জনবিতর্ক

নাশাদ ময়ুখ

ফ্যাসিজমের  পর বাংলাদেশ এখন কোন দিকে?

September 12, 2024   0 comments   2:22 pm

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধরে আমরা ‘মহান’ বানায়ে রাখছি আদতে আমাদের মুক্তি ঘটে নাই। একক রাজনৈতিক দল ও নেতার ক্রেডিটের কাছে জনতার পরাজয় হয়েছিল ‘জাতীয় মুক্তি’ প্রশ্নে। ২৪ এর অভ্যুত্থান এইদিক থেকে ব্যতিক্রম। এই অভ্যুত্থান সবার। এইখানে একক নেতা ও কোনো রাজনৈতিক দলের একক ক্রেডিট নেবার সুযোগ নাই।

Share

বিখ্যাত ফিল্মমেকার কুয়েন্টিন টারানটিনো কইছিলেন, ‘ফ্রেমে কী দেখা যাইতেছে না, সে জিনিসটা, ফ্রেমে কী দেখা যাইতেছে তার সমান ইম্পরট্যান্ট’। ফ্যাসিবাদি রেজিমের পতনের ঠিক ১০ দিনের মাথায় লিখতে গিয়া এই ক’দিনে যা দেখলাম, অথবা যা দেখানো হইতেছে, তার চেয়ে যা দেখতে পারতেছি না আমরা, তা নিয়া কথা বলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

কোটা আন্দোলনের শুরুতে লিখছিলাম যে, এই আন্দোলন যতক্ষণ গণআন্দোলনে পরিণত না হয়, ততক্ষণ এই আন্দোলন নিয়া আমার কোন আগ্রহ নাই। এই কথাগুলা এক ধরনের ফ্রেমের বাইরের কথাই। আন্দোলন কোটায় সীমাবদ্ধ না থেকে গণতে পরিণত হওয়ার আকাংক্ষা ও ইচ্ছার রেটোরিক্যাল প্রকাশ। এই অর্থে রেটোরিক যে, গত ১৫ বছরে স্বাধীন মতপ্রকাশের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ করে রাখতে যে ভয় ও বিচারহীনতার পরিবেশ ছিল,  খেয়াল করলে দেখবেন, ঐ পরিবেশেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কিন্তু থেমে থাকে নাই। আর তার প্রায় সমস্ত প্রকাশভঙ্গি ছিল রেটোরিক্যাল।

গত ১৫ বছরের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার হিস্ট্রি যদি নাড়াচাড়া করেন, তাইলে দেখতে পাবেন যে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী যত পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ ছিল, প্রায় সব ন্যারেটিভের শক্তিশালী কাউন্টার ন্যারেটিভ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে রাজনীতিবিদদের  চেয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী, চিন্তক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই ছিল এই রাজনৈতিক ও সামাজিক অভ্যুত্থান। যেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের একক ভূমিকা রাখার সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল না। আফটার ফ্যাসিজম, বাংলাদেশ কোন পথে যাবে বা করনীয় কী জানতে ও বুঝতে গনঅভ্যুত্থানের স্বরূপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে তাই।

২৪ এর অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির দুইটা ভিত্তি বড়ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে।

১) বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।

যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, এইটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়েছে ২০১৪ সালের পরপরই। পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ দিয়া ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার কোন পথ আসলে আওয়ামী লীগের হাতে ছিল না। এইটা উনারাও বুঝতেন বোধ করি। ভারতরাষ্ট্রের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির প্রমাণ এই দেশের মানুষ বিভিন্নভাবে টের পাওয়া শুরু করেছিল শহীদ আবরার ফাহাদের শাহাদাত বরণের মাধ্যমে, মোদির বাংলাদেশ সফরের সময়ে, সীমান্তে হত্যায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঘটনার মাধ্যমে। ১৯৭১ এ পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জিতে দেশ স্বাধীন করতে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের স্বাধীনতা ও সভারেনটির  প্রধান হুমকিই যে এই বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, এইটা যে মূলত ইন্ডিয়ার ছদ্ম দাসত্বের চাদরে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ,  শাসন ও শোষণ করার অস্ত্র, ধীরে ধীরে এই দেশের মুক্তিকামী জনগন অনুভব করতে শুরু করেছিল।

২) বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার।  

বঙ্গবন্ধুর উপর দেবত্ব আরোপ করার রাষ্ট্রীয় আয়োজনের বাধ্যবাধকতা ও বিরক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ঐতিহাসিক বাটপারির ব্যবস্থা ও ব্যবসা চালু করেছিল দেশে। পরিনতিতে, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা থেকে শেখ মুজিব শোষন, নিপীড়ণের প্রতীকে পরিণত  হয়ে পড়েছিলেন ও যার পরিণতি আমরা দেখলাম শেখ মুজিবের ভাস্কর্য, ও জাদুঘর পুড়িয়ে ও গুড়িয়ে দেয়ার বাস্তবতায়। এর মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবের ইতিহাসে যে স্থান প্রাপ্য সেই স্থান ফিরে পাওয়ার অবকাশ আসলো। মুজিব রক্ষা পাইতে থাকবেন, তার উপর চাপায়ে দেওয়া তার তৈরি দলের ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের দেবত্বের হাত থেকে। পাশাপাশি মুজিববাদী আদর্শের উপর ভর করে তৈয়ার হওয়া আওয়ামী রাজনৈতিক ন্যারেটিভের  প্রায় নিশ্চিহ্ন হবার পথে যাত্রা শুরু হইলো।  

২৪ এর গণঅভ্যুত্থান শুধু তাই বৈষম্যবিরোধী না। সব দল মত পথের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল মূলত দেশ ও দেশের জনগনকে দিল্লী ও মুজিব কাল্টের দাসত্ব থেকে মুক্তি করা। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিমকে হটানোর মাধ্যমে জনগণের সেই বিজয় অর্জিত হয়েছে।

এইটা খুব স্পষ্ট করে বলতে হবে ও আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা যদি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সামনে আগাইতে চাই আমাদের কোনভাবেই আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে ফিরে যাওয়ার উপায় নাই। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ধারণা একটি স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বিরোধী ধারণা।

এইবার আসি কেন আমরা ফ্যাসিবাদ বিরোধী থাকবো? তা কী তবে শুধু গণতান্ত্রিক থাকার অভিপ্রায়ে? আমার উত্তর হইলো,না’

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, মত, পথ কে এক রেখে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কথা বলে যা আমাদের সভারেনটির  জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরা সরকার গঠন করলে আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো, সেটা বলার অবকাশ নাই।

ফ্যাসিবাদ যে শুধু আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই ফিরে ফিরে আসে ও আসবে তা কিন্তু না। যে কোন সরকারই ফ্যাসিস্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের আপামর জনসাধারণের ঘাড়ের উপর বসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, কারন আমাদের সংবিধান সেই সুযোগ করে রেখেছে। আপনারা কী নিঃশ্বাসের তাপ টের পাইতেছেন না?

সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিল্লীর প্রতি সংবিধান অক্ষুণ্ণ রাখার আহবান ও হস্তক্ষেপ কামনাকে জয়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব হিশেবে দেখার সুযোগ নেই তাই। বরং অত্যন্ত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক।

বর্তমান সংবিধান থাকা মানেই দিল্লীর দাসত্ব থেকে আমাদের মুক্তি নাই,  সেক্ষেত্রে, সরকারে লীগ, বিএনপি, বা যে দলই থাকুক না কেন। ফ্যাসিবাদ ইটশেলফ দিল্লী বা সাম্রাজ্যবাদী যে কোন শক্তির শাসনের হাতিয়ার।

এক্ষেত্রে উপায় দুইটাঃ

১. বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সংবিধান বাতিল করে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে, গঠনসভা ডেকে নতুন গঠনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে, ফ্যাসিবাদী সরকার গঠনের সকল ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে প্রতিহত করা।

২. নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে অংশগ্রহণমূলক, জনগনের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

খেয়াল কইরেন যে দ্রুততম সময়ের কথা কইতেছি। এবং এখনো আমরা জানি না যে এই ইন্টারিম সরকারের মেয়াদ আসলে কয়দিনের। আমরা কি জানতে চাই? হ্যাঁ, আমরা জানতে চাই। এইটা আমাদের স্পষ্ট করেই জানতে হবে। সরকারের উচিত হবে তারা কী কী পদক্ষেপ নিবে, সেটা জনগণকে স্পষ্ট করবে। কারণ এই এন্টারিম সরকার জনসাধারণের রক্ত দিয়ে পাওয়া সরকার, জণগণের সরকার। একমাত্র স্বচ্ছতাই পারে এই সরকারকে জনগণের নিকটবর্তী রাখতে।

তো, শুরুতে যে কথা বলতেছিলাম যে, ফ্রেমের বাইরে যা  দেখতে পাইতেছি না আমরা তা হইলো:

১. সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক  বিপ্লবের সম্ভাবনা ও

২. ফ্যাসিজম ফিরে আসার সম্ভাবনা।

গণঅভ্যুত্থানকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা ও সুযোগ এখন যেমন আছে, দেশ স্বাধীনের পর আর কখনো ছিল না কি না আমার জানা নাই। ভুলে গেলে চলবে না যে এই সুযোগ আমাদের কাছে ঐতিহাসিকভাবেই এসেছে যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে গেছে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধরে আমরা ‘মহান’ বানায়ে রাখছি আদতে আমাদের মুক্তি ঘটে নাই। একক রাজনৈতিক দল ও নেতার ক্রেডিটের কাছে জনতার পরাজয় হয়েছিল ‘জাতীয় মুক্তি’ প্রশ্নে। ২৪ এর অভ্যুত্থান এইদিক থেকে ব্যতিক্রম। এই অভ্যুত্থান সবার। এইখানে একক নেতা ও কোনো রাজনৈতিক দলের একক ক্রেডিট নেবার সুযোগ নাই। দেশ গড়ার দায়িত্ব এখন সবার। দেশের ক্ষমতা জনগনের হাতে। এখনই সময় জনগনের প্রকৃত মুক্তির জন্য কাজ করা। দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাসকে দলীয় সংকীর্ণ ন্যারেটিভ থেকে মুক্ত করে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের বিকল্প নাই। এইটা যেমন আমাদের কর্তব্য তেমনি এইটা আমাদের জন্য আশঙ্কারও বটে। আমরা তা করতে ব্যর্থ হইলে ফ্যাসিজম বিভিন্ন ফর্মে ফিরে ফিরে আসবে।

Leave the first comment