লাল জুলাইয়ের সূচনা হিসাবে আপনে বিডিয়ার বিদ্রোহ এবং শাপলার গণহত্যারে বিবেচনায় আনতে পারেন। শাপলার গণহত্যা প্রচুর লেখক, সাংবাদিক, চিন্তক, যুবকের জীবনের মোড় নানাভাবে ঘুরাইয়া দিছিল। শাপলার গণহত্যা হইতে লাল জুলাইয়ের শুরু- এইরকম প্রস্তাবনা মন্দ নয়। তখন হইত লেখক, একটিভিস্টরা গণহারে সোশাল মিডিয়ায় লেখালেখি শুরু করেন। সোশাল মিডিয়ায় আসবার আগে, ব্লগ যুগে, লেখার মাধ্যম হিসাবে একটা কমন বাংলা ইমার্জ করে। যেইটা সোশাল মিডিয়ায় ব্যপকভাবে ছাড়ায়। যারা এর প্রভাব বুঝবেন না, তারা লাল জুলাই বুঝবেন না।
লাল জুলাইয়ের একটা মাথা (সাইড) যদি হাসিনার বাকশাল হয়, আরেকটা মাথা (সাইড) হইল আমাদের কালচারের প্যারাডাইম শিফট। বাংলাদেশের সাহিত্যে একটা প্যারাডাইম শিফট ঘইটা গেছে, গত একযুগে। একটা পোস্ট মডার্ন লিটারেচার এইখানে উৎপন্ন হইতেছে, যার মেরুদন্ড কলকাতা বা ইউরোপে স্থাপিত নয়। তা বাংলার জল হাওয়ায় লালিত-পালিত।
এই কারণে দেখবেন, জুলাই বিপ্লবে পুরানা (প্যানপ্যানা) তেমন কোন গানই আমাদের কামে লাগে নাই। রঠা এই বিপ্লবে প্রায় অপাংক্তেয়। তুলনায়, নয়া আরবান ফোক বেশ রিলেভান্ট। এরই অংশ র্যাপ গানগুলা- ‘আওয়াজ উডা’ বাংলাদেশ এর মত আগুন ঝরানো গান। (কানই, আমা, ফম ইত্যাদিও কিন্তুক লাল জুলাইয়ে কবিতাসমেত হাজির আছিলেন।)
কালচারের প্যারাডাইম শিফট না হইলে, আমরা এই বিপ্লব হয়ত, করতেই পারতাম না। ওয়েল, শাহবাগের বিপরীতে অনেক রাইটারই একটিভ আছিলেন। একজন বা দুইজন ত অবশ্যই নয়। উনারাই শুরুর সৈনিক। উনাদের মধ্যে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কারা? এক একজন হয়ত এক একভাবে বেপারটা দেখবেন। এইখানে ফরহাদ মজহার আর তার অনুসারীরা ছিলেন। ব্রাত্য রাইসু আর তার বন্ধু-বান্ধবরা ছিলেন। রিফাত হাসান ছিলেন। ফরহাদ মজহার আর শাপলার মৌলভিদের একটা এজেন্সি আছিল। যেইটা মোটাদাগে একটিভিজমকে পদ্ধতি হিসাবে বাইছা নিছিল। রাইসুর অনুগামীরা ফাঁসির বিপক্ষে কথা বলতেছিলেন। রাজাকার বা জামাত শিবির বিষয়ে তারা ডাইরেক্টলি কথা বলতেন কম। রিফাত হাসান জামাত-শিবির প্রশ্নরে সরাসরি ডিল করেন। তাদের নিপীড়নরে প্রশ্নের আওতায় নিয়ে আসেন। এর কালচারাল গোড়া হিসাবে, ‘রাবীন্দ্রিক বাংলাদেশ’কে দায়ী করেন। আর ‘সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির’ নয়া প্রস্তাবনা হাজির করেন।।
শাপলার পরে, মৌলভিদের বড় একটা অংশ অনলাইনে রাইটার হিসাবে পরিচিত হন। তারা সাহিত্যের সব জায়গায় ঢুকতে থাকেন। এই সময়কালে, রক মনু আর ইমরুল হাসানদের আগমন হয়। জিয়া হাসান, পিনাকী ভট্রাচার্য ইত্যাদির মতন এক্টিভিস্ট, এনালিস্ট, ইউটউবাররা বেশ পরিচিত হইয়া উঠেন। মাঝখানে, রেজাউল করিম রনির ‘জবান’ও বেশ পপুলার হয়।
ইন্টেলেকচুয়াল পরিমন্ডলে, রিফাত হাসান, শাপলার পরের বাংলাদেশে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে থাকবেন। যদিও, সবচাইতে পপুলার ইন্টেলেকচুয়াল, সবসমই আছিলেন, ফরহাদ মজহার এবং সলিমুল্লাহ খান। বদর উদ্দিন উমরও, বাকশাল বিরোধীতায় সরব আছিলেন। এইসব নামের মইদ্যে মধ্যে, নতুন করি, ইমরুল হাসান আর রক মনু যুক্ত হইলেন। এরা একটা ছোটখাটো কাল্ট তৈয়ার করলেন। তারা আছিলেন কমন বাংলার পক্ষে, এপ্রোচের দিক দিয়া পোস্টমডার্নিস্ট এবং পজিশনের দিক দিয়া বাকশাল বিরোধী। তারা একযোগে ‘বাকশাল’ শব্দটারে প্রমোট করলেন।
এই সময়ে আইসা ব্রাত্য রাইসু কিছুটা লেস রিলেভান্ট হইতে থাকলেন। তার অনুসারীরা সরাসরি বাকশাল বিরোধীতায় জড়াইলেন না। বাকশালের প্রকাশ্য দালালও হইলেন না। ঠিক তখন, মাহবুব মোর্শেদ আর তান কমরেডরা প্রকাশ্যে বাকশাল বিরোধী হিসাবে অবস্থান নিলেন। রাইসুর অনুসারীরা যেকোন ক্রাইসিস মুহূর্তে নিরব থাকতেন। পরে তারা আবার তাদের মত, পর্যালোচনা ইত্যাদি নিয়া হাজির হইতেন। মাহবুব মোর্শেদরা এইটারে সুবিধাবাদী অবস্থান হিসাবে চিহ্নিত করতেন। যদিও, এইটা সইত্য যে, একসময়, আমাদের মতন নতুন চিন্তক-এক্টভিস্টদের অনুপ্রেরণার একটা বড় জায়গা আছিলেন ব্রাত্য রাইসু।
দীর্ঘ সময় ফাইটের পরে শাহবাগীরা কালচারালী বিপর্যস্ত হয়। অনেকেই প্রকাশ্যে দু:খ প্রকাশ করে। অনেক বামপন্থী তখন হইতে একশভাগ বাকশাল বিরোধী হইয়া যায়। এই অবস্থায়, আ-আল মামুন, পারভেজ আলমরা বেশ এক্টিভ অবস্থান নেন। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ এর নামেও জড়ো হয় বেশকিছু লোক। রাষ্ট্র সংস্কার প্রকাশ করে ফরহাদ মজহারের বই ‘গণ অভ্যুত্থান ও গঠন’। অনেক নতুন মুখ তখন ইমার্জ করে। তুহিন খান বেশ পপুলার হয়। রাতুল মুহাম্মদও পপুলার হয়। এই সময়ে ফাইটারদের সংখ্যা অজস্র হইয়া উঠে। মূলত, এই সময়ে আইসা বাকশালী রাইটাররা দুইভাবে মাইর খায়- ক. তারা কমন বাংলায় লেখে না। ফলে, নয়া রাইটারদের কাছে অপাংক্তেয় হয়। খ. তারা বাকশালে নিরব থাকে। নতুন রাইটাররা এদেরকে রিজেক্ট করে।
সাহিত্যের প্রায় সবগুলা সেক্টরে রদবদল শুরু হয়। কবিতার মানুষ হিসাবে, কবিতার প্যারাডাইম শিফটের কিছু নমুনা প্রকাশ করি- আশি নব্বই আর শূন্য দশক হইল, মোটাদাগে, গাদ্দারদের সময়। এই সময়কার বেশীরভাগ লেখকই চিন্তার দিক দিয়া বলদ আর বাকশালের সাপোর্টার আছিল। তবুও, এই সময়কার কিছু নায়করা বাংলা কবিতার মোড় ঘুরাইয়া ফেলায়। তো, ব্যক্তি ফরহাদ মজহারের কৃতিত্ব অনেক দিক দিয়াই। উনি ভাষায় (চিন্তায়ও) কিছুটা কলোনীয়াল, কলকাতাপন্থী। তবুও, আমাদের বড় কবি হিসাবে তার কবিতার স্ট্রাকচার ও ভাব-ভংগীমা আমাদের জন্য পথ প্রদর্শক হিসাবে কাম করে। (লাল জুলাইয়ের বিপ্লবের সময়ে তার একটা কবিতা নেটিজেনদের ওয়ালে ওয়ালে ছড়াইয়া পড়ে)। তারপরে, ব্রাত্য রাইসু, কামরুজ্জামান কামু, জহির হাসান, ইমরুল হাসানদের কাজ-কাম আলাদা আলাদা পথ নির্মাণে সক্ষম হয়। নাম হিসাবে এরা অল্প। এদের বাইরেও, অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাম আসবে।
কিছুটা কলকাতার মেজাজে তখন হাসান রোবায়েত বাকশাল বিরোধী কবিতা লেখেতে থাকে। রিফাত হাসান লেখেন ‘জল্লাদখানায় বইসা কবিতা পাঠ’। ইমরুল আর রাইসু কিছু রাজনীতি সচেতন কবিতা লেখেন। এরপরে কিন্তুক, এক সমুদ্র কবিতা রচিত হইয়া যায়। একেবারে হালের আমলের শেখ সাদ্দাম হোসেন লেখেন রিদয় নিংড়ানো বিপ্লবী কবিতা। আমাদের সময়কার কবি-বন্ধুরা মুহূর্মুহু হুংকার ছাড়েন কবিতায়। এইসব নাম অগণিত। একেবারে শেষদিকে, হাসান রোবায়েত খুল্লামখোল্লা ভাষায় নিজের রাজনৈতিক ভাব ব্যক্ত করতে থাকেন। বেশকিছু স্লোগানও তিনি লেইখা ফেলেন তখন।
আমার এই লেখায়, কবিতার বাইরে, শিল্প সাহিত্যের অন্যান্য শাখার কথা আলোচিত হইল না। স্পেশালিস্টরা তা বলবেন। কবিতার বাইরে, আমি কিছু এক্টিভিস্ট এবং ইন্টেলেকচুয়াল এক্টিভিটিরে লোকেইট করার কুশিশ করলাম এইখানে।
জুলাই বিপ্লবের বেপারে অনেকেই অনেকভাবে লেখবেন। অনেকেই নিজেদেরকে বিপ্লবী বানাইবার কুশিশ করবেন। আমার এই লেখারেও, এইসব বিপ্লবীদের লেখার পাশে রাখার আর্জি রইল।
আমি ইচ্ছা করেই ইউটউবার এবং জার্নালিস্টদের নাম রাখলাম না। তারা পপুলার কালচাররে চেইঞ্জ করতে বেশ হেল্প করছেন। মাস পিপলরে বিপ্লবে শরীক হইতে সাহায্য করছেন। তাদের নাম প্রায় সকলেই জানেন। কিন্তুক, আমি যেই প্যারাডাইম শিফটের কথা বললাম, যাতে শরীক আছেন দেশের ইয়াং কবি-সাহিত্যিক, ক্রিটিক-ইন্টেলেকচুয়াল; তাদের হইয়া উঠবার একটা গল্প আছে। এই গল্পেরই একটা অংশ হিসাবে, আমার এই লেখাটা পাঠ করার অনুরোধ থাকল।