জনবিতর্ক

নায়েল রহমান

স্বাতন্ত্র্য এবং সম্ভাবনার জুলাই গণঅভ্যুত্থান

September 27, 2024   1 comments   2:11 am

এই ঘটনার আকস্মিকতায় এবং ভয়াবহতায় আমরা যে বিষয়টি খেয়াল করিনি অথবা মানসিক উৎপীড়ন এড়াতে ভুলে যেতে চেয়েছি তা হলো উঁচু দালানের উপর থেকে স্নাইপার ফায়ার, হেলিকাপ্টার থেকে গুলি, গণকবর, লাশ স্তুপ করে জ্বালিয়ে দেয়া, বাসায ঢুকে গুলি করে মারা এইগুলো ঠিক রাজনৈতিক সহিংসতা বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক মধ্যে আর পড়ে না

Share

১.

গত মধ্য জুলাই থেকে মধ্য অগাস্ট পর্যন্ত যা বাংলাদেশে ঘটে গেছে তাকে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ শব্দবর্গ দিয়ে বর্ণনা করা কঠিন। শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা অনেক নতুন ধরনের নৃশংসতা এবং বীভৎসতার সাথে পরিচিত হয়েছি সত্য, কিন্তু তার কোনওটাই আমাদের নির্বিচারে প্রায় সকলের উপর প্রযুক্ত এই জুলুমের জন্যে প্রস্তুত করেনি।

অতীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত ঘটনার প্রতিটির শিকার হয়েছেন আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং দূরত্বে অবস্থান করা বিশেষ কোনও গোষ্ঠির মানুষ। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের পচাগলা, যথেচ্ছভাবে বিকৃত করা লাশগুলো ছিল কেবলই আর্মি অফিসার ও তার পরিবারের। সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে নিহতেরা ছিলেন নিছকই গারমেন্টস কর্মী। ৫ই মে’র রাতে শাপলা চত্বরে পড়ে থাকা নিথর দেহগুলো ছিল মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের। এর বাইরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘটে চলা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লাশ তৈরি করেছিল তা হচ্ছে গুম-খুন হওয়া রাজনৈতিক কর্মী – হয় বিএনপি নাহয় জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবির।

বলা যেতে পারে গত ১৫ বছরে দেশের অভ্যন্তরে এই নিষ্ঠুরতার কোনও এক ধরণের সার্বজনীনতা থাকলেও তার কোনও সামষ্টিকতা ছিলনা। আদর্শিক বা আর্থসামাজিক বা অন্য কোনও পার্থক্যের কারণে এই মৃতদের লাশগুলো যোগ করা যেত না। লাশের সংখ্যা বাড়লেও তাঁর কোনও সামষ্টিক অভিঘাত আমাদের ন্যাশনাল কনশাসনেসে  কোথাও দেখা যায়নি। 

অবশেষে আমাদের মধ্যে সেই কনশাসনেস জাগ্রত হলো দীর্ঘ জুলাইয়ের দিনগুলোতে। আমরা দেখলাম যে এইবার আর রাখঢাকের কোনও বিষয় নেই। বয়স, লিঙ্গ পরিচয়, আর্থসামাজিক অবস্থান নির্ভেদে সবাইকেই মারা হলো ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হুমকি মনে হওয়ার জন্যে।

হতাহতদের কেউই এককভাবে শেখ হাসিনাকে সরানোর শক্তি না রাখলেও, সচেতনভাবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা না করলেও, তারা তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে বৃহত্তর সামষ্টিকের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা দেখলাম কীভাবে প্রধানত বাংলা মাধ্যম থেকে আগত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমিত ইস্যু বিসিএস কোটা সংশ্লিষ্ট আন্দোলন মূলত ইংরেজি মাধ্যম থেকে আগত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংক্রমিত হলো। তারপর তা শ্রমিক, কর্মজীবি, পাড়ায়-মহল্লায় এলাকাবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে গেল।

এই ঘটনার আকস্মিকতায় এবং ভয়াবহতায় আমরা যে বিষয়টি খেয়াল করিনি অথবা মানসিক উৎপীড়ন এড়াতে ভুলে যেতে চেয়েছি তা হলো উঁচু দালানের উপর থেকে স্নাইপার ফায়ার, হেলিকাপ্টার থেকে গুলি, গণকবর, লাশ স্তুপ করে জ্বালিয়ে দেয়া, বাসায ঢুকে গুলি করে মারা এইগুলো ঠিক রাজনৈতিক সহিংসতা বলতে আমরা যা বুঝি ঠিক মধ্যে আর পড়েনা। গৃহযুদ্ধের পোষাকি সংজ্ঞায় এই লড়াই পড়ুক আর না পড়ুক, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে আমরা কার্যত তার মধ্য দিয়েই গিয়েছি।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে শুধু এই সামষ্টিকতা এবং বিশেষ ধরনের নৃশংসতার কারণেই ২০২৪ হয়তো  ‘৪৭ এবং ‘৭১ থেকে ভিন্ন এবং অনন্য নয়। এইবারের আঘাত বিজাতীয় কারো থেকে আসেনি, এসেছে নিজের স্বজাতির কাছ থেকে। এই মানুষরা আমাদের অপরিচিত নয়। তারা ছিল প্রায় প্রতিনিয়ত আমাদেরই আশেপাশে।

উপমহাদেশের তিনটি দেশের ‘৪৭-এর প্রজন্ম অক্ষম ক্রোধে তার সবচেয়ে বড় ঘৃণা তার পার্শ্ববর্তী দেশ আর দেশের ভেতরে রয়ে যাওয়া ভিন্নধর্মীদের জন্যে রেখে দিয়েছিল। একইভাবে ‘৭১-এর প্রজন্ম (মতান্তরে তার একাংশ) পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের শায়েস্তা করতে না পারলেও সবচেয়ে বড় ঘৃণা দেশি সহযোগীদের জন্যে জমিয়ে রেখেছিল। ২০২৪-এর জন্যে এই সমীকরণ তার পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক ভিন্ন, অনেক জটিল। তার পক্ষে এই ঘৃণা জিইয়ে রেখে, সবকিছু ভুলে গিয়ে বা ভুলে যাওয়ার ভান করে স্বাভাবিকভাবে চলাও সম্ভব নয়, আবার প্রত্যককে নির্মুল করে কিংবা নিরপেক্ষভাবে বিচার করাও সম্ভব নয়। এর মাঝামাঝি কোনও অবস্থানে থেকে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিসরে সম্পর্ক পুনর্নিমানের দায়িত্ব তার।

২০২৪-এর প্রজন্ম অবশ্য আরও একটি কারণে আলাদা। সামষ্টিক অভিজ্ঞতায় বারংবার ব্যর্থ হওয়া ‘পরের রেখে যাওয়া’ রাষ্ট্রকাঠামো যে ধরে রাখার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই তা এদের কাছে স্পষ্ট। প্রসঙ্গত বলা যায় ব্রিটিশ কলোনিয়াল রুলের রেখে যাওয়া পুলিশী বিধান এখনও এই দেশে কোনও না কোনওভাবে উৎপীড়নের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ধরে নেয়া যেতে পারে স্বাভাবিক নিয়মে সরকার পরিবর্তিত হতে থাকলে কেউ এই নিপীড়নমূলক আইন কখনও পরিবর্তন করার কথা কখনও চিন্তাই করতোনা। অন্তত ’২৪-এর প্রজন্ম জেনেছে এবং বুঝেছে যে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র তার অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে একই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে পাওয়া কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা দিয়ে দেশ অন্তত নির্বাচন সমস্যার সমাধান করে ফেলার পরে, আবার ২৮ বছর পরে সে একই অবস্থায়ই ফিরে গেছে।

বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশিদের কাছে এও হয়তো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে কেবল নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করাই একটি রাষ্ট্রের জন্য যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের সেপারেশন অফ পাওয়ার, চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স, তাদের ক্ষমতার পরিধির মতন বিষয়গুলোও সমানভাবে জরুরি। শেখ হাসিনার শাসনামলে আমরা দেখেছি কার্যত তিনটি বিভাগ একীভূত হয়ে তাঁর কথা মতনই চলেছে।

ইতিহাস এবং অভিজ্ঞতাকে লব্ধ জ্ঞানের আলোকে আত্মস্থ করে রাষ্ট্রব্যবস্থার গুণগত উন্নতি সাধন এবং সুশাসন নিশ্চিতের কোনও সংস্কৃতি এই দেশে এত বছরেও গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু জাতীয় প্রতিষ্টানগুলো কেবলই শাসক জোটের বিভিন্ন সদস্যদের জন্যে লুটপাট, রিসোর্স এক্সট্র্যাকশনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। যেই রাষ্ঠ্র এত বছরেও তার নাগরিকদের শান্তিকালীন সময়ে ন্যূনতম নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেনি, দেশের বাইরে তার সার্বভৌমত্বকে প্রোজেক্ট করতে পারেইন, সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হওয়ার কোনও প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারেনি, আবারও সেই একই রাষ্ট্রকাঠামো এবং রাষ্ঠ্রীয় নীতি ধরে রাখার কোনও উপযোগিতা তার কাছে নেই।

’৪৭ এবং ’৭১ প্রজন্মের সাথে ’২৪-এর আরেকটি পার্থক্য হলো পূর্বের দুই ক্ষেত্রেই চাপানো সিদ্ধান্ত এবং চাপানো যুদ্ধের কারণে এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের গ্রহণ করে নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে কিছু বিষয়ে জোটবদ্ধ হতে হয়েছিল। ’৪৭-এ জোট হয়েছিল ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে আর ’৭১-এ যুদ্ধকালীণ জোট হয়েছিল ভারতীয়দের সাথে। সেই দিক থেকে দেখলে এইবারের লড়াইয়ে এই দেশের নাগরিকরা নিজেরাই নিজেদের জন্য লড়েছে।

’৭১ যুদ্ধাবস্থায় নিজেদের অস্তিত্বের সংকট কাটাতে তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের শরণাপন্ন হয়েছিল এবং এর কারণেই হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করে। ততকালীন পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও গত পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের নতুন অস্তিত্বের সংকটের মূল বা অন্যতম কারণই সেই ভারত। ’৭১-এর ত্রাতা ভারত এখন ‘বন্ধুদেশ’-এর পরিচয়ে বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষতির কারণে পরিণত হয়েছে।

শেখ হাসিনার আমলে ভারতনির্ভর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশকে কার্যত একটি ভারতীয় কলোনিতে পরিণত হয় এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার একটি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্টা করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে শেখ হাসিনা চীনের সাথেও সম্পর্ক জোরদার করেন। শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার তার নিজস্ব ক্ষমতা নিশ্চিত করা হওয়ায় দেশের স্বার্থে এই সম্পর্কগুলোকে ব্যবহার করেননি। ভারত এবং চীন উভয়েরই মিয়ানমারকে প্রভাবিত করার কমবেশি ক্ষমতা থাকলেও সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল তিনি থামাতে পারেননি। এর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার একটি শীতল লড়াইতো আছেই।

পুরাতন এই ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বর্তমানের প্রেক্ষাপট তাই অনেকাংশেই ভিন্ন। নতুন রাষ্ট্র সংস্কার বা বিনির্মাণে এই বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। এখন অন্তত এটি পরিষ্কার যে যত কষ্ট করে এই রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা হোক না কেন, সুশাসন নিশ্চিত করা হোক না কেন, বর্হিবিশ্বের রাজনীতির সাথে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি সাযুজ্যপূর্ণ না হলে রাষ্ট্রীয় অর্জনের বিশেষ কিছুই আর ধরে রাখা যায়না।

এই সকল কারণে রাষ্ঠ্রের মেরামতের চেয়ে রাষ্ঠ্র বিনির্মাণ এবং পুনর্নিমাণই হয়তো বেশি যৌক্তিক পদক্ষেপ। রুলিং কোয়ালিশন এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্যে কিছু রিফর্ম করলে তা আবারও কিছুদিনের মধ্যেই অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হবে এবং একইভাবে মানুষকে আবারও প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পথে। এক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিয়মিতভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের সামনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সাথে যোগ হতে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলি। ভবিষ্যতের বাংলাদেশীদের রাষ্ট্র গড়তে হবে এই বিষয়গুলোকে মাথায়।   

২.

পুর্বে আলোচিত বিষয়গুলোর কারণে বাংলাদেশের নাগরিকদের সামনে একটি অকল্পনীয় সম্ভাবনার দুয়ারে নিয়ে এসেছে। ইতিহাসের যেকোনও সময়ের চেয়ে আমরা বাংলাদেশীরা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি পলিটিকেল কনশাসনেস ধারণ করছি। কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি থাকলেও একজন বাংলাদেশীর কাছে খুব সম্ভবত যেকোনও ইস্যুই প্রথমত রাজনৈতিক এবং তারপরে অন্য কিছু। শুধু রাজনৈতিকভাবে দেখাই নয়, রাজনৈতিকভাবে এঙ্গেইজমেন্টও মানুষের এখন সবচেয়ে বেশি। আমাদের রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ার জন্য এই সময় এবং সুযোগ আমাদের নিতে হবে।

যখনই আমরা রাষ্ট্রকে গড়ার কথা বলছি তখনই আমাদের সংবিধান আলোচনায় চলে আসে। গত বছরে যেই পাকচক্রে আমরা আটকে গেছি তাঁর একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আমাদের সংবিধানের উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাঁটাছেড়া করা। রাজনৈতিক দোলাচলচিত্ততা, প্রতিহিংসা, কূটচালের জ্বলন্ত প্রমাণ এই কিম্ভূতকিমাকার সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুনভাবে করার জন্য এর চেয়ে সূবর্ণ সুযোগ খুব সম্ভবত সহসা আর পাওয়া যাবেনা।

এই কাজটি বিভিন্নভাবেই হতে পারে এবং ইউনুস প্রশাসন ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছেনও। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি একটি স্বতঃস্ফূর্ত পাবলিক পার্টিসিপেশন থাকা উচিত। এর জন্যে আমরা একটি বিশেষ দেশের ইন্টেলেকচ্যুয়াল এবং এক্টিভিস্টদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারি।

নেটফ্লিক্স এবং হলিউডের সিনেমার কারণে মেক্সিকো আমাদের কাছে কেবল একটা নারকো-স্টেইট। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না হলেও দেশটির আরও কিছু ইউনিক বিষয় আছে। ড্রাগ কার্তেলগুলোকে শুধু সাধারণ ড্রাগ সাপ্লায়ার মনে করলে ভুল হবে। বেশ কয়েক বছর আগে আল-জাঝিরার একটা রিপোর্টে আই*সি*স-এর সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে মেক্সিকান ড্রাগ কার্তেলগুলাকে এর চেয়েও ভয়াবহ এবং নৃশংস হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কিছু পরিসংখ্যান দিলে হয়তো তাদের সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। সরকারি হিসাবেই ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ড্রাগ কার্তেলগুলো ৬০,০০০ লোক মেরেছিল। অনেকে বলে যে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০% কমিয়ে দেখানো হইছিল। শুধু তাই নয় যে কমিউনিটিগুলোতে তারা সক্রিয়, সেখানের লোকজনদের টেরোরাইজ করতে তারা ইচ্ছামতন নারী এবং শিশুদের টার্গেট করে, অত্যাচারের ছবি সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে।

এইতো কেবল দেশটির বেসরকারি খাতের টেররিজমের অবস্থা। তাদের সরকারি খাতও খুব একটা পিছিয়ে নেই। মেক্সিকান বিপ্লবের পর থেকে মেক্সিকোতে এক মেয়াদ বাদ দিলে প্রায় পুরা সময়টাই ইন্সটিটিউশনাল রেভোলিউশন পার্টিই ক্ষমতায় ছিল। বিষয়টা আরো ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে মনে করতে পারেন যে মেক্সিকোতে ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’-ই ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। ঠিক তাদের দক্ষিণ এশীয় কলীগদের মতন মেক্সিকোতেও তারা ক্ষমতায় থাকার সময় এলেকশানও হইতো। প্রায় প্রতিবারই ব্যাপক রিগিং আর ফ্রডের মাধ্যমে তারাই ক্ষমতায় রয়ে যাইতো। এদের শাসন সম্পর্কে পেরুর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ম্যানুয়েল ভার্গাস ইয়োসা বলছিলেন ‘পারফেক্ট ডিক্টেটরশিপ’।

তো এই পারফেক্ট ডিক্টেটরশিপের আন্ডারে দেশটির আঞ্চলিক এবং স্থানীয় সরকারের অবস্থা কতটা করুণ হতে পারে তাও হয়তো আন্দাজ করা যাবে। একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার আর ড্রাগ কার্তেলের উপর যোগ হয়েছে ব্যাপক দূর্নীতি, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের (বিশেষত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর) উপর ড্রাগ কার্তেলদের কর্তৃত্ব, স্থানীয় ডাকাতদলের উপদ্রব। এরও উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হিসাবে আছে এমেরিকানদের ‘ওয়ার অন ড্রাগস’-এর উদ্ভাবনী কৌশল যার আওতায় অবিশ্বাস্য মনে হলেও কিছু কার্তেল পেয়েছিল উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র এবং এই সরকার পেয়েছিল তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য প্রায় বিলিয়ন ডলার সহায়তা।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে তাহলে সাধারণ মানুষজন এর বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিবাদ করে, কী পদক্ষেপ নেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে বেশ কিছু এলাকায় ভিজিল্যান্টিরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করেছে। দেশটির এই অঞ্চলগুলো বিভিন্ন কারণে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র আর ইনেভিটেবলি নির্যাতিত। অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষজন  থানা দখলে নিয়েছে। অনেক জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে কিছু হলেও অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পেরেছে। এই কাজ করতে গিয়ে আবার সাধারণ মানুষকে শুধু ড্রাগ কার্তেল না তাঁর সাথে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল, কারণ সরকার মনে করেছে যে এই সাধারণ মানুষ এবং ভিজিল্যান্টিরা তাদের ক্ষমতা দখল করতে চায়। দুই প্রবল প্রতাপশালী প্রতিপক্ষের সাথে সাধারণ নাগরিকদের এই লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা দেখার বিষয়।

এই সমস্ত ঘটনাই বছর দশক আগেকার এবং এখনও এর অনেক কিছুই জারি আছে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অসাধারণ ঘটনা ঘটে। নাগরিকদের সশস্ত্র প্রতিরোধের পাশাপাশি মেক্সিকোর সংবিধান প্রণয়নের বর্ষপুর্তিতে দেশের লিডিং অ্যাক্টিভিস্ট, ইন্টেলেকচ্যুয়ালসহ প্রায় হাজার খানেক ব্যক্তি জড়ো হন। দেশের রাজধানী মেক্সিকো সিটিতেই তারা আয়োজন করলেন প্রথম ন্যাশনাল সিটিজেন্স’ অ্যান্ড পপ্যুলার কনস্টিটূয়েন্ট অ্যাসেম্বলি। তারা মেক্সিকান সংবিধানকে ‘বটম-আপ’ রিভিশনের জন্যে এই ফোরামটা গড়ে তুলেছিলেন।দেশের সহিংসতা, দূর্নীতি আর রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার জন্যেই তাদের উদ্যোগ। এত বছরে দেশে আইনের শাসন এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় মেক্সিকোর সবচেয়ে কনসার্ন্ড নাগরিকরা  চুপচাপ বসে না থেকে অথবা সোশাল মিডিয়ায় না বসে থেকে সরাসরি কাজে নেমেছিলেন।

সংগঠকরা বলএছিলেন যে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ঘটে যাওয়া মেক্সিকান রেভোলিউশন থকে আসা মেক্সিকোর বর্তমান সংবিধান মেক্সিকান রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন আর নিওলিব্রেল রিফর্মের জন্যে কার্যত মৃত। তারা শুরুতেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তাদের উদ্যোগে কোনও রাজনৈতিক দলের (যারা তাদের মতে প্রকৃতভাবে কাউকে প্রতিনিধিত্ব করেনা) বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা থাকবেনা।

এই উদ্যোগকে খুব আদর্শবাদী, রোম্যান্টিক কিছু মনে হলেও এবং সেই কারণে অনেকেই এর সার্থকতা নিয়ে সমালোচনা করবেন। কিন্তু যেই বিষয়টি বাংলাদেশী হিসেবে কারোরই অস্বীকার করা উচিত না যে এই ধরণের কনভেনশনাল রাজনীতির বাইরে থেকে সক্রিয়তাই খুব সম্ভবত রাষ্ঠ্র পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত জানার এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্যে সবচেয়ে ঊত্তম ঊপায়। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রথম ন্যাশনাল সিটিজেন’স অ্যান্ড পপ্যুলার কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করার বিপক্ষে আসলে কোনও কারণে নেই।

1 comment

  • Nazmus Sakib

    লেখাগুলো ভালমতন এডিট করে নিলে ভাল।বানানগত ও সাবজেক্ট -ভার্ব এগ্রিমেন্টজনিত অসংগতি আছে।

Leave your comment