জনবিতর্ক

সৌরভ মাহমুদ

নয়া বাংলাদেশ: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতির ইশতেহার

September 12, 2024   0 comments   2:23 pm

ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে যে নীতি প্রদর্শন করে, মোটাদাগে এগুলো একটা দেশের সরাসরি সার্বভৌমত্বে আঘাত। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা এবং অবস্থান হচ্ছে তার সার্বভৌমত্ব। এটা বিনা একটি রাষ্ট্র, তার রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় না। অথচ বারে বারে বিগত ৫০ বছরে প্রতিবেশী দেশ আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনেছে।

Share

৫ই আগস্ট তথা ৩৬শে জুলাই বাংলাদেশ তার ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ লাভ করে। যারা এই স্পিরিটের সাথে একমত না, তারা আমাদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে আস্থাভাজন হতে পারেন না। নতুন দেশকে ঢেলে সাজানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা পদে আসীন হয়েছেন মো. তৌহিদ হোসেন। বাংলাদেশের যে সকল ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার কিংবা পুনর্গঠন হওয়া দরকার, তার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি অন্যতম। কারো কারো মতে তা প্রধান হবার দাবীদার। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় আর বাকি মন্ত্রণালয় থেকে স্বতন্ত্র‍্য। সবে মাত্র আজকে পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগ হলেন মো. জসীম উদ্দীন। উনি চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। যদিও ডিসেম্বর পর্যন্ত নিযুক্ত থাকা মাসুদ বিন মোমেনকে তার পদে বহাল রাখার একটি গুঞ্জন উঠেছিল। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কার্যালয়ের প্রধান পাঁচজন ব্যক্তি, গত সরকারের আমলেও একই পদ প্রাপ্ত ছিলেন। মোটামুটি বলা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আগের লোকগুলোকেই রদবদল করা হচ্ছে মাত্র। কিংবা তারাই বহাল তবিয়তে আছেন। তাহলে কি পররাষ্ট্রনীতিও একই থাকবে?

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তার প্রাথমিক দিনগুলোতে বিগত সরকারের মতই বাইরের বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে বক্তব্য, দেশে সমালোচনার ঝড় তুলে। পরবর্তীতে তিনি তার বক্তব্য পরিবর্তন না করলেও, ভারতের বিরুদ্ধে কিছু কঠোর কথা শুনিয়ে দেন। যার মধ্যে “শেখ হাসিনাকে বিবৃতি দিতে দিলে দিল্লীর সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে” বা “আইন মন্ত্রণালয় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনবার জন্য বললে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার ব্যবস্থা নিবে” ইত্যাদি। যদিও এই বক্তব্য গুলো জনতুষ্টির জন্য সমর্থন যোগ্য। আদতেও কতটা কার্যকরী হবে, তা সময় বলবে।

দিল্লীর আধিপত্য কায়েম নিয়ে সেই বাংলা থেকে বাংলাদেশে একটি বিরোধিতা চলেই এসেছে। ৭১ পরবর্তী সময়েও এই দেশে ভারত বিরোধীতা তুঙ্গেই ছিল সর্বদা। আর দিল্লীর মসনদে যেই বসুক, প্রতিবেশীদের উপর বল কিংবা প্রভাবিত করবার নীতি তাদের পুরোনো। এই অলিখিত নীতি, বর্তমান বিজেপি সরকারের ‘অখন্ড ভারত’ স্লোগানের পূর্বরূপ। ক্ষমতার পালা বদলে পররাষ্ট্রনীতি কিংবা প্রতিবেশীর উপর কতৃত্ব খাটানোর যে পুরোনো স্বভাব তা তাদের সরেনি। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে, ভারতের যে গুটি কয়েক বন্ধুরাষ্ট্র ছিল তারা ভারতকে টপকিয়ে চীনের সাথে সখ্য সৃষ্টি করছে। শেষমেশ ভারতের সবচেয়ে কাছের এবং পরীক্ষীত বন্ধু, শেখ হাসিনা সরকার। তাকেও ভারত হারালো। শেখ হাসিনার অবস্থান এখন আহমদাবাদে রয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে দিল্লী কতদিন তাকে আশ্রয় দিবে তা নিয়ে সন্দেহের বীজ বপন হচ্ছে। মজার বিষয়, হাসিনাকে নিয়ে কংগ্রেসের হাই কমান্ড এবং বিজেপির নেতৃবৃন্দের চিন্তা ভাবনা এক। অর্থাৎ তারা দুজনই শেখ হাসিনার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছে। কংগ্রেসের শশী থারুর শেখ হাসিনাকে “আমাদের বন্ধু” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মোদী সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা দোভাল, প্রায়শই শেখ হাসিনার সাথে দেখা করছেন। শলা পরামর্শ করছেন।

দেখা গেল, ভারত সর্বপ্রথম বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতেও বলেছে।

ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে যে নীতি প্রদর্শন করে মোটাদাগে এগুলো একটা দেশের সরাসরি সার্বভৌমত্বে আঘাত। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা এবং অবস্থান হচ্ছে তার সার্বভৌমত্ব। এটা বিনা একটি রাষ্ট্র, তার রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় না। অথচ বারেবারে বিগত ৫০ বছরে প্রতিবেশী দেশ আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনেছে।

কখনো সীমান্ত হত্যা, কখনো পানির ন্যায্যতা না দেয়া, একপেশে চুক্তি চাপিয়ে দেয়া, অবৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকদের অনুপ্রবেশ, চীনের সাথে সখ্যতা দেখলেই চোখ রাঙানো।

প্রতিটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বড় আঘাত হানবার মত ঘটনা। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে এই আঘাত হানাটা ভয়ানক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পিছনে ভারতের হাত ছিল। আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমাদেরকে শুধু দুর্বলই করেনি। বরং বাইরের দেশগুলোতে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মক ভাবে কমিয়েছে। অনেকে এখানে পিস কিপিং অপারেশনে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা টানতে চান। কিন্তু এই পিস কিপিং রোল কেন বাংলাদেশ পায় কিংবা বড় দেশগুলো নিতে চায় না, তা পিস কিপিং নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলেই পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশের পিস কিপিং মিশন দরকার, পিস কিপিং মিশনের বাংলাদেশকে না নিলেও কিছু যাবে আসবে না।

নতুন বাংলাদেশ কিংবা ‘বাংলাদেশ ২.০’। এই নতুন রাষ্ট্র গঠনে কিংবা নূন্যতম সংস্কারের শুরুটা করতে হবে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নামে যেই ভারত নীতি চালু রয়েছে, তার অবসান ঘটানো সময়ের দাবী। নতুন যিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তাকে কিছুটা ভারতঘেষা মনে করেন অনেকে। এছাড়াও তিনি ১/১১ সরকারে ভারতে নিযুক্ত হাইকমিশনার ছিলেনও বটে। কিন্তু তিনি তার এই ভারতের প্রতি সফট কর্নার নীতি থেকে সরে এসেছেন বলেই ঠাওর হয়। নতুন পররাষ্ট্র সচিব চীনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত। বর্তমান সরকার চীনের প্রতি ঝুঁকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেনোনা, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট তুঙ্গে। সাধেই কি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ‘দিল্লী না ঢাকা? ঢাকা ঢাকা’ স্লোগান তুলে মানুষ?

সংবিধান সংস্কার শুরু করলে, অনুচ্ছেদ ২৫ সংস্কারের দাবী তোলাটা ভুল কিছু নয়। কিন্তু আগেই বলেছি, ২৫ অনুচ্ছেদের যে মূলনীতি গুলো তা এখনো প্রাসঙ্গিক। যা হল-

‘আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, জাতিসংঘ সনদ বাস্তবায়ন এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা প্রভৃতি।’

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে দেয়া ভাষণের পরিণামে ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই অংশটির উপর জোর খাটানো হবে বোকামি।

বাংলাদেশ চীনের বি আর আই প্রজেক্টের সাথে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে রাখতে। বর্তমান সরকার আবার কিছুটা যুক্তরাষ্ট্র পন্থী। উপদেষ্টা পরিষদকে অনেকে কৌতুক করে এনজিও পন্থী উপদেষ্টা বলছেন। স্বাভাবিকভাবেই এখানে আমেরিকা প্রীতি বেশি হবে। কিন্তু এখানেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের সদ্বব্যবহার করার সময়। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সাথে সম্পর্ক এমন ভাবে বজায় রাখা সম্ভব, যেখানে তাদের দুজনের চক্ষুশূল হতে হবে না। সে কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ যেভাবে পররাষ্ট্রনীতি সাজাতে পারে-

১) বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান একই সাথে বিপদজনক এবং সুবিধাজনক। তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা ভারতকে উতরিয়ে কোনো ভাবেই বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ করতে পারবে না। কিন্তু সুবিধাজনক এইযে, একই ভাবে বাংলাদেশের ভুখন্ড ভারতকে চেইক মেইট দিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট উর্বর। কেনোনা ভারতের ভেতর তিন দিক দিয়ে প্রবেশের ক্ষমতা একমাত্র বাংলাদেশেরই। ভারতের রেইল করিডোর চুক্তি যদি এই সরকার বাতিল ঘোষণা করে, তাহলে সেভেন সিস্টার্সের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে পরিবর্তন তারা চেয়েছিল। সেটা পাবে না।

২) ভারতনীতি থেকে সরে আসার মোক্ষম সুযোগ এখানেই। পররাষ্ট্রনীতি হবে সমানে সমানে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় যাকে বলা হয় “রেসিপ্রোসিটি”।  সুতরাং ভারতকে তার কতৃত্ব পরায়ন মনোভাবকে কোনো ভাবে প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা। বর্ডার কিলিং রোধ এবং বর্ডারে ভারতের চোরাকারবারীদের অনুপ্রবেশ বন্ধের জন্য বিজিবিকে ব্যবহার করতে হবে। ঝিনাইদহ গত সপ্তাহে এমনই একটি সুসংবাদ বিজিবির পক্ষ থেকে এসেছে।

৩) চিকেনস নেইক এবং সেভেন সিস্টার্স ভারতের জন্য স্পর্শকাতর। ডক্টর ইউনুস প্রথম দিনেই যেই সতর্কবার্তা ভারতকে দিয়েছেন, তা ছিল সময়োপযোগী। এতে ভারত সহজেই প্রভাব খাটাতে চাইবে না। কারণ এতে তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এই বলিষ্ঠ নীতি মেনে চললে, ভারত তোষণ নীতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

৪) ভারত তোষণ নীতি থেকে বের হয়ে আসা মানে ভারত বিরোধী নীতি না। বরং ভারতের যে দাদাগিরি কিংবা সফট সম্প্রসারণবাদ, সেটার বিরোধীতা করা। ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক চাই। সেটা সুন্দরতর করার লক্ষ্যে দু দেশকেই আগ্রহী হতে হবে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার যেসকল দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে তা সম্পাদন করার তাগাদা ভারতকে দিতে হবে। যার মধ্যে নদীকেন্দ্রিক (যেমন- তিস্তা চুক্তি) অন্যতম। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাক গলানো বন্ধ করলে, বাংলাদেশও সে পথ অনুসরণ করবে। ভারতকে আশ্বাস দিতে হবে আমরা তার ক্ষতি কর‍তে আগ্রহী নই।  কিন্তু তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে; তার প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য সুখকর হবে না।

৫) চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। চীনের ডেবট ট্র‍্যাপ নিয়ে শংকা থেকেই যায়। এটা সত্য। কিন্তু চীনের ঋণ প্রকল্প অন্য যেকোনো ঋণ দাতা দেশ/প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ। এছাড়াও চীন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না। তিনটি পরাশক্তির মধ্যে চীনই একমাত্র পরাশক্তি, যাদের “গ্র‍্যান্ড স্ট্র‍্যাটেজি” সামরিক বিস্তার নয়। বরং অর্থনৈতিক ভাবে বন্ধু সৃষ্টি করা। যদিও চীন-বাংলাদেশের বাণিজ্য অনেকটাই এক পেশে। কিন্তু চীনের বিনিয়োগ সামনের দিনগুলোতে বাড়বে বলেই আশা রাখা যায়। ভারতের সাথে অন্যায্য চুক্তিগুলো যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে চীন বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চাইবে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো স্ট্র‍্যাটেজিক পয়েন্ট আর নেই। অবশ্য মোংলা বন্দরের একটি টার্মিনাল ভারত পরিচালনা করবে বলে জানা গেছে। সেটা পরবর্তীতে কন্টিনিউ হবে কিনা, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাই বাংলাদেশকে চীনের বলয়ে কিছুটা হলেও প্রবেশ করতে হবে নিজের অর্থনৈতিক অগ্রসরতার দোহাই দিয়ে। কারণ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে মারাত্মক টালমাটাল অবস্থানে আছে।

৬) শেখ হাসিনা পদত্যাগের করার পর একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি “সেন্টমার্টিন দেইনি বলে আমেরিকা আমাকে ক্ষমতা থেকে হটালো” মন্তব্য করেন। ২০০১ সালে তার ক্ষমতা হারানোর পেছনে “র এবং আমেরিকার” হাত দেখলেও, এবার তিনি শুধু আমেরিকাতেই ক্ষান্ত হয়েছেন। আর বন্ধুপ্রতিম ভারতেই তার অবস্থান নিতে হয়েছে। ড. ইউনুসের সাথে পশ্চিমের ভালো সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও। আই এম এফ কিংবা ওয়ার্ল্ডব্যাংক থেকে এই সরকার সহজে ঋণ নিয়ে আসতে পারে বলেও ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু তা দীর্ঘ মেয়াদে কতটুকু সাহায্য করবে তা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী হবার সুযোগ নেই এখনই। বাংলাদেশকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দু দেশকেই ব্যালেন্স করতে পারবে। এবং সেটা করতে হবে ভারতের লবিং ছাড়াই।

৭) এটা পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার উপর আস্থা হারিয়েছিল আগেই। শুধুমাত্র ভারতের কাকুতি মিনতির জন্য এবং চায়নার প্রতি বাংলাদেশের ঝুঁকে যাওয়া রোধ করতেই যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালে নমনীয় হয়। এদিকে রাশিয়ান এম্বেসি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে নাক গলানো নিয়ে বিবৃতি দিলে, যুক্তরাষ্ট্র আরো সাবধান হয়ে যায়। কিন্তু এ নিয়ে সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে চাচ্ছিল না। এখন যেহেতু হাসিনা নেই, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বড় রোল প্লে করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন হতে। তবে একই সাথে সাবধানও থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যাতে বাংলাদেশে মোড়লপনা না করতে পারে, তার জন্য সতর্কতামূলক পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলতে হবে।

৮) যে সকল চুক্তিতে বাংলাদেশ সিগনেটরি স্টেট হিসেবে রয়েছে, র‍্যাটিফাইড করেছে, সবগুলো মেনে চলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। বিশেষত মানবাধিকার আইন বিষয়ক চুক্তিগুলো।

৯)  ভারতের সাথে বন্দি বিনিময় আইন প্রয়োগ করে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে সুষ্ঠ বিচারের আওতাভুক্ত করতে হবে। অবশ্য এই এখতিয়ার আইন মন্ত্রণালয়ের। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আইন মন্ত্রণালয়ের নোটিশ পেলেই, কাজ শুরু করবেন বলে আশা ব্যক্ত করেছেন।

১০) সর্বোপরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রদবদল হোক বা না হোক, ভারত তোষণ নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। একটি সুষম দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে যতটুকু মেনে চলা যায়, ততটুকু চলার চেষ্টা করতে হবে। চীন থেকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু তবুও ডেবট ট্র‍্যাপ এড়িয়ে চলার চেষ্টা এবং স্বদিচ্ছা থাকতে হবে।

বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মিরাকল বলা হচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যকার ফাপা অবস্থা অনেকের চোখেই পড়েনি। শেখ হাসিনার পলায়ন ও পদত্যাগের পর গিয়েই লুটপাট এবং ঋণের সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশকে সমৃদ্ধশালী করে এবং জাতীয় পুঁজির উন্নতি সাধন করার মাধ্যমেই, বাইরের শক্তির উপর নির্ভরশীলতা কমবে। সম্প্রতি নিজের দেশের মানুষকে ইলিশ খাওয়ানোর পর বাইরে রপ্তানি করবে বলে মন্তব্য করেন, মৎস উপদেষ্টা। ঠিক এভাবেই দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। সাথেই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার সময়, তা নিয়ে গভীর আলোকপাত এবং পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র যাতে নতজানু না হয়ে বরং নিজের সক্ষমতায় সামনের দিকে এগুতে পারে, পররাষ্ট্রনীতি এভাবেই সাজিয়ে তুলতে হবে। তবেই বাংলাদেশ ২.০ এর রাস্তা সুগম হবে, তা স্বল্প মেয়াদে না হলেও; দীর্ঘমেয়াদে অবশ্যম্ভাবী।

Leave the first comment