জনবিতর্ক

বায়েজিদ বোস্তামী

যদ্দিন রাষ্ট্ররে ভাঙা সম্ভব হইতেছে না

October 4, 2024   0 comments   3:38 pm

বাংলাদেশের ঐক্য ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সবচাইতে বড়ো সুবিধা ছিলো এদেশের প্রায় একই ধরনের মানুষ। অই অর্থে ধর্ম, ভাষা কিংবা নৃতাত্ত্বিক বিচারে বিভাজিত হইবার সুযোগই ছিলো না। কিন্তু এখানকার শাসকশ্রেণী এরমধ্যেও বিভাজনরে জিয়ায় রাখছে নানারকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার দ্বারা। এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিই মেজর ফ্যাক্টর হিশাবে কাজ করছে। ফলে, মাইনরিটি একটা ইস্যু হিশাবে সবসময়ই হাজির থাকছে।

Share

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। কুড়িগ্রামের কয়েকজন মানুষ ভারতের গৌহাটিতে আটক ছিলেন।ব্রহ্মপুত্রের জেলে উনারা। উনাদের একজন এরকম বলছিলেন যে উনারা বংশপরম্পরায় ব্রহ্মপুত্ররে চেনেন, রাষ্ট্রের সীমানা চেনেন না। য্যানো উনারা ব্রহ্মপুত্রের পানির সন্তান মাছই, মানুষ নন। অই জেলে যা বলছেন তার লগে দ্বিমত নাই আমারও। মানুষের কোনও রাষ্ট্র হয় না, হইতে পারে না। সীমানা চিহ্নিত, কাঁটাতার বেষ্টিত এইসব রাষ্ট্র নামের কারাগারে আমরা বন্দি হইয়া আছি। খোদার দুনিয়ায় মাছেরা, পাখিরা স্বাধীন হইলেও মানুষ না, এইটা আফসোসেরই বটে। ব্যক্তিগতভাবে এই বন্দিত্ব আমারে পীড়িত করে। 

খেয়াল করলে দেখবেন, রাষ্ট্র ব্যক্তি নাগরিকের এজাজতে, এবং কখনো কখনো বিনা এজাজতেও, ক্ষমতা সমবায় কিংবা একটি ক্ষমতা-পর্বত আকারে হাজির হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা ক্ষমতা-চর্চালিপ্সুদের জন্য মোক্ষও বটে। এই পক্ষটি যেকোনও প্রকারে ক্ষমতা করতলগত করি নাগরিকবৃন্দের বিধাতারূপে পারফর্ম করতে থাকে। বলাবাহুল্য পুঞ্জীভূত বিপুল ক্ষমতা এদের দানবে পরিণত করে। এই দানবগণে রাষ্ট্র নামক ক্ষমতাপর্বতটিরে বিবিধ উপায়ে ব্যক্তির উপরে চাপায়া পিষ্ট করে। এই রাষ্ট্র ধারণার সাপেক্ষে আমি নিজেরে নৈরাষ্ট্রিক ভাবি। অর্থাৎ রাষ্ট্র নামে যে দানবগুলি দুনিয়ারে ভাগ করি নিয়া আছে সেইসব দানবের বিলোপকামী। যদ্দিন রাষ্ট্রগুলির বিলোপসাধন সম্ভব হইতেছে না, অন্য কোনও ব্যবস্থা দাঁড়াইতেছে না তদ্দিন আমরা কী করবো? রাষ্ট্ররে লাইনে রাখতে, জবাবদিহিতার ভিতরে রাখতে, মানবিক-প্রাণবিক হিশাবে ফাংশন করতে বাধ্য করবো।

দুঃখজনক হইলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের মানুষ এ রাষ্ট্রের একেবারে জন্মলগ্ন থাকি আইজ তক হক ও ইনসাফ ভিত্তিক একটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা পায় নাই। ফলে, স্বাধীনতা অর্জনের পরও মুক্তির জন্য তাদের লড়াই ও রক্তক্ষরণ দুইটাই অব্যহত থাকছে। সবশেষ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ভেতর আমরা আবারও মানুষের মুক্তির বাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখলাম।

আওয়ামী ফ্যাসিজম যে পাটাতনের ওপর দাঁড়ায়ে ছিলো সেটার খুঁটি হিশাবে কাজ করছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ মোটাদাগে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এবং অন্যান্য জাতিসমূহরে অপর হিশাবে চিহ্নিত করত কেবল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর— বাঙলা ভাষা এখানে উসিলা মাত্র—সুপ্রিম্যাসি প্রতিষ্ঠা করে। সেইসাথে এটাও স্পষ্ট যে এই জাতীয়তাবাদী বয়ান মূলত সাবকন্টিনেন্টে আধিপত্যবাদী ভারতের হিন্দুত্ববাদী বয়ানেরই এক্সটেনশন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ অপরায়নের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদি পারপাস সার্ভ করি গেছে। পাকিস্তান পর্বে যে জাতীয়তাবাদী স্পিরিট এ জাতিরে ঐক্যবদ্ধ করছিলো, মুক্তির আকাঙ্ক্ষারে প্রাণিত করছিলো সেটাই স্বাধীন বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হইয়া উঠছিলো। যার সবশেষ পরিণতি হইলো ফ্যাসিবাদের রূপপরিগ্রহন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এই যুদ্ধের ফলে মানুষের মুক্তি আদৌ হইছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকা অত্যন্ত সঙ্গত; সে সন্দেহ আমি রাখিও— ছিলো গণমানুষের যুদ্ধ। সেটারে একাত্তর পরবর্তী টাইমে মোটামুটি আওয়ামীলীগের ইজারার সম্পত্তি বানায়ে ফেলা হইছে। আরও পরে আসি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামে প্রপঞ্চের অবতারণা করা হয়। এই প্রপঞ্চও একইভাবে এদেশের মানুষরে বিভাজিত ও জুলুম করতেই ব্যবহার করা হইছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান একাত্তররে আওয়ামীলীগের কব্জা থাকি উদ্ধারেরও বটে। এবং সেইসাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী হাত থাকি এদেশের মানুষরে মুক্ত করার সম্ভাবনার দুয়ারও খুলছে। আমরা সেই আভাসই পাইতেছি। অভ্যুত্থানের পর সবচাইতে বেশি উচ্চারিত হইতে শোনা যাইতেছে যে শব্দটা সেটা হইতেছে ‘ইনক্লুসিভিটি’। জাতিরাষ্ট্রের মতো সনাতনী, সংকীর্ণ রাষ্ট্র ধারণা বর্তমান সময়ে অচল হইয়া পড়ছে, সেকথা বলাবাহুল্য। ফলে, জাতীয় ঐক্যের জন্য অন্য কোনও ফর্মের জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনও দেখি না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল পার করার পর এই পরিণতমনস্কতা আশা করাই যায়।

আওয়ামী ফ্যাসিজমের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ভারত। আরও স্পেসিফিক ভাবে কইলে, মোদীর হিন্দুত্ববাদী ভারত। ভারতের সাথে আওয়ামীলীগের সখ্য অতি পুরাতন হইলেও মোদী যমানায় সেই সখ্য বিশেষ স্তরে উন্নীত হইছিলো। মোদীর ভারত এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক হিশাবে হাজির হইছিলো। বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী সরকারও খুবই খুল্লামখুল্লাভাবেই দিল্লির গোলামী করি গেছে। কার্যত এদেশের সার্বভৌমত্বরে ধূলিস্যাৎ হইতে দ্যাখা গেছে ফ্যাসিস্ট যমানায়। অভ্যুত্থানের পর হাসিনা ভারতে পলায়া গেছেন। শুরুতে হাসিনারে সেদেশে রাখা হবে কিনা, সে বিষয়ে দ্বিধা দ্যাখা গেলেও এখন ভারত সম্ভবত হাসিনারে রাখতেছেই। ফলে, ভারতরে হাসিনার পরম মিত্র তো বটেই আশ্রয়দাতাও বলতে হবে আমাদের। 

একথা অনস্বীকার্য যে ভারত বলতে গেলে আমাদের  একমাত্র প্রতিবেশী। তার সাথে আমাদের সম্পর্কও ঐতিহাসিক। দুইদেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক নৈকট্য এসবই দুই দেশের মধ্যে  বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ি ওঠার জন্য জরুরি উপাদান হইতে পারে, সেটাই স্বাভাবিকও বটে। সেই সম্পর্ক হইতে হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে। বন্ধুত্ব মানে দাসত্ব না। 

ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অসম, এদেশের বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্পখাতরে ভারতের স্বার্থে ধ্বসায় দেওয়া হইছে, ট্রানজিট-বন্দর এক অর্থে ভারতরে বর্গা দেওয়া হইছে, রইছে নদী ও পানি বিষয়ক অতি পুরাতন ক্যাচাল, এবং দীর্ঘ অনিরাপদ সীমান্ত যেখানে প্রতিদিন এদেশের মানুষরে হত্যা করা হয়। এইসব মিলায়েই বর্তমান বাংলাদেশরে কার্যত দিল্লির কলোনি হিশাবেই দ্যাখা লাগবে। আমাদের চাওয়া ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম-মর্যাদার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ফ্যাসিযমানায় ভারতের লগে সম্পাদিত সকলপ্রকার দাসত্বমূলক, অসম চুক্তিরে বাতিল করা হবে পয়লা কর্তব্য। পলাতক হাসিনারে দ্রুত দেশে ফিরায়ে আনি বিচারের সম্মুখীন করতেও কালক্ষেপণ করা যাবে না কোনওভাবেই। একইসাথে অন্যান্য প্রতিবেশীদের সাথে বহুবিধ সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে সার্করে কার্যকর করা হইতে পারে ভালো সমাধান। সর্বোপরি দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত উপমহাদেশে, ভারতীয় আধিপত্যবাদ-সম্প্রসারণবাদরে রুখতে হইলে বন্ধুত্বের সীমা বাড়াইতেই হবে। কেবল ভারতে আটকায় থাকা যাবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত সবসময়ই একটা ফেনোমেনন হিশাবে হাজির থাকছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ভোটের রাজনীতিতে এদের প্রভাব অই অর্থে ধর্তব্যই না। বাকিসব ইসলামিস্ট দলগুলির অবস্থা তো আরও করুণ। ভারত বা আওয়ামীলীগ মূলত তাদের ন্যারেটিভের স্বার্থেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামিস্ট প্রভাব কিংবা বাংলাদেশের ‘বাংলাস্তান’ হইবার সম্ভাবনার জিকির করি থাকে। এক্ষেত্রে, দুঃখজনকভাবে, এদেশের লেফটিস্ট, সেক্যুলার, প্রগ্রেসিভ বর্গরেও সুর মিলাইতে দ্যাখা যায়। দল হিশাবে জামায়াত একাত্তরের লগে লগে অপ্রাসঙ্গিক হইয়া গেছে। আওয়ামীলীগের তরফে এদ্দিন এদের প্রাসঙ্গিক রাখা হইছে কেবল ন্যারেটিভের স্বার্থে। একাত্তরে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার ব্যতীত এদের কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিলো না। কেবল ভোটের রাজনীতিতেই না বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে এদের গুরুত্বও নাই। বলাবাহুল্য সেটা অন্যান্য আদর্শবাদী রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রেও সত্যি। 

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের লগে লগে আওয়ামী ন্যারেটিভ প্রত্যাখাত হইছে। আওয়ামী ন্যারেটিভের গুরুত্ব নাই মানে জামায়াতও নাই। খোদ আওয়ামীলীগও চব্বিশের পর গুরুত্বহীন হইয়া পড়বে। ওদের কৃত অপরাধের বিচার করতে হবে, সেটা জরুরি। একাত্তরে গণহত্যার অংশীদার হিশাবে জামায়াতের বিচার হয় নাই, আওয়ামীলীগ পরবর্তীতে এটারে ক্যাশও করছে, একই ভুল রিপিট করা যাবে না। একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের সূচনা লগ্ন থাকি চব্বিশ অবধি কয়েক দফার ‘গণহত্যা’র দায় আওয়ামীলীগের কান্ধে। এইসবেরই দ্রুত, এবং সুষ্ঠু, বিচার করতে হবে। 

এইটা ভুললে চলবে না যে জামায়াত ও আওয়ামীলীগ পরস্পরের পরিপূরক মাত্র। এদের একইভাবে ট্রিট ও ডিল করা লাগবে। দল হিশাবে জামায়াত কিংবা আওয়ামীলীগের নিষিদ্ধকরণের চাইতে সুষ্ঠু বিচার জরুরি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী রাজনীতি এদেশে প্রাসঙ্গিকতা হারায়া ফেলছে। 

এর ফলে আমরা একটা নোতুন সম্ভাবনার সামনেও দাঁড়াইছি। কী সেই সম্ভাবনা? দ্বি-দলীয় বৃত্ত ভাঙার সম্ভাবনা, নোতুন রাজনৈতিক দলের উত্থানের সম্ভাবনা। 

এই মুহূর্তে অনেকেই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতা ও নেতৃত্বরে মানতে পারতেছেন না। আওয়ামীদের কথা বাদই দ্যান, বাম ঘরানার লোকজনেরও মানতে সমস্যাই হইতেছে। এইটারে আমি বলতেছি গণঅভ্যুত্থানরে ওউন করতে না পারা জনিত ক্রাইসিস। আমি ব্যক্তিগতভাবে তরুণদের রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে ইচ্ছুক। বুড়াদের পক্ষে লোভের লালাঝরা জিভ নিয়া, ক্ষীণদৃষ্টির চোখ নিয়া দেশ চালাইলে কী ঘটে, তামাম দুনিয়াতেই তা দেখতেছি আমরা। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বুড়ারাই দুনিয়া চালাইতেছেন। 

আশা করি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল শক্তি তরুণ ছাত্রজনতা রাজনৈতিক দল গঠন ও নির্বাচনে অংশগ্রহনের দিকে যাবেন। সেরকম ঘটলে তাদের জনসমর্থন পাওয়ার ব্যাপারেও আশাবাদী আমি। যেহেতু ভোটারদের বড়ো অংশই তরুণ, প্রচলিত রাজনীতিতে অনাস্থাশীল এবং পরিবর্তনকামী।

অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন একটা বড়ো প্রশ্ন হইয়া দাঁড়াছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা যে ফ্যাসিজম কায়েম ও বহাল রাখতে পারলেন, তা সম্ভব হইছে এই কারণে যে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যে সংবিধান রচিত হইছিলো তার মদ্দেই ফ্যাসিস্ট হইয়া উঠবার স্কোপ ছিলো। এখনো আছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই গেছে তারা এর সুবিধা নিছে, লাগলে দরকারি কাটাছেঁড়াও করছে। ফলে, এটার শুধু সংস্কারই যথেষ্ট না, দরকার নোতুন সংবিধান প্রণয়ন। একাত্তরের পর নব্বইয়েও একটা সুযোগ আসছিলো। সে সুযোগ হাতছাড়া হইছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রগঠনে এই দফায় নয়া সংবিধান প্রণয়ন করার বিকল্প নাই। 

প্রয়োজন স্বাধীন বিচার বিভাগ। স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পার হইলেও বিচার বিভাগরে যে স্বাধীন করা যায় নাই এইটা রাষ্ট্র হিশাবেই বাংলাদেশের ব্যর্থতা। ঔপনিবেশিক হ্যাঙওভার না কাটা আমলাতন্ত্র এবং পুলিশি ব্যবস্থা থাকিও আমরা মুক্তি চাই। ফ্যাসিজমানায় আমলা-নির্ভর, পুলিশি রাষ্ট্রই দেখছি বরাবরের মতোই। বলাবাহুল্য যেকোনও টাইমের চাইতে আরও বেশি গণবিরোধী ভূমিকায়। পুলিশের আমূল সংস্কার দরকার। পুলিশ যে কেবল রাষ্ট্রীয় গুন্ডাবাহিনী না এইটা নিশ্চিত করতে হবে। র‌্যাবের মতো বিতর্কিত, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বিশেষ বাহিনী সমূহের বিলুপ্তিও জরুরি।

জরুরি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং একটা সুষ্ঠু ও কার্যকরী নির্বাচনী ব্যবস্থাও।

বাকস্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এমন রাষ্ট্র প্রত্যাশা করি। সিএসএর মতো নিবর্তনমূলক আইন চাই না। নোতুন বাংলাদেশে য্যানো নাগরিক হয়রানি-দমন-নিপীড়নের সহায়ক আইন না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা বাংলাদেশরে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিশাবে দেখতে চাই, কোনও সিকিউরিটি স্টেট হিশাবে না।

বাংলাদেশের ঐক্য ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে সবচাইতে বড়ো সুবিধা ছিলো এদেশের প্রায় একই ধরনের মানুষ। অই অর্থে ধর্ম, ভাষা কিংবা নৃতাত্ত্বিক বিচারে বিভাজিত হইবার সুযোগই ছিলো না। কিন্তু এখানকার শাসকশ্রেণী এরমধ্যেও বিভাজনরে জিয়ায় রাখছে নানারকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার দ্বারা। এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিই মেজর ফ্যাক্টর হিশাবে কাজ করছে। ফলে, মাইনরিটি একটা ইস্যু হিশাবে সবসময়ই হাজির থাকছে। যদিও সাংবিধানিক ভাবে এদেশে কেউ মাইনরিটি না!

ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিশাবে হিন্দুদের আওয়ামী কিংবা ভারতের স্বার্থে ব্যবহৃত হইবার একটা প্রবণতা খেয়াল করছি আমরা। এতে হিন্দুদের যে লাভ নাই, সেইটা বলাবাহুল্য। তার প্রমাণ, ফ্যাসিযমানায় ঘটা সাম্প্রদায়িক সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ড এবং হিন্দুদের ভূমিভিটা দখলের দিকে তাকাইলেই পাওয়া যায়। নোতুন বাংলাদেশে আমরা হিন্দুদের ভারত কিংবা আওয়ামীলীগের ঘুঁটি হিশাবে দেখতে চাই না। তাদের নাগরিক হিশাবে প্রাপ্য অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত দেখতে চাই। ভবিষ্যত বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করবেন, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবেন তারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন আশা করি।

এদেশের শিয়া, কাদিয়ানি সহ বাউলফকির অন্যান্য গৌণধর্মী কিংবা নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী ইত্যাদি বর্গেরও ধর্ম পালন কিংবা না পালনের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিকভাবে আলাদা জনগোষ্ঠীর ওপরও ন্যায্য আচরণ করতে রাষ্ট্র বরাবরই ব্যর্থই হইছে— সেইটা হউক পাহাড় কি সমতল! পাহাড়ে তো সামরিক শাসনই জারি আছে, বাঙালি সেটলমেন্ট ইত্যাদির বয়স ও বিস্তারও কম হইলো না। আমরা এসবের অবসান চাই। এটা হাস্যকর যে রাষ্ট্র আদিবাসীদের আদিবাসী স্বীকৃতিও দিতে রাজি না। এগুলি স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় অবিচার। পাহাড় ও সমতলের জনজাতি সমূহের নাগরিক ও বিশেষ জাতিসত্তা হিশাবে প্রাপ্য অধিকার সমূহ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ভূমি দখল, উচ্ছেদ করা যাবে না। 

বিহারীদের নিয়া অপরায়নের রাজনীতি চালু আছে। রাষ্ট্রের অবহেলা, উপেক্ষা আছে, জুলুমনির্যাতনের ঘটনা আছে। এসব পরিহার করতে হবে। তাদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে রাষ্ট্ররে আন্তরিক হইতে হবে।

এবং সেইসাথে নারীর অধিকার প্রশ্নেও আমাদের বিবিধ দ্বিচারিতা আছে। বিশেষত, ভূমির অধিকার তো কার্যত নাইই। এগুলায় রাষ্ট্রীয় আইনের সমর্থনও আছে। নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের তরফে আর ফাঁকিবাজি দেখতে চাই না আমরা। 

অন্যান্য লৈঙ্গিক পরচয়রেও নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণের, নির্যাতনরে উসিলা হিশাবে ব্যবহার করা যাবে না। 

এই বেলায় আরেকবার ইনক্লুসিভিটির কথা স্মরণে আনা যাইতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়ায়া আছে মূলত তিনটা শ্রেণীর ওপর ভর করি। দুঃখজনকভাবে এ রাষ্ট্র এই তিন শ্রেণীরেই দাস গণ্য করে। এবং সেই হিশাবেই শোষণ ও বৈষম্যও করি আসতেছে। 

এক. 

কৃষক শ্রেণী। এই শ্রেণী বরাবরের মতোই শোষণের শিকার। শাসক, শাসন ব্যবস্থা, রাষ্ট্র সব কিছুর বদল ঘটে, কিন্তু কৃষকের বদল ঘটে না।

এখনো অবস্থা একই আছে। কৃষক উৎপাদন করে বর্ধিত খরচে। আধুনিক কৃষির নামে বিগত কয়েক দশকে তার কান্ধে চাপানি তেল, বীজ, সার, কীটনাশক এবং কামলার মজুরি সবই ভোক্তা লেভেলের বাজার বরাবর সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু কৃষকের তার পণ্যের ন্যায্য দাম নির্ধারণের ক্ষমতা  নাই। কেননা একমাত্র কৃষিপণ্যের দামই বাজার নির্ধারণ করে, উৎপাদক না।

কৃষকের জন্য রাষ্ট্রের অর্থঋণ, ভর্তুকি এসবও অপর্যাপ্ত, লোকদ্যাখানি। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসায়ী ইত্যাদির হাতে পড়ে। সদ্দিচ্ছার অভাবেই। ফলে, কৃষকের অবস্থা সঙিন। এইটারে আমি জাতিগত নিমকহারামি হিশাবেই দেখি। এর থাকি কৃষক ও জাতি উভয়েরই মুক্তি দরকার। 

দুই

গার্মেন্ট ওয়ার্কার। গার্মেন্ট শিল্প প্রকৃত অর্থে শিল্পই না। এইটা মূলত শস্তা শ্রম শোষণের ওপর দাঁড়ায়ে আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই এক শিল্প নির্ভর হইলেও এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায়ও এখানে মজুরি অনেক কম। শ্রমিকদের অন্যান্য প্রাপ্য অধিকারের কথা বাদই দ্যান। এইসব অনাচারই চলে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে। 

তিন

প্রবাসী। প্রবাসীদের বিদেশগমনের উচ্চ খরচ কমানি, আদম ব্যবসায়ের সিন্ডিকেট ভাঙা, তাদের বিদেশে অবস্থান কালে প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ, জান ও ইজ্জতের নিরাপত্তা কোনওটার ব্যাপারেই রাষ্ট্ররে তৎপর কিংবা আন্তরিক পাওয়া যায় না। সোনার ডিম দেওয়া হাঁসটিরে জবাইয়ের ইচ্ছাই প্রবল য্যানো। প্রবাসীদের কল্যাণ ও মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলতা দরকার।

একই কথা প্রযোজ্য চা শ্রমিকদের বেলায়ও। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দাসব্যবস্থা টিকি থাকার ভালো উদাহরণ এগুলি। নোতুন বাংলাদেশে আমরা এইসব দাসত্বের বিলোপ আশা করি। 

ফ্যাসি-যমানায় আমরা উন্নয়ন উন্নয়ন জপ শুনছি অনেকই। এসব উন্নয়ন ছিলো মূলত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মোটাদাগে লুটপাট জায়েজীকরণের হাতিয়ার। এসবের তলে চাপা পড়ছিলো শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক ব্যাপারগুলি। শিক্ষাখাতরে মোটামুটি ধসায়ে দেওয়া হইছে। অথচ উন্নয়নের প্রকৃত সুফল পাইতে হইলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারীর টাইমে চিকিৎসাখাতের দীন দশার চেহারাও দেখছি আমরা। পরবর্তীতেও সে অবস্থার কোনও উন্নতি হইছে, এমন না। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের হইতো তাইলে এই দুই খাতই প্রায়োরিটি পাইতো নিঃসন্দেহে। নোতুন বাংলাদেশে শিক্ষাস্বাস্থ্যরে প্রায়োরিটি দেওয়া হবে, এরকম পরিকল্পনা ও তৎপরতা দেখতে চাই। 

সব স্তরের নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও প্রত্যাশা করি আমরা। নিত্যপণ্যের দাম জনগণের সাধ্যের মধ্যে রাখতে রেশনিং, বাজার ব্যবস্থা  নজরদারি, সিন্ডিকেট গড়তে না দেওয়া এসবেও রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা দেখতে চাই।

 প্রাণপ্রকৃতি য্যানো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শিকার না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। নদী, বন, পাহাড় বিনাশী কোনও উন্নয়ন চাই না আমরা। সুন্দরবনের বুকে যে সর্বনাশা বিদ্যুৎ প্রকল্প চলে জনগণের সম্মতি ছাড়াই, এ জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলি সর্বনাশের পুরাটা সারার আগেই বন্ধ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনও উন্নয়ন প্রকল্প য্যানো হাওরাঞ্চলের সড়ক কিংবা পাহাড়ের রেলের মতো গলার কাঁটা হইয়া না দাঁড়ায় এসব বিবেচনায় রাখতে হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌ-রেলরে প্রায়োরিটি দিতে হবে। কেবল রাজধানীই না মফস্বল ও গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়াও রাষ্ট্রের পরিকল্পিত উদ্যোগ চাই আমরা। রাষ্ট্ররে এটা মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ মানেই ঢাকা না।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর আবারও আমাদের সুযোগ আসছে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্ররে নিয়া নোতুন করি ভাবার ও নির্মাণ করবার। ফ্যাসিস্টের পতনের পর ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাত করা এখনকার টার্গেট। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানরে বিপ্লবের শুরুয়াত ধরতে পারি আমরা। অন্তর্বতীকালীন সরকার বিপ্লবী সরকার হইয়া উঠতে পারবে কি না, বিপ্লবী সরকারের দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি না—তার ওপর এই বিপ্লবের সফলতা নির্ভর করতেছে।

সবচাইতে জরুরি হইতেছে রাষ্ট্রের লগে আমাদের তথা নাগরিকের সম্পর্কটা বোঝা। রাষ্ট্রের লগে আমরা একটা চুক্তি নির্ভর সম্পর্কে থাকি। আমাদের কাজ হইতেছে এই চুক্তিটার শর্তগুলি পালন হইতেছে কি না, সেটা খেয়াল রাখা। অই যদ্দিন রাষ্ট্ররে ভাঙা সম্ভব হইতেছে না আর কি!

Leave the first comment