জনবিতর্ক

কবির আহমেদ

আইন এবং প্রতিষ্ঠান সংস্কার আমাদের কোথায় নেবে?

September 23, 2024   0 comments   2:19 pm

গণঅভুত্থানে মানুষ কী কী রিজেক্ট করলো এবং কেন রিজেক্ট করলো- সেই আলাপ জারি রাখতে হবে ইন্টেলেকচুয়ালদের। নানা ডাইমেনশনে। সেই রিজেকশনের এম্পাওয়ারমেন্ট লাগবে।  আইনে না। তার ভাষায়। তার সমাজে। এইটা পলিটিকাল পার্টিগুলার কাছে যেন মেসেজ আকারে যায়,সেই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।

Share

যারা সংবিধান/আইন নিয়ে বেশি কনসার্নড, তাদের পলিটিকাল স্পেস তৈরির কাজেও খেয়াল রাখা দরকার। পলিটিকাল কাঠামোর ওপরে স্পেস নির্ভর করে না। বরং পলিটিকাল ট্রানজেকশন বা এক্টিভিটি এমন স্পেস তৈরি করে, যা পলিটিকাল কাঠামো ঠিক করে। আকার দেয়। সেইটার ঘষামাজায় লাগে সংবিধান বা আইন। তার বেশি না।

বিগত পার্লামেন্ট ঠিক কী করছে?  তারা ভাবছে সংবিধানে যদি তত্ত্বাবধায়ক না রাখি, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক/অন্তর্বর্তীকালীন  সরকার আসবে না। তো, এখন কি আছে? ফলে আপনি যে আইন বানালেন, তা অত গুরুত্বপূর্ণ না। বরং পাবলিক ফাংশনালি কি একসেপ্ট করতেছে, তাই-ই গুরুত্বপূর্ণ। 

আয়নাঘর নিশ্চয়ই আইনের বাইরে ছিল। ক্ষমতা সত্ত্বেও কেন আইন তাকে বৈধতা দিতে পারে নাই?  কারণ কোন না কোনভাবে পলিটিকালি এমন স্পেস তৈরি হয়েছিল, যেইখানে আয়নাঘর তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিল। কিন্তু আইনতভাবে বৈধ হতে পারে নাই। আরো সময় পাইলে হয়তো এগুলাও নরমালাইজড হতো। নেসেসারি ক্রাইমের লেজিটেমেসি পাইতো।

অর্থাৎ আপনি পক্ষে বা বিপক্ষে কী আইন করতেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ বটে। কিন্তু সেই আইন বা নিয়ম বা গঠনতন্ত্র ফাংশন করতে পারবে কিনা, সেইটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। আইন ন্যায় ধারণ করতে পারে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত বিগ আদার বা ভাষা বা সমাজে সেই ন্যায় সাবকনসাসলি থাকে। আপনি যতক্ষণ সোসাইটিতে ন্যায়ের সেই ক্ষমতায়ন বা রাজনীতি দাঁড় করাতে পারবেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনের সেই ধারণ ক্ষমতা নাই।

আইন সমাজ ঠিক রাখে না। সমাজই রাষ্ট্রের আইনের আবশ্যকতার পরিবেশ তৈরি করে। একটা আদর্শ আইন লেখা সহজ। কিন্তু সেইটা ফাংশন করতে পারবে কিনা-সেইটা বড় কাজ। যেইখানে দাস ব্যবসা একমাত্র ইকোনমি, সেইখানে দাস ব্যবসা শুধুমাত্র ন্যায়ের খাতিরে বন্ধ করা সমস্যা উৎপাদন করতে পারে। দাস ব্যবসা বন্ধ করতে হলে, আগে তার ইকোসিস্টেমে দাস ব্যবসা যেই সকল কারণে একমাত্র ইকোনমি হয়ে উঠছে, সেইটা দূর করতে হবে। সেইটা শুধু আইনের কাজ না। শুধু সংস্কারের কাজ না। সমাজের মধ্যে থেকে সেই স্পেস তৈরি করার পরই কেবল ওই আইন কাজ করবে। পলিটিকাল পার্টির প্রাইম কাজ এইটা। পলিটিকাল পার্টির মূল কাজ পার্লামেন্টে বসে আইন বানানো না। এইটা কলোনিয়াল এপ্রোচ। আইন বানানো কাজ হলে,আমলা দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব ছিল।

পলিটিকাল কনশাসনেস তৈরি না করলে বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি না হলে, এইসব আইন-কানুন স্রেফ ডকুমেন্টস। এবং সদিচ্ছা রিসিপ্রোকাল। অর্থাৎ শুধু পার্টির থাকলে হবে না।

পাবলিকের সাথে তার আইডিয়ার লেনদেন থাকবে। এবং ক্লিয়ারলি সেই ট্রানজেকশন বুঝতে ইন্টেলেকচুয়ালদের ওইসব বিষয় নিয়ে প্রকাশনায় যেতে হবে। বোঝাপড়া সহজ করতে হবে। যেমন, বিগত পার্লামেন্টের পতনের সাথে মধ্যবিত্তের সংযোগ ছিল। তাতে অনলাইনে যারা লেখালেখি করতো, তাদের স্ট্রং ফাউন্ডেশন ছিল। বইপত্র কাজে আসে নাই। অনলাইনে লেখালেখি পড়তে পড়তে তারা বুঝতে পারছে, স্পেশালি ইয়াং যারা যে, তারা ঠিক কথাই বলতেছে। ন্যায়ের আলাপই করতেছে। কিন্তু কেন সেই ন্যায় প্রতিষ্ঠা বা পলিটিকালি এম্পাওয়ার্ড হইতেছে না? ওই জায়গাটাই বোঝাপড়ার জায়গা।

ডার্ক ওয়েবে নানা ক্রাইম হয়। শিশু পর্নোগ্রাফী বা অস্ত্র কেনাবেচা সহ নানা ক্রাইম। তো, মনে করেন, কোনভাবে ডার্ক ওয়েব বন্ধ করলেন। তাতে ওই কন্টেন্টগুলা ডার্ক ওয়েবে পাবেন না। কিন্তু কাজগুলা বন্ধ হয়ে যাবে, তার কোন গ্যারান্টি নাই। অন্য কোন চ্যানেলে যাবে। ফলে সরাসরি আইন করা মুশকিল।

সিন্ডিকেটে চাঁদাবাজি যারা করতো, তারা ভোটারও। ফুট সোলজার কারা? মোস্টলি, দারিদ্রসীমার নিচের বিশ পার্সেন্ট। এরা ট্রেডিশনাল পলিটিক্সের অন্যতম ক্যাপিটাল। তাদের ব্যবসার ক্যাপিটাল নাই, পড়াশোনার অপরচুনিটি কস্ট নাই। ফলে তাদের সচ্ছল আয়ের পথ লিগালি খুব ন্যারো। গার্মেন্টসে গিয়ে চাকরি করলেও তারা এক্সপ্লয়টেড। এবং কোন মাফিয়ার অধীনে গিয়ে তাদের নিজেদের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে। আমার ধারণা, অন্তত জিডিপির পনেরো থেকে বিশ পার্সেন্ট এইসকল শ্যাডো বা ডার্ক ট্রানজেকশন নির্ভর। এইসব ইকোসিস্টেম পলিটিকালি ডেভেলপ করতে হবে। সাথে স্ট্রাকচারাল ডেভেলেপমেন্ট লাগবে।

একটা ইকোসিস্টেমে কী হয়? মনে করলেন, সাপ বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর। মেরে ফেললেন। পুরা ইকোসিস্টেমটাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আপনিও তার বাইরে না। আইন হচ্ছে, এইরকম সাপ মেরে ফেলার মত। আপনার বরং সাপের স্পেস তৈরি করতে হবে। কারণ দুনিয়ার কোন কিছুই রিপ্লেসেবল না। এডাপ্টেবল। চেঞ্জেবল। ট্রান্সফর্মেবল। এমিবা-ই একসময় কুমির হয়। 

ফ্রয়েড এবং মার্ক্স থেকে আমরা এইটুকু বুঝতে পারছি যে, সমাধান লক্ষণে না। রোগের চিকিৎসায়। আর রোগ  দাম আর স্বপ্ন না। রোগ হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের লেবারে আর অবদমিত ইচ্ছায়। 

ফলে আইন যত উদার হবে, যত কম স্পেসিফিক হবে, বড় স্পেসে হবে, যেইটা এডাপ্টেবল, যেইটা কোন ব্ল্যাক সোয়ানেও কাজ করতে পারে, যেইটা তার কাঠামোরে নিতে পারবে এবং পলিটিকাল স্পেস তৈরি করতে পারবে, সেইটাই তত কার্যকর হবে। একটা আইনী রাষ্ট্রের চাইতে তার পলিটিকাল কনশাসনেস গড়া বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যেই কাজ পলিটিকাল পার্টি থেকে ইন্টেলেকচুয়াল-কারো ভেতরেই দেখা যাচ্ছে কি?

ইনস্টিটিউশন সংস্কার করে এই সমস্যা সমাধান করা যায় না। বরং ইনস্টিটিশন এইসকল বিষয়ের সাথে এডাপ্ট করে।

প্র‍্যাকটিকালি বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানের আইনই সম্ভবত শতভাগ ইমপ্লিমেন্ট করা যায় না। কারণ, এইসব আইনের সাথে সোশাল ইকোসিস্টেমের কোন সংযোগ নাই। 

দুনিয়ার কম স্পেসিফিক কিংবা অলিখিত সংবিধানের দেশগুলা কিভাবে ফাংশন করে? তারা কিভাবে ডেভলপ করে? তারা শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে ডেভেলপ করে। আমি ফরমাল কালচার বুঝাইতেছি না। মানুষের সাথে মানুষের যে মিথষ্ক্রিয়া হয়, সেইটা ডেভেলপ করা। সেই ইতিবাচক মিথষ্ক্রিয়াই আইনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তখনই কেবল আইন তার ক্ষমতা এবং বৈধতা পায়।

গণঅভুত্থানে মানুষ কী কী রিজেক্ট করলো এবং কেন রিজেক্ট করলো- সেই আলাপ জারি রাখতে হবে ইন্টেলেকচুয়ালদের। নানা ডাইমেনশনে। সেই রিজেকশনের এম্পাওয়ারমেন্ট লাগবে।

 আইনে না। তার ভাষায়। তার সমাজে। এইটা পলিটিকাল পার্টিগুলার কাছে যেন মেসেজ আকারে যায়,সেই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে।

আল্টিমেটলি পলিটিকাল পার্টি দেশ চালাবে। ফলে নতুন পলিটিকাল পার্টি আসা বা সংস্কার হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ণকারী হওয়ার চেয়ে পাবলিকের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটানোর রিপ্রেজেন্টেটিভ হতে হবে।

রাষ্ট্র কখন খোদা হয়? ফেরাউন হয়? খারাপ শাসক হওয়া না শুধু। কোন পার্লামেন্ট যদি ভালও হয়, তাও সে ফেরাউন হতে পারে। 

পাবলিকের ভাল মন্দ পাবলিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানাবে। শুধুমাত্র পার্লামেন্টের বিবেচনায় হবে না।

রাষ্ট্র হবে পাবলিকের ইচ্ছার প্রকাশ। আইন হবে সাময়িক এবং প্রয়োজননির্ভর। ন্যায়ের বোঝা তার পিঠে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। আদর্শ একটা ইউটোপিয়া। বাতিঘর। তার দিকে চোখ রেখে এগোতে হবে৷ কিন্তু তার উপস্থিতি সময় ভবিষ্যৎ।

তার সাবলাইম অবজেক্টকে খেয়ালে রাখতে হবে।

একমাত্র খোদাকেই শুধু বলতে পারেন যে, আমার কোনটায় ভাল, কোনটায় খারাপ- তুমিই জানো। এই স্পেশাল স্পেসই খোদা। এই ব্যাতিক্রমের বাইরে, সাবজেক্টের দায় সাবজেক্টের। কোন গল্পের পেছনের গল্পের প্রয়োজন নাই।

কোন গভমেন্ট এবসলুটলি ভাল হলেও, তার অটোক্রেসির লেজিটেমেসি নাই। লেফটের ইতিহাস আমরা দেখছি। ফলে এইসব ইলুশনের আর দরকার নাই। প্রপার ডেমোক্রেসির দরকার। ট্রায়াল এন্ড এরর দরকার। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ভিন্ন। তার ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ভিন্ন। ফলে তার নিজস্ব শরীর থেকে উঠে আসা সংকেত ধরে ধীরে ধীরে কম আইনী উপায়ে প্রগ্রেসই আমাদের পথ হওয়া উচিত।

প্রগ্রেস কি আসলে? ভাল/ মন্দ কোন কিছু অস্ত্বিত্বশীল হয়ে ওঠে তার কন্ট্রাডিকশন থেকে।

তাকে কোন দিকে ছুটতে হবে না। বরং তার চারপাশের কন্ট্রাডিকশন মোকাবেলার মাধ্যমেই তার ভেক্টর তৈরি হবে। জোর করে কোন দিক নির্ণয়ের দরকার নাই। নন-বাইনারি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভাব্য প্রভাবের বাইরে গিয়ে সেই স্পেস তৈরি করতে পারলেই সামনে আগানো সম্ভব। কোথাও ছুটতে হবে না। কন্ট্রাডিকশনগুলা মোকাবেলা করতে হবে। সম্ভাবনার শর্ত মূলত এই মোকাবেলা। 

সেই কাজে, পলিটিকাল ডেভেলপমেন্টের বিকল্প নাই।

Leave the first comment