার ব্যাপার।  বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুবিধা কূটনৈতিকভাবে নিতে পারে। একটা উদাহরন দেই । যখন ভারত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতেছে, তখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এবং কাশ্মীরি জনগণের অধিকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে কূটনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করতে পারে।


2/  শত্রুর যে শত্রু, তার সাথে মৈত্রিতা বৃদ্ধি: শত্রুর শত্রু হলো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কার্যকরী বন্ধু। এই কৌশল অনুসারে, আমার ভারতের সাথে নানা বিষয়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরা প্রধান রাষ্ট্রগুলো হলো পাকিস্তান, চীন, এবং আমেরিকা। পাকিস্তান, যার ভারত রাষ্ট্রের  সাথে ঐতিহাসিকভাবে দ্বান্দিক সম্পর্ক, আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সহযোগী হতে পারে। চীন, যা ভারতকে ভূরাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে, আমাদের জন্য শক্তিশালী সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। আমেরিকা, যা আন্তর্জাতিকভাবে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম, আমাদের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য অপরিহার্য। এইসব রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুতামূলক সম্পর্ক উন্নত করা, আমাদের আঞ্চলিক সুরক্ষার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ হইতে পারে ।   

৩/ দুই বাংলার নৈকট্য:  পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং ঐতিহাসিক মিল আছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক হইতে পারে। এই সাদৃশ্যকে ভিত্তি করে একটি নীতি প্রণয়ন করা হলে, দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, শিক্ষা ও গবেষণায় যৌথ প্রকল্প, পর্যটন উন্নয়ন এবং সীমান্ত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সম্পর্ককে শক্তিশালী করা সম্ভব।

৪/ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতের সঙ্গে করিডোর:  শর্তসাপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত করিডোরের সংযোগ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, যা ভারত থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের একটি উপায় হইতে পারে। যেমন ধরেন, বাংলাদেশ যদি ভারতকে একটা নিয়ন্ত্রিত করিডোর ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তবে সেইটা ভারতের বাণিজ্যিক যানবাহন ও মালপত্রের ট্রানজিট সুবিধা অর্জনের বিনিময়ে, বাংলাদেশ বিশেষ ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি আদায় করার পরিস্থিতি তৈরী করতে পারবে । তাছাড়া, করিডর দেয়ার বিনিময়ে ভারত থেকে বার্ষিক মোটা অঙ্কের ট্যাক্স আদায় করা একটা সম্ভাব্য প্রস্তাবনা । উপরন্তু, ভারতকে করিডোরের সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্মুক্ত থাকলে, এটি চীনের সাথে এক ধরনের নেগোসিয়েশনের স্পেস তৈরি করবে। ভারতের সাথে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকার কারণে, চীন এই করিডোরের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে পারে।

5/  SAARC সদৃশ প্রতিষ্ঠান গঠন: ভারতকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একটি SAARC সদৃশ প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, এবং মালদ্বীপের যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এটা ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতাকে মোকাবিলা করার একটা ইফেক্টিভ উপায় হতে পারে ।

৬/ ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ন্ত্রন:   ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing) অতীতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের কৌশলগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়, RAW বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সহায়তা প্রদান করেছিল। এই সাহায্যকারী ভূমিকাটা একটা এস্কেপশন । পরবর্তীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার নানা সমস্যা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে RAW বিভিন্ন সময়ে গোপন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এনেকডোট আছে যে, হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের প্রশাসন, শিল্পখাত, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাখাত, এবং সামরিক বাহিনীতে কয়েক হাজার RAW এজেন্ট গোপনে সক্রিয় ছিল, যারা হাসিনার রেজিমকে টিকিইয়া রাখার জন্য শক্ত ভূমিকা রাখছিল । এই কারণে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য RAW এর কর্মকাণ্ডের প্রতি নজরদারি বৃদ্ধি, এবং নিরাপত্তা কৌশল আরও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি ।

Leave the first comment